Sunday 05 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দা: প্রকৃতির সাথে গাঁথা টাঙ্গুয়ার মানুষের ভাগ্য

সাদিয়া সুলতানা রিমি
৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:২১

বাংলাদেশ প্রকৃতির দানেই সমৃদ্ধ এক দেশ। হাওর, নদী, খাল, বিল—সব মিলিয়ে এই ভূখণ্ড যেন এক অনন্য প্রকৃতির ভান্ডার। সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর সেই ভান্ডারের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্থানীয়রা যাকে বলেন— ‘ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দা।’ নামটির মধ্যেই রয়েছে বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্যের ইঙ্গিত। কিন্তু এই প্রাচুর্যের মাঝেই টিকে আছে হাজারো মানুষের দুঃখ-সুখ, সংগ্রাম আর ভবিষ্যৎ আশার গল্প।

টাঙ্গুয়ার হাওর বাংলাদেশের সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলায় অবস্থিত একটি হাওর। প্রায় ১২৬ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ হাওর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি।এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার স্থান হিসাবে পরিচিত, প্রথমটি সুন্দরবন। বর্ষায় এটি রূপ নেয় বিশাল সমুদ্রের মতো, আর শুষ্ক মৌসুমে প্রকাশ পায় বিল আর কান্দার বিভাজন। মাছের সমৃদ্ধ ভান্ডার, শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখির আগমন, আর কান্দায় ধানের চাষ— সব মিলিয়ে এটি প্রকৃতির এক অসাধারণ ভারসাম্যের জায়গা। রুই, কাতলা, শোল, বোয়াল কিংবা শীতের অতিথি পাখিদের ভিড়— সবকিছুই যেন এই হাওরকে এক জীবন্ত স্বর্গে পরিণত করেছে।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই সৌন্দর্যের ভেতরেই লুকিয়ে আছে সংগ্রামের গল্প। টাঙ্গুয়ার হাওরের মানুষের জীবন প্রকৃতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। শীতকালে বোরো ধানই তাদের সারা বছরের প্রধান ভরসা। কিন্তু এপ্রিলের আকস্মিক পাহাড়ি ঢল প্রায়ই এই ধান পানির নিচে ডুবিয়ে দেয়। এক নিমিষেই সারা বছরের আশা ভেসে যায়।

মাছ ধরা, কৃষি আর মৌসুমি শ্রম— এটাই হাওরের মানুষের জীবনযাত্রার ভিত্তি। নৌকাই তাদের প্রধান যাতায়াত মাধ্যম। স্কুলে যাওয়া, বাজার করা কিংবা উৎসব—সবকিছুতেই নৌকার ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু মৌসুমি কর্মসংস্থানের কারণে বছরের অনেকটা সময় তারা দারিদ্র্য আর ঋণের ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে।

টাঙ্গুয়ার হাওর যেমন জীবিকার উৎস, তেমনি জীবনের বড় হুমকিও বটে। অকাল বন্যা ফসল ধ্বংস করে, জলবায়ু পরিবর্তন অনিশ্চয়তা বাড়ায়, অবৈধ জাল ব্যবহারে মাছের প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়ে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পর্যটনের চাপও বাড়ছে। সঠিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া এই চাপ প্রকৃতির জন্য হুমকি ডেকে আনছে।

তবুও হতাশার মাঝেও সম্ভাবনা আছে। টেকসই ইকোট্যুরিজম গড়ে তোলা গেলে হাওর হবে আয়ের নতুন উৎস। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অকাল বন্যার ক্ষতি কিছুটা কমানো সম্ভব। মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন মৌসুমে সুরক্ষা নিশ্চিত করলে মাছের ভান্ডার টেকসই রাখা যাবে। পাশাপাশি বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে হাওরের মানুষ দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে মুক্তি পাবে।

টাঙ্গুয়ার হাওর কেবল একটি জলাভূমি নয়, এটি মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। ছয় কুড়ি বিল আর নয় কুড়ি কান্দা শুধু সংখ্যা নয়, এটি প্রকৃতির সাথে মানুষের সহাবস্থানের প্রতীক। এই হাওর রক্ষা করা মানে কেবল একটি ভূপ্রকৃতি রক্ষা করা নয়—এটি মানে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা, মানুষের জীবিকা রক্ষা করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি আশীর্বাদ রক্ষা করা।

সুতরাং, টাঙ্গুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই প্রকৃতি-নির্ভর জীবনধারা ও সংগ্রাম আমাদের মনে করিয়ে দেয়— মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক ছিন্ন নয়, বরং ভাগ্যের মতোই চিরন্তন।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

টাঙ্গুয়ার হাওর মুক্তমত সাদিয়া সুলতানা রিমি সুনামগঞ্জ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর