গাজা উপত্যকা আজ এক ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ইসরায়েলের অব্যাহত বর্বর হামলায় হাজারো নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদসহ অসংখ্য স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। এই সহিংসতার পেছনে দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাস রয়েছে, যা ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য এক দীর্ঘমেয়াদী দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
গাজার এই সংকট কোনো নতুন ঘটনা নয়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফিলিস্তিনিদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের সময় থেকেই ইহুদিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়, এবং ধাপে ধাপে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করা হয়। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর থেকে গাজা ও পশ্চিম তীর ইসরায়েলের দখলে চলে যায়। এরপর থেকেই গাজাকে একপ্রকার উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। অর্থনৈতিক অবরোধ, পানি ও বিদ্যুৎ সংকট, মানবিক সহায়তার উপর বিধিনিষেধ ইত্যাদির মাধ্যমে ফিলিস্তিনি জনগণের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়সময় গাজার বর্বরতার দৃশ্য দেখা যায়। ভিডিওতে যা দেখা যাচ্ছে তার চাইতে শতগুণ মারাত্বক পরিস্থিতি গাজায় বিদ্যমান। অথচ এই অবস্থা থেকে উত্তরণে বিশ্বমহলের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। তারা শুধু মুখেই বলে যাচ্ছে এটা অন্যায়, এটা অপরাধ।
তবে এই যুদ্ধ বন্ধে সবচেয়ে বড় বাধা এখন যুক্তরাষ্ট্র। এটা স্পষ্ট যে তারাই এই যুদ্ধের মূল সহযোগী। কয়দিন আগে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে ১৪টি গাজায় যুদ্ধ বিরতির পক্ষে ভোট দিলেও যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মত ভেটো দিয়ে মূলত গাজায় ইসরায়েলি নৃশংসতাকে উস্কে দিয়েছে বলে মনে করেন বিশ্ব সম্প্রদায়। গাজায় দিনের পর দিন বিমান হামলা করে, বোমা মেরে, ট্যাংক দিয়ে যখন গত দুই বছরে প্রায় ৬৫ হাজার গাজা অধিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করছে, গাজার সমস্ত স্থাপনা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করছে, হাসপাতাল, স্কুল ও মসজিদকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে, এমনকি পানি ও খাবারের অভাবে যখন হাজার হাজার শিশু, নারী ও বৃদ্ধ মৃত্যুর কোলে ঢুলে পড়ছে। জাতিসংঘ যখন গাজাকে দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে তখনও ইসরায়েলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এমন আটঘাটে বাকরুদ্ধ বিশ্ব বিবেক। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ধ্বজাধারী আমেরিকার এমন ভূমিকায় ক্ষুব্ধ বিশ্ব সম্প্রদায়।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে এ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলে মন্তব্য করছেন বিশ্লেষকরা। গত ২১ সেপ্টেম্বর একসাথে এ সিদ্ধান্তের কথা প্রকাশ করেন দেশ তিনটি। এর আগে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকাসহ প্রায় শতাধিক দেশ স্বাধীন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় মনে করছেন, গাজার চরম মানবিক বিপর্যয়ের সময় যুক্তরাজ্য, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার এমন সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
উল্লেখ্য যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের আকস্মিক হামলার পর ইসরায়েলি সেনারা গাজায় ভয়াবহ অভিযান শুরু করে। ওই হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, তখন থেকে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ৬৪ হাজার ৯৬৪ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। বর্তমানে জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ ফিলিস্তিনকে ইতোমধ্যেই স্বীকৃতি দিয়েছে। গত বছর স্পেন, আয়ারল্যান্ড ও নরওয়ে এই স্বীকৃতি দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে পর্তুগাল, ফ্রান্স, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াও একই পথে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই যুদ্ধ কীভাবে শেষ হতে পারে, তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ রয়েছে। একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কঠোর হস্তক্ষেপ। জাতিসংঘ, ওআইসি, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্ব মোড়লরা যদি ইসরায়েলের ওপর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, তাহলে হয়তো তারা তাদের আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য হবে। এছাড়া, ফিলিস্তিনকে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া এবং শান্তি আলোচনার মাধ্যমে একটি স্থায়ী সমাধানের পথ বের করা প্রয়োজন। যা ইতোমধ্যে অনেখানি এগিয়েছে।
পরিশেষে বলতে চাই, গাজায় চলমান এই গণহত্যা ও দখলদারিত্বের অবসান হওয়া জরুরি। এটি শুধু ফিলিস্তিনের সমস্যা নয়, বরং এটি মানবতার সংকট। বিশ্ববাসী যদি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনো পথ নেই। মুসলিম বিশ্ব ও সমগ্র মানবজাতিকে এখনই ফিলিস্তিনের পক্ষে রুখে দাঁড়াতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট