Monday 29 Sep 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছুটির দিনেও যাদের ঠাঁই কর্মস্থল, তাদের কথা কি কেউ ভাবে?

সাদিয়া সুলতানা রিমি
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ১৮:২১

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে ধর্মীয় উৎসব মানেই প্রাণের উচ্ছ্বাস। দুর্গাপূজা, ঈদ, বড়দিন, বুদ্ধ পূর্ণিমা— প্রতিটি উৎসবেরই নিজস্ব আবেগ, আচার ও আনন্দ রয়েছে। অফিস, স্কুল-কলেজ, কারখানা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান— সব জায়গায় ছুটির আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, ভ্রমণ, পূজা বা প্রার্থনায় অংশ নেওয়া—সবই হয়ে ওঠে উৎসবের অঙ্গ। কিন্তু এই আনন্দ-উচ্ছ্বাসের ভিড়ে আমরা কি এক মুহূর্তও ভেবে দেখি, যাদের জন্য উৎসবের দিনেও কর্মস্থলই শেষ আশ্রয়, তাদের জীবনের গল্প কেমন?

উৎসবের দিনগুলোতে যেসব মানুষ কাজ চালিয়ে যান, তাদের সংখ্যা কম নয়।
স্বাস্থ্যকর্মী ও হাসপাতালের স্টাফরা: দুর্গাপূজা হোক বা ঈদ, চিকিৎসা-সেবা কোনোদিন বন্ধ হয় না। ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান, আয়া— সবাইকে ডিউটি করতে হয়। জরুরি সেবা দেওয়া হাসপাতালের জন্য ছুটির দিন মানেই বেশি চাপ।

বিজ্ঞাপন

নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী: পূজা মণ্ডপ, মসজিদ, গির্জা বা পাবলিক প্লেসে নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ, র‍্যাব, আনসার, ট্রাফিক পুলিশকে স্বাভাবিক দিনের চেয়েও বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়।

পরিবহন ও গণমাধ্যমকর্মী: পূজার ছুটিতে ঘরমুখো মানুষের চাপ সামলাতে বাস-ট্রেন-লঞ্চের চালক, সহকারী, টিকেটিং স্টাফ, রেলওয়ে পুলিশকে নিত্যদিনের চেয়ে বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। একইভাবে, টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র— সবই চালু রাখতে হয় সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, এডিটরদের।

দোকানদার, হোটেল-রেস্টুরেন্ট কর্মী, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা: উৎসবের সময় মানুষের কেনাকাটা ও ভ্রমণ বেড়ে যায়। ফলে রেস্টুরেন্ট, হোটেল, সুপারশপ, মেলা, মণ্ডপে দোকানদারদের ছুটি নেওয়ার সুযোগ থাকে না।

স্বল্প আয়ের শ্রমজীবী মানুষ: রিকশাচালক, বাসা-হোটেল কর্মচারী, দিনমজুর— উৎসবের সময় কাজের সুযোগ বেড়ে যায়, তাই অনেকে কাজ ছেড়ে যেতে পারে না।

ছুটির দিনে কাজের চাপ সামলাতে গিয়ে এই মানুষগুলো হারায় অনেক কিছু।
পরিবার ও সামাজিকতা থেকে দূরত্ব – অন্যরা যখন পূজার ঘরে প্রতিমার সামনে প্রণাম করছেন, পরিবারের সঙ্গে অঞ্জলি বা ভোগে অংশ নিচ্ছেন, তখন হাসপাতালের একজন নার্স হয়তো ডিউটিতে ব্যস্ত, কিংবা ট্রেনের চালক যাত্রীদের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।

মানসিক চাপ ও অবসাদ – উৎসব মানেই মানসিক রিচার্জের সময়। যারা ছুটি পান না, তাদের ক্ষেত্রে এ সুযোগ হারিয়ে যায়। ফলে মানসিক ক্লান্তি ও পেশাগত অবসাদ বাড়ে।

অন্যায় বণ্টনবোধ – অনেকে মনে করেন, ‘আমরাই কেন সবসময় কাজ করব?’—এ বঞ্চনার অনুভূতি থেকে অসন্তোষ জন্মাতে পারে।

কিছু কাজের প্রকৃতি এমন— যেখানে বিরতি দেওয়া যায় না। জরুরি পরিষেবা, নিরাপত্তা, সংবাদপ্রবাহ, পরিবহন—সবই চলমান রাখতে হয়। অন্যদিকে, অর্থনৈতিক বাস্তবতাও গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য উৎসব মানেই বেশি আয়ের সুযোগ। তাই পারিবারিক উৎসব ছেড়ে তারা কাজে ঝুঁকে পড়েন।

তবে এখানে ব্যবস্থাপনারও ঘাটতি আছে। অনেক প্রতিষ্ঠান উৎসবের আগে-পরে কর্মীদের শিফট ঘুরিয়ে বা বিকল্প ডিউটির ব্যবস্থা করলে কিছুটা হলেও ভারসাম্য রাখা যেত।

সমাজ হিসেবে আমরা এই মানুষদের প্রতি কতটা কৃতজ্ঞ? আমাদের উচিত তাদের জন্য কিছু বিষয় নিশ্চিত করা—

অর্থনৈতিক প্রণোদনা ও বিশেষ ভাতা: যারা উৎসবের দিনেও কাজ করেন, তাদের জন্য বিশেষ বোনাস বা ভাতা থাকা উচিত।

শিফট ও বিকল্প ছুটি: উৎসবের আগে-পরে তাদের আলাদা করে ছুটি দেওয়ার ব্যবস্থা হতে পারে।

সম্মান ও স্বীকৃতি: সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যারা ছুটির দিনে কাজ করেন, তাদের সামাজিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া জরুরি।

মানসিক সহায়তা: মানসিক চাপ কমাতে কাউন্সেলিং বা ওয়েলবিইং প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

দুর্গাপূজা হোক বা অন্য যে কোনো উৎসব—তার মূল শিক্ষা হলো সহমর্মিতা, ন্যায্যতা ও মঙ্গল। পূজার মণ্ডপে প্রতিমা স্থাপন ও অঞ্জলি প্রদানের সঙ্গে যদি সমাজের প্রান্তিক মানুষদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত না হয়, তবে উৎসবের চেতনা অপূর্ণ থেকে যায়।

যারা ছুটির দিনেও কর্মস্থলে থেকে যান, তাদের পরিশ্রম ও ত্যাগ আমাদের উৎসবকে নিরবচ্ছিন্ন রাখে। তাদের প্রতি সম্মান দেখানো কেবল নৈতিক দায়িত্ব নয়, বরং সামাজিক ন্যায্যতারও দাবি।

উৎসবের আনন্দ সবার জন্য। কিন্তু বাস্তবে সবার কাছে সমানভাবে তা পৌঁছায় না। পূজার ছুটির আমেজে আমরা যখন ব্যস্ত, তখন হাসপাতালের নার্স, ট্রাফিক পুলিশ, সংবাদকর্মী, রিকশাচালক—অসংখ্য মানুষ নীরবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।তাদের শ্রম ও ত্যাগের স্বীকৃতি দেওয়া, অর্থনৈতিক ও মানসিক সহায়তা নিশ্চিত করা, বিকল্প ছুটির ব্যবস্থা করা—সবই রাষ্ট্র, প্রতিষ্ঠান ও সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব। তবেই আমাদের উৎসব সত্যিকারের অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে।এই পূজায় তাই এক মুহূর্ত থেমে ভাবা দরকার— ‘ছুটির দিনেও যাদের ঠাঁই কর্মস্থল, তাদের কথা কি আমরা ভাবি?’ তাদের জীবনের প্রতি সহমর্মিতা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনই হতে পারে পূজার প্রকৃত মানসিকতা।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

ছুটির দিনে কর্মস্থল মুক্তমত সাদিয়া সুলতানা রিমি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর