Thursday 25 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শ্রেণিবৈষম্যের শেকল: অতীত হতে বর্তমান

মাহতাব মুহাম্মদ
২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৬:৫০

শ্রেণিবাদ (Classism) হলো এমন এক সামাজিক ধারণা বা মনোভাব, যেখানে মানুষকে তাদের সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থানের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হয়। এক্ষেত্রে উচ্চবর্গের মানুষকে বেশি যোগ্য ও মর্যাদাপূর্ণ এবং নিম্নবর্গের মানুষকে কম যোগ্য ও তুচ্ছ মনে করা হয়। অপরদিকে শ্রেণিবৈষম্য (Class Discrimination) হলো সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে প্রকৃত বৈষম্য সৃষ্টি করা, যা নীতি, আচরণ বা প্রথার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটি সমাজের সুযোগ, সম্পদ ও ক্ষমতার অসম বণ্টনের মাধ্যমে নিম্নবর্গের মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রাচীনকাল থেকেই এই শ্রেণিবাদ ও শ্রেণিবৈষম্যের চর্চা হয়ে আসছে। প্রাচীন বাংলার কথা যদি বলি, তৎকালীন হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে শ্রেণিবৈষম্য ছিল প্রকট। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতেন নিম্নবর্ণের লোকেরা। হিন্দু অভিজাত শ্রেণির লোকেরা খেতেন উৎকৃষ্ট চাল, দুধ, ঘি, মিষ্টান্ন, ফলমূল ইত্যাদি। ব্রাহ্মণরা ধর্মীয় কারণে অনেক সময় মাংস এড়ালেও তাদের ভোজ বৈচিত্র্যময় ছিল। কৃষক–শ্রমিকের খাদ্যতালিকায় থাকত মোটা চালের ভাত, শাকপাতা, সবজি, ডাল, কচু, শুকনো মাছ ইত্যাদি। মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘ফুল্লরার বারোমাসি দুঃখ’ অংশে এই বৈষম্যের চিত্র ফুটে ওঠেছে। তিনি লিখেছেন—“পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস পাপিষ্ঠ জ্যৈষ্ঠ মাস/ বেঙচের ফল খায়্যা করি উপবাস।” আবার, “আষাঢ়ে পুরিল মহী নবমেঘে জল/ বড় বড় গৃহস্থের টুটয়ে সম্বল/ মাংসের পসরা লয়্যা বুলি ঘরে ঘরে/ কিছু খুদকুড়া মিলে উদর না পুরে।” অর্থাৎ ‘জ্যৈষ্ঠ মাসে বুনো ফল খেয়ে উপোস থাকতে হতো কৃষকদের। আষাঢ়ে ধনীরা যেখানে দুর্যোগের সময়ও দিব্যি মাংস খেয়ে বেড়াতেন, সেখানে কৃষকের জুটত কেবল খুদকুড়া, যা দিয়ে পেটও ভরত না।’ এ রকম খাদ্য বৈষম্য শুধু অর্থনৈতিক কারণে নয়, সামাজিক নিষেধাজ্ঞার কারণেও টিকে ছিল। উচ্চবর্ণের রান্না নিম্নবর্ণ খেতে পারতেন না; এমনকি স্পর্শ করাও ছিল নিষিদ্ধ। ঘি, দুধ, উৎকৃষ্ট চাল ও মিষ্টান্নকে ধনী শ্রেণির খাদ্য মনে করা হতো।

বিজ্ঞাপন

নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস: আদিপর্ব ‘ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ব্রাহ্মণদের রান্না করা খাবার নিম্নবর্ণের জন্য স্পর্শ করারও অনুমতি ছিল না। কেননা নিম্নবর্ণদের স্পর্শ করা খাবার খাওয়া উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। এর ফলে অনেক খাদ্যসামগ্রী সামাজিক নিয়মে নিম্নবর্গের মানুষের জন্য সীমিত এবং এক পর্যায়ে নিষিদ্ধের পর্যায়ে চলে যেত। উৎসব-অনুষ্ঠানে জমিদার কিংবা ধনী শ্রেণির মানুষ ও গরিব শ্রেণির মানুষের খাবারের ধরনে থাকত ভিন্নতা। একই অনুষ্ঠান, অথচ ধনী–দরিদ্রের শ্রেণিবৈষম্যের কারণে আপ্যায়নে থাকত তারতম্য। পোশাক-আশাকেও তেমনি। ব্রাহ্মণ–ক্ষত্রিয় বা উচ্চবর্ণের লোকেরা সাধারণত সূক্ষ্ম সুতির ধুতি বা শাড়ি, মসলিন বা কাতানের কাপড়, স্বর্ণ, রূপা বা রঙিন কাপড় পরিধান করতেন। বৈশ্য ও শূদ্রদের মতো নিম্নবর্ণের লোকেরা মোটা সুতির বা খদ্দরজাতীয় কাপড় পরতেন। জমিদার বা অভিজাতরা প্রজাদের বা নিম্নশ্রেণির লোকদের জমকালো পোশাক ও অলংকার পরতে বাধা দিতেন, কারণ এগুলোকে উচ্চশ্রেণির প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘ফুল্লরার বারোমাসি দুঃখ’ অংশে আরও বর্ণিত আছে— “পউষে প্রবল শীত সুখী যগজন/ তুলি পাড়ি পাছড়ি শীতের নিবারণ/ হরিণী বদলে পাইনু পুরাণ খোসলা/ উড়িতে সকল অঙ্গে বরিষয়ে ধুলা।” অর্থাৎ ‘পৌষ মাসে প্রবল শীতে ধনীরা মোটা গরম কাপড় পরে উষ্ণ থাকলেও গরিব ফুল্লরার শরীরে কেবল ছেঁড়া পুরোনো কাপড়।’ এ থেকে তৎকালীন সমাজে শ্রেণিবৈষম্যের তীব্রতা সহজেই অনুমিত হয়। মুসলিম শাসকগণের আগমনের পর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও শ্রেণিবৈষম্য দূর হয়নি। শ্রেণিবাদীরা তাদের দেহের মধ্যে শ্রেণিবাদ ও শ্রেণিবৈষম্যের জিন যেন বয়ে বেড়িয়েছেন শতাব্দীর পর শতাব্দী। তাই তো একবিংশ শতাব্দীতেও শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিবাদের জয়জয়কার। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শ্রেণিবাদের চর্চা হয় এখনো। চারদিকে শ্রেণিবৈষম্যের জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্ত। নিজেকে জনগণের সেবক দাবি করা রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী, সাংবাদিকসহ অসংখ্য মানুষের মন-মগজে এখনো শ্রেণিবাদের চারা লকলক করে বেড়ে ওঠছে। কখনো কখনো রাষ্ট্রও শ্রেণিবৈষম্যের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। শহরের দিকে তাকালে আমি ঢের শ্রেণিবৈষম্যের চিত্র পাই। এখানে–ওখানে ধনী শ্রেণির লোকদের জন্য তৈরি ঝকঝকে ফাইভ স্টার হোটেল, চোখ ধাঁধানো শপিংমল, উন্নত রেস্তোরাঁ, আধুনিক সেবাসমৃদ্ধ হাসপাতাল। শহরের অভিজাত মানুষের জন্য তৈরি হয়েছে আলাদা অভিজাত নগরী। অপরদিকে দরিদ্রশ্রেণির মানুষের পোশাকের জন্য ফুটপাত, খাবারের জন্য পাশের কোনো নিম্নমানের হোটেল, চিকিৎসার জন্য নিম্নমানের ক্লিনিক কিংবা সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে গাদাগাদি করে সেবা নেওয়া, তাদের ছেলে–মেয়েদের পড়াশোনার জন্য তাইরে–নাইরে কোনো প্রতিষ্ঠানই ভরসা। এদিকে ধনী শ্রেণির ছেলে–মেয়েদের জন্য দামি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সদা প্রস্তুত। এ সব কিছু তুলে ধরে সমাজের শ্রেণিবৈষম্যের বাস্তব চিত্র। এ তো গেল শ্রেণিবৈষম্যের কথা। শ্রেণিবাদের নজির কী আছে? ভূরিভূরি আছে। বেশ কিছুদিন আগের এক উপদেষ্টার হাঁসের মাংস খাওয়ার বিতর্কের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছিলেন, মাঝেমধ্যে ভোরে কাজ শেষে বাসায় খাবার না পেয়ে তিনি নীলা মার্কেটে হাঁসের মাংস খেতে যান, সেখানে খাবার না পেলে যান গুলশানের ওয়েস্টিনে। এই বক্তব্যের পরেই অনেকেই ব্যঙ্গ–বিদ্রূপে মেতে ওঠেন। বক্তব্যের আগের অংশ বাদ দিয়ে কেবল “ওয়েস্টিনে হাঁসের মাংস খেতে যান” অংশটিই তুলে ধরে উপহাস করা হয়। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ তো লিমেরিক লিখে ফেললেন—“এক সময় ভাত খুঁজত ক্যান্টিনে/ এখন হাঁস খুঁজে ওয়েস্টিনে।” পার্থ সাহেবের লিমেরিকে স্পষ্ট শ্রেণিবাদের ইঙ্গিত আছে। কেননা এখানে মূল আলোচনার বদলে কেবল সামাজিক অবস্থানকে টেনে আনা হয়েছে। প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক, কিন্তু তা হতে হবে জবাবদিহিতার জন্য, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জন্য নয়। কারো সন্দেহজনক জীবনযাপন নিয়ে স্বচ্ছতার প্রশ্ন করা যৌক্তিক, তবে কেবল সামাজিক অবস্থান টেনে বিদ্রূপ করলে সেটি স্বাভাবিক প্রশ্ন তোলার পরিবর্তে শ্রেণিবাদের চর্চা হয়ে যায়। তাই প্রশ্ন করুন, কিন্তু শ্রেণিবাদকে উসকে দেবেন না।

এবার একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করি। আমি তখন অনার্স শেষ করে মাস্টার্সে ভর্তি হয়ে মোটামুটি মানের একটা বেসরকারি স্কুলে পার্টটাইম চাকরি নিয়েছি। ওই স্কুলের অধিকাংশ ছাত্রের অভিভাবক মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্ন–মধ্যবিত্ত। একবার এক অভিভাবক প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে হম্বিতম্বি শুরু করলেন। জানা গেল, পাশের বস্তি থেকে একটি ছেলে ভর্তি হয়েছে। এতে অভিভাবকের আত্মসম্মানে আঘাত লেগেছে। তিনি চেঁচালেন—“আমার বাচ্চা যে স্কুলে পড়ে, বস্তির ছেলেও সেই স্কুলে পড়লে মান–সম্মান থাকে?” প্রধান শিক্ষক শেষ পর্যন্ত ছেলেটির ভর্তি বাতিল করলেন। যেদিন ছেলেটি শেষবার স্কুলে এসেছিল, আমি তার মুখের দিকে তাকাতে সাহস পাইনি। লজ্জায় ও ঘৃণায় সে যতটা কুঁকড়ে গিয়েছিল, আমি তার চেয়ে বেশি। হয়তো সে মনে মনে বলছিল—“বস্তিতে থাকি বলে সমাজ আমাকে বঞ্চিত করতে চায়, শিক্ষার আলোটাও কেড়ে নিতে চায়।” পরবর্তীকালে আমিও ওখানকার চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম। আসলে এ রকম ঘটনা শহরে–মফস্বলে, এমনকি সারা দুনিয়ায় অহরহ ঘটে, যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আমরা কতটা শ্রেণিবিদ্বেষী, কতটা শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিবাদকে লালন করে চলি।

একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা শ্রেণিবৈষম্যের শৃঙ্খল থেকে বের হতে পারলাম না। বরং শ্রেণিবৈষম্য ও শ্রেণিবাদ যেন নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। কিন্তু সমাজ থেকে এসব শ্রেণিবৈষম্য যতদিন না দূর করা যাবে, ততদিন বৈষম্যমুক্ত সমাজ গঠন অধরাই থেকে যাবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি

মাহতাব মুহাম্মদ মুক্তমত শ্রেণিবৈষম্য

বিজ্ঞাপন

‘ইউনূস সাহেব বৈষম্য সৃষ্টি করেছেন’
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০০:৩১

আরো

সম্পর্কিত খবর