Sunday 05 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষক হোক শিক্ষার্থীর আস্থার জায়গা

তানজিদ শুভ্র
৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৪:১৮

শিক্ষক— এই শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক গভীর শ্রদ্ধা, মমতা ও বিশ্বাসের বন্ধন। শিক্ষক মানে কেবল পাঠ্যবইয়ের অক্ষর বা সূত্র শেখানো নয়; বরং তিনি সমাজ গঠনের নীরব কারিগর। জীবনের প্রথম পাঠ আমরা পাই মায়ের কাছে, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় প্রবেশের পর থেকেই শিক্ষকদের সান্নিধ্য আমাদের চিন্তা, মূল্যবোধ আর জীবনদর্শন গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একজন শিক্ষক শুধুমাত্র জ্ঞানের সরবরাহকারী নন, তিনি শিখিয়ে দেন কেমন মানুষ হতে হয়, শেখান মানবিকতা, নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ। তাই বলা যায়, একজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন শিক্ষার্থীর অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা।

একটি দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভর করে সেই দেশের শিক্ষিত জনসংখ্যার উপর, আর সেই শিক্ষিত প্রজন্ম তৈরির মূল দায়িত্ব শিক্ষকদের কাঁধেই বর্তায়। একজন শিক্ষার্থী যতটা সময় পরিবারের সঙ্গে কাটায়, তার সমান বা অনেক সময় তার চেয়েও বেশি সময় কাটায় শিক্ষকদের সঙ্গে। তাদের স্নেহ, মমতা, উৎসাহ আর যত্নে বেড়ে ওঠে শিক্ষার্থীর মনন ও চরিত্র। ছাত্র–শিক্ষকের এই সম্পর্কের ভিত্তি হয় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই সম্পর্কের জৌলুস যেন কিছুটা মলিন হয়ে পড়েছে। কখনো শিক্ষকের দায়িত্বহীনতা, কখনো শিক্ষার্থীর অশোভন আচরণ—সব মিলিয়ে এই সম্পর্কের বন্ধন ঢিলে হয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিশ্ব শিক্ষক দিবস প্রতি বছর ৫ অক্টোবর পালিত হয়। ১৯৯৪ সালে ইউনেস্কোর উদ্যোগে এ দিবসটি প্রথম পালন শুরু হয়, শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষকদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ। ২০২৫ সালের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে—“Recasting Teaching as a Collaborative Profession”, অর্থাৎ শিক্ষা শুধুই ব্যক্তিগত পেশা নয়, বরং এটি পারস্পরিক সহযোগিতা ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক যৌথ ক্ষেত্র। এই প্রতিপাদ্যের ভেতরেই নিহিত আছে আধুনিক শিক্ষার মৌলিক দর্শন—শিক্ষক একা নয়, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সমাজ—সবাই মিলে গড়ে তোলে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশও এ দিবসটি জাতীয়ভাবে উদযাপন করছে, যা শিক্ষকদের মর্যাদা ও সচেতনতা বৃদ্ধির একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।

তবে শুধু আনুষ্ঠানিক দিবস পালনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না; বাস্তবতা বলছে, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ভিত এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে। একদিকে শিক্ষকের প্রতি শিক্ষার্থীর শ্রদ্ধাবোধে ভাটা পড়েছে, অন্যদিকে কিছু শিক্ষক নিজেদের দায়িত্ব ও মর্যাদার সীমা লঙ্ঘন করছেন। সংবাদপত্রের পাতায় প্রায়ই দেখা যায় শিক্ষক কর্তৃক অনৈতিক আচরণ, ভুয়া সনদে নিয়োগ, পরীক্ষায় অনিয়ম বা অর্থের বিনিময়ে চাকরি দেয়ার মতো ঘটনা। এসব অপকর্ম শুধু শিক্ষকের ভাবমূর্তি নষ্ট করে না, পুরো সমাজের কাছে শিক্ষকের প্রতিচ্ছবিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীরাও কখনো কখনো শিক্ষকদের অসম্মান করে, কটূক্তি করে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষমূলক আচরণে লিপ্ত হয়—যা ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সৌন্দর্য নষ্ট করে দেয়।

এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে উভয় পক্ষকেই দায়িত্বশীল হতে হবে। একজন শিক্ষককে হতে হবে জ্ঞানের পাশাপাশি চরিত্রেরও আদর্শ উদাহরণ। তাকে শিক্ষার্থীর প্রতি হতে হবে সহনশীল, মমতাময় এবং বন্ধুসুলভ। শ্রেণিকক্ষের গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষার্থীর মানসিক বিকাশেও তার ভূমিকা থাকতে হবে। শিক্ষার্থীর প্রতি তার আচরণ হবে ন্যায্য ও নিরপেক্ষ, যাতে ছাত্ররা বুঝতে পারে—তাদের শিক্ষক সত্যিই তাদের ভালোবাসেন এবং উন্নতির পথে পাশে আছেন। অন্যদিকে, শিক্ষার্থীদেরও মনে রাখতে হবে—শিক্ষক কেবল একজন পেশাজীবী নন, বরং তাদের জীবনের দিশারি। শিক্ষককে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া শিক্ষারই অংশ। তারা ভুল করতেই পারেন, কিন্তু সেই ভুল সংশোধনের উপায় কখনো অসম্মান বা আক্রমণ নয়; বরং সম্মানজনক উপায়ে মতামত জানানোই হতে পারে সঠিক পথ।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকেও এ সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য আলাদা আচরণবিধি থাকা জরুরি। নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশন, আলোচনা সভা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়ানো যেতে পারে। শিক্ষক প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন, বেতন–সুবিধা ও কর্মপরিবেশ উন্নত হলে তারা আরও দায়িত্বশীল হবেন। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানবিক শিক্ষা ও নৈতিক চর্চা বাড়াতে হবে। কারণ শিক্ষা কখনোই কেবল পরীক্ষার জন্য নয়; বরং জীবনকে জানার জন্য।

একজন প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনে এমন আস্থা তৈরি করেন, যা জীবনের নানা মুহূর্তে সাহস জোগায়। অনেক সময় ছাত্ররা পরিবারের কাছেও যা বলতে পারে না, শিক্ষককে তা জানাতে পারে। একজন শিক্ষক যদি এমন পরিবেশ তৈরি করতে পারেন, যেখানে ছাত্র নিরাপদে নিজের কথা বলতে পারে, নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করতে পারে—তবে সেটিই হবে প্রকৃত শিক্ষা পরিবেশ। শিক্ষক তখন হয়ে উঠবেন কেবল পাঠদাতা নয়, শিক্ষার্থীর মানসিক আশ্রয় ও অনুপ্রেরণার কেন্দ্র।

আজকের দিনে তাই প্রয়োজন “শিক্ষক–শিক্ষার্থী সম্পর্ক” পুনঃনির্মাণের। শিক্ষক হোক শিক্ষার্থীর আস্থার জায়গা—এটি কেবল একটি বাণী নয়, একটি সামাজিক অঙ্গীকার। শিক্ষক যদি নিজের দায়িত্ব ও আদর্শে দৃঢ় থাকেন এবং শিক্ষার্থী যদি সেই দায়িত্বের প্রতিদান দেয় সম্মান ও কৃতজ্ঞতায়, তাহলে এই সম্পর্ক কখনো দুর্বল হবে না। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল বার্তাটিও এই—শিক্ষা কেবল পাঠ নয়, এটি পারস্পরিক সহযোগিতা ও বিশ্বাসের এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। একজন শিক্ষক যতটা সমাজকে আলোকিত করেন, একজন শিক্ষার্থী ততটাই তার আলো বহন করে ভবিষ্যতের পথে। তাই এখন সময় এসেছে, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের সেই পুরনো সেতুটা আবার গড়ে তোলার। শিক্ষক হোক শিক্ষার্থীর আস্থার জায়গা—এই মন্ত্রেই হোক আমাদের শিক্ষার নতুন সূচনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর

সারাবাংলা/এএসজি

তানজিদ শুভ্র বিশ্ব শিক্ষক দিবস মুক্তমত শিক্ষক শিক্ষার্থী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর