Sunday 05 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

তরুণদের অকাল মৃত্যু: ভেজালের বিষে নিঃশেষ এক প্রজন্ম ও আমাদের নীরবতা

সাদিয়া সুলতানা রিমি
৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:৪৯ | আপডেট: ৫ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:৫০

সম্প্রতি দুটি মৃত্যুর সংবাদ মনকে গভীরভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী হোটেলে খেতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা গেছেন। অন্যদিকে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ বান্দরবানে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে প্রাণ হারিয়েছেন। দুইটি ঘটনা ভিন্ন প্রেক্ষাপটে ঘটলেও এর পেছনে লুকিয়ে আছে একই ভয়াবহ বাস্তবতা বাংলাদেশের তরুণ সমাজ আজ এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত। অল্প বয়সে হৃদরোগ, স্ট্রোক, কিডনি বিকল, কিংবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা যেন এখন নিত্যনৈমিত্তিক। প্রশ্ন জাগে একটি তরতাজা প্রজন্ম কেন এভাবে হঠাৎ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে?

বিজ্ঞাপন

এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হয় প্রতিদিনের খাবারের থালার দিকে। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যা কিছু আমরা খাই ভাত, মাছ, মাংস, সবজি, ফল সবকিছুতেই মিশে আছে ভেজাল ও বিষ। আমরা প্রতিদিন অজান্তেই গ্রহণ করছি মৃত্যু-ডেকে-আনা রাসায়নিক। যে দুধ শিশুদের সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য হওয়ার কথা, সেটিতেও মেশানো হয় ডিটারজেন্ট ও ইউরিয়া। বাজারের ফল পাকানো হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইডে, মাছকে টাটকা রাখতে ব্যবহার হয় ফরমালিন, আর শাকসবজিতে থাকে অতিমাত্রায় কীটনাশক ও টেক্সটাইল ডাই।

কিছুদিন আগে একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া অনেক সবজিতেই কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ (pesticide residue) রয়েছে সহনীয় মাত্রার বহু গুণ বেশি। একটি নমুনায় পাওয়া গেছে ৭০০ পিপিবি (ppb), যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে অনুমোদিত সীমা মাত্র ১০ পিপিবি। অর্থাৎ, আমরা প্রতিদিন যে সবজি খাচ্ছি, তাতে অনুমোদিত সীমার চেয়ে প্রায় ৭০ গুণ বেশি বিষ গ্রহণ করছি। এভাবে বছরের পর বছর ধরে এই রাসায়নিক পদার্থগুলো শরীরে জমে থেকে ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত করছে আমাদের হার্ট, লিভার, কিডনি ও মস্তিষ্ক। একসময় এই ক্ষতি ভয়াবহ রূপ নিয়ে দেখা দেয় যুবক বয়সেই স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক বা ক্যান্সারে মৃত্যু ঘটে।

এক সময় মনে করা হতো, এসব সমস্যা কেবল বয়সী মানুষদের। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অফিসপাড়ার তরুণ, এমনকি কিশোর বয়সীরাও হার্ট অ্যাটাকে মারা যাচ্ছে। ডাক্তারদের মতে, খাবারের বিষাক্ত উপাদানগুলো শুধু শারীরিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নষ্ট করে না, এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে। বিষাক্ত রাসায়নিক মস্তিষ্কের নিউরোট্রান্সমিটার ব্যাহত করে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, এবং ঘুমের সমস্যা সৃষ্টি করে। ফলাফল অসুস্থ দেহ ও বিপর্যস্ত মন নিয়ে বড় হচ্ছে এক পুরো প্রজন্ম।

অথচ এই সমস্যার কোনো কার্যকর সমাধান এখনো দেখা যায় না। মাঝে মাঝে প্রশাসনের অভিযানে কিছু পচা খাদ্য ধ্বংস হয়, কয়েকজন ব্যবসায়ীকে জরিমানা করা হয়, তারপর সব আগের মতো চলতে থাকে। দেশের কোটি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা একটি ‘মিডিয়া ইভেন্ট’-এ সীমাবদ্ধ থেকে যায়। এই ব্যর্থতার দায় শুধু সরকারের নয়, পুরো সমাজের।

আমরা এমন এক সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে সততা নয়, প্রতারণা সফলতার মাপকাঠি। ব্যবসায়ী জানে সে ভেজাল মেশাচ্ছে, তবুও করে, কারণ জানে কেউ তাকে জবাবদিহি করতে আসবে না। ভোক্তাও জানে খাবারে বিষ আছে, তবুও চুপ করে খায়, কারণ বিকল্প নেই। প্রশাসনও জানে, কোথায় ভেজাল হচ্ছে, কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব, ঘুষ, আর স্বার্থের জাল ছড়িয়ে আছে। এক কথায় এ এক সম্মিলিত নীরবতার সংস্কৃতি।এই নীরবতা শুধু অপরাধীদের উৎসাহিত করে না, এটি ধীরে ধীরে জাতির নৈতিক ভিত্তিও ধ্বংস করে দেয়। যখন একটি জাতির মানুষ বুঝতে শেখে যে টিকে থাকতে হলে প্রতারণা করতে হয়, তখন সেই জাতি আর সভ্য সমাজ বলে পরিচিত থাকতে পারে না। আজকের তরুণরা এই ভাঙা সমাজেই বড় হচ্ছে যেখানে ভেজাল শুধু খাবারে নয়, নীতিতেও, চিন্তাতেও, সম্পর্কেও।আমরা এমন এক অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নেমেছি, যেখানে সবাই অন্যকে পেছনে ফেলার জন্য দৌড়াচ্ছে যে দৌড়ে সততা, মানবতা, আর দায়িত্ববোধ হারিয়ে গেছে। আমরা চাই দ্রুত ধনী হতে, বড় হতে, প্রভাবশালী হতে। কিন্তু ভুলে যাই, এই ‘দ্রুততার’ সংস্কৃতি আমাদের মনুষ্যত্বকে গ্রাস করছে।

যখন তরুণ প্রজন্ম এভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে, তখন জরুরি ছিল গভীর গবেষণা ও জনস্বাস্থ্যভিত্তিক পদক্ষেপ। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা ঠিক উল্টো। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় খাদ্যনিরাপত্তা বা টক্সিকোলজি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা নেই। সরকারি পর্যায়েও নেই শক্তিশালী কোনো খাদ্য পরীক্ষা ও মনিটরিং ব্যবস্থা।খাদ্য পরিদর্শন ল্যাব থাকলেও সেখানে আধুনিক যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষিত জনবল ও নিরপেক্ষতার অভাব প্রকট।

একটি জাতির ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠে তার তরুণ প্রজন্মের সুস্থতা ও শক্তিমত্তার ওপর। অথচ আমরা যেন নিজেদের হাতেই আগামী প্রজন্মকে ধীরে ধীরে হত্যা করছি—ফরমালিনে, কার্বাইডে, নকল প্যাকেটজাত খাবারে, আর বিষাক্ত পানিতে। এই অবস্থায়ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নীরবতা এবং সমাজের উদাসীনতা আমাদের মানবিকতার ব্যর্থতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এখন সময় এসেছে এই নীরবতা ভাঙার। আমরা যদি চাই, পরবর্তী প্রজন্ম সুস্থভাবে বাঁচুক, তাহলে তিনটি ক্ষেত্রে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে—

১. জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ:ফরমালিন, কার্বাইড, কীটনাশক ও ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার ও বিক্রির বিরুদ্ধে কঠোরতম আইন প্রয়োগ করতে হবে। শুধু আইন করলেই চলবে না, তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আদালতের মাধ্যমে দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে তবেই ভয় সৃষ্টি হবে। খাদ্যে ভেজালকে ‘অপরাধ’ নয়, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর পর্যায়ে বিবেচনা করা উচিত, কারণ এটি জাতিকে ধ্বংস করছে।

২. খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণায় বিনিয়োগ: সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণায় বড় পরিসরে অর্থায়ন জরুরি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে আধুনিক টেস্ট ল্যাব স্থাপন করতে হবে, যাতে নিয়মিতভাবে খাদ্যের মান যাচাই করা যায়। স্থানীয় প্রশাসনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রতিটি জেলার বাজার মনিটরিং জোরদার করা উচিত।

৩. নৈতিকতা ও নাগরিক সচেতনতা: আইনের প্রয়োগ যতই কঠোর হোক, নৈতিকতার জাগরণ ছাড়া সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। ব্যবসায়ী, উৎপাদক, পরিবেশক, এমনকি ভোক্তাদের মধ্যেও নৈতিক চেতনা ফিরিয়ে আনতে হবে। স্কুল-কলেজের শিক্ষাক্রমে ‘খাদ্য নিরাপত্তা ও নৈতিক ব্যবসা’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরে সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরি না হলে আমরা বারবার একই জায়গায় ফিরে যাব।

আমরা এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যখন মৃত্যুর বয়স বদলে যাচ্ছে। এক সময় সন্তান পিতামাতার জন্য শোক করত; এখন সন্তানকে হারিয়ে পিতামাতা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তবতা কেবল পরিসংখ্যান নয়, এটি একেকটি পরিবার, একেকটি স্বপ্নের মৃত্যু।এই অকাল মৃত্যুগুলো আমাদের শুধু কাঁদাচ্ছে না, আমাদের চেতনাকেও নাড়া দিচ্ছে—আমরা কি এই প্রজন্মকে ধ্বংস হতে দেব? আমরা কি চুপচাপ বসে থাকব, যখন বিষ মিশে যাচ্ছে প্রতিটি গ্রাসে?

সময় এসেছে জেগে ওঠার, নড়েচড়ে বসার। ভেজালের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা শুধু সরকারের নয় এটি প্রতিটি নাগরিকের নৈতিক দায়িত্ব। দোকানদার, কৃষক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, সাংবাদিক সবাইকে যুক্ত হতে হবে এই সংগ্রামে।

তরুণদের অকাল মৃত্যু কোনো ব্যক্তিগত ক্ষতি নয়, এটি একটি জাতির ভবিষ্যতের ক্ষতি। সুস্থ তরুণই একটি জাতির শক্তি; অসুস্থ তরুণ মানে দুর্বল রাষ্ট্র। তাই এখনই সময়, পরবর্তী প্রজন্মকে সুস্থভাবে বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার। আর কোনো যুবক যেন ভেজালের বিষে অকালে ঝরে না যায়।এই নীরব মহামারি আর চলতে পারে না।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি

তরুণদের অকাল মৃত্যু মুক্তমত সাদিয়া সুলতানা রিমি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর