পার্বত্য চট্টগ্রাম..বাংলাদেশের ভূখণ্ডের প্রায় এক-দশমাংশ জুড়ে বিস্তৃত এই অঞ্চল শুধু পাহাড়-ঝরনার সৌন্দর্যে নয়, কৌশলগত গুরুত্বেও অনন্য। ভারতের সঙ্গে ৮৬৮ কিলোমিটার এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ২০৯ কিলোমিটার সীমান্ত নিয়ে এই ভূখণ্ড কার্যত দেশের প্রাকৃতিক নিরাপত্তার প্রাচীর। সীমান্তবর্তী এ পাহাড়ি অরণ্য যেমন দেশের প্রাণপ্রকৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি বহিরাগত নানা ঝুঁকিরও উৎসস্থল। তাই এ অঞ্চলের নিরাপত্তা, শান্তি ও উন্নয়নের প্রশ্নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা হয়ে উঠেছে অপরিহার্য, আর শুধু নিরাপত্তার নয়, তারা আজ পাহাড়ের সম্প্রীতি রক্ষার দূত।
ইতিহাসের পটভূমি
১৯৭৫ সালের পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম দীর্ঘ সশস্ত্র সংঘাত ও অস্থিরতার সাক্ষী। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শান্তিচুক্তি নিঃসন্দেহে সহাবস্থানের পথে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। তবে চুক্তি সত্ত্বেও সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্ন তৎপরতা, মাদক ও অস্ত্র পাচার, মানবপাচার, এমনকি চাঁদাবাজি আজও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ফলে এখানে সেনা উপস্থিতি শুধু প্রহরী নয়, বরং আস্থার প্রতীক।
আস্থা ও উন্নয়নের সেতুবন্ধন
শান্তিচুক্তির পর সেনাবাহিনী নিজেদের ভূমিকা পুনর্নির্ধারণ করেছে। তারা পাহাড়ি মানুষের কাছে হয়ে উঠেছে একপ্রকার আস্থার হাতিয়ার। দুর্গম এলাকায় বিনামূল্যে চিকিৎসা শিবির, শিক্ষা সহায়তা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম কিংবা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সবকিছুই সেনাবাহিনীর হাত ধরে সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচনা করেছে।
গত কয়েক বছরে নির্মিত হয়েছে শত শত কিলোমিটার সড়ক ও একাধিক সেতু।
পরিচালিত হচ্ছে বিদ্যালয় ও কারিগরি প্রশিক্ষণকেন্দ্র। বছরে লাখো মানুষ পাচ্ছে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পাহাড়ধসের সময়ে সেনাবাহিনীই দ্রুততম সময়ে করছে উদ্ধার অভিযান ও পৌঁছে দিচ্ছে ত্রাণ।
এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনী প্রমাণ করেছে, তারা কেবল সশস্ত্র প্রহরী নয়, বরং মানুষের জীবনমান উন্নয়নের সঙ্গী।
সীমান্তের নিরাপত্তা ও নতুন চ্যালেঞ্জ
পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত দিয়ে প্রতিবছর শত কোটি টাকার মাদক প্রবাহিত হয়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের সক্রিয়তা, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কিংবা সীমান্তবর্তী অস্থিরতা পুরো দেশের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার…ড্রোন, থার্মাল ক্যামেরা, স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন, হতে পারে কার্যকর প্রতিরোধ। একই সঙ্গে পাহাড়ি পরিবেশ উপযোগী বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাহিনী এবং নতুন ঘাঁটি ও অবকাঠামো নির্মাণ জরুরি হয়ে পড়েছে।
সম্প্রীতির দূত হিসেবে সেনাবাহিনী
পাহাড়ি/বাঙালি বিভাজনের রাজনীতি বহু পুরোনো। কিন্তু সেনাবাহিনীর সামাজিক কর্মকাণ্ড, মানবিক সহায়তা এবং উন্নয়নমূলক অবদান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যকার আস্থার দূরত্ব কমিয়েছে। গ্রামে গ্রামে চিকিৎসা শিবির বা স্কুলগামী শিশুদের হাতে শিক্ষা উপকরণ পৌঁছে দেওয়ার দৃশ্যগুলো সেনাবাহিনীকে পাহাড়ের মানুষের চোখে কেবল বাহিনী নয়, বরং সম্প্রীতির দূত হিসেবে পরিচিত করেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ভূমিকা অস্বীকারের উপায় নেই। এই ভূমিকা কেবল সীমান্ত রক্ষা বা অস্ত্রধারীদের প্রতিরোধ নয়, বরং একটি বহুমাত্রিক মানবিক প্রচেষ্টা,যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও জাতীয় সার্বভৌমত্বকে শক্তিশালী করে। পাহাড় বাংলাদেশের সুরক্ষার প্রাচীর, আর এই প্রাচীরকে মজবুত রাখতে সেনাবাহিনী এখন শুধু সৈনিক নয়, শান্তি ও সম্প্রীতির দূত।
লেখক: সাংবাদিক