Sunday 12 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাইড বেঞ্চে মেধার অপচয়

রিয়াজুল হক
১২ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:২৯

বাংলাদেশ ফুটবলের বর্তমান অবস্থাকে যদি একটি বাক্যে সংক্ষেপে বলতে হয়, তাহলে বলা যায়— সম্ভাবনা আছে, পরিকল্পনা নেই। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যখন ছোট ছোট দেশগুলোও ফুটবলে নিজেদের অবস্থান তৈরি করছে, তখন আমরা এখনো ঘুরপাক খাচ্ছি দলে কাকে রাখব, কাকে বসিয়ে রাখব—এই অদ্ভুত বিতর্কে। গত ৯.১০.২০২৫ তারিখ হংকং ম্যাচে ৪–৩ গোলে পরাজয়ের পর আবারও সেই পুরোনো প্রশ্ন জেগেছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি খেলোয়াড়দের আমরা কি সত্যিই যথাযথভাবে ব্যবহার করছি?

জাতীয় দলে যুক্ত হয়েছে ইউরোপ, পাশ্চাত্যে বেড়ে ওঠা কয়েকজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়। তাদের ফুটবল শিক্ষার ভিত্তি তৈরি হয়েছে ইংল্যান্ড, কানাডা, ইতালি, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডের বা আমেরিকার মতো উন্নত ফুটবল সংস্কৃতির দেশে। এই খেলোয়াড়দের শারীরিক গঠন, ম্যাচ রিডিং ও পাসিং টেকনিক আমাদের ঘরোয়া খেলোয়াড়দের তুলনায় অনেক উন্নত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এই খেলোয়াড়দের বেশিরভাগকেই মূল একাদশে না রেখে সাইডলাইনে বসিয়ে রাখা হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

হংকং ম্যাচে আমরা সেটার মূল্য পেয়েছি। দলটা তখনই গতি পেয়েছে, যখন বিদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের মাঠে উপস্থিতি বেশি ছিল। কিন্তু তাদের দেরিতে নামানোর কৌশলই ম্যাচের গতি ভেঙে দিয়েছে। কোচিং স্টাফ বা নির্বাচকদের এই মনোভাবের ফলে দল একদিকে অভ্যন্তরীণ মনোবল হারাচ্ছে, অন্যদিকে মাঠে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকরী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না। দেশও বিজয়ের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ শ্রীলঙ্কা অতি সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপে বেড়ে ওঠা শ্রীলঙ্কান বংশোদ্ভূত ফুটবলারদের দলে নিয়ে সাফল্যের মুখ দেখেছে। তাদের মূল একাদশে প্রায় সব খেলোয়াড়ই বিদেশি বংশোদ্ভূত। এই খেলোয়াড়রা শুধু মাঠে ফল এনে দিচ্ছে না, দেশীয় তরুণদের অনুপ্রেরণাও জোগাচ্ছে। একইভাবে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইনও এখন এই ধারা অনুসরণ করছে। বিদেশে বেড়ে ওঠা খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতা ও পেশাদার মানসিকতাকে কাজে লাগাচ্ছে।

বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্র। আমাদের বহুল কথিত ‘সিন্ডিকেট’ নিয়ন্ত্রিত ফুটবলে এখনো ‘কে কোন ক্লাবের খেলোয়াড়’ বা ‘কাকে কে সুপারিশ করেছে’ এই প্রশ্নই মূল সিদ্ধান্ত নির্ধারণ করে। ফলে যোগ্যতা নয়, ‘প্রভাব’ হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচনের মানদণ্ড।

ফুটবল কেবল শারীরিক খেলা নয়। এটি কৌশল, মনোভাব ও নেতৃত্বের খেলা। ইউরোপ, আমেরিকায় প্রশিক্ষিত ফুটবলারদের মানসিক দৃঢ়তা, ডিসিপ্লিন এবং খেলার মধ্যে স্ট্রাকচার রাখার সক্ষমতা আমাদের শেখার মতো। কিন্তু তাদের যদি বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়, তাহলে সেই অভিজ্ঞতার ফল আমরা কখনোই মাঠে পাবো না ।

বাংলাদেশের ফুটবল দীর্ঘদিন ধরে ‘সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত এক অদৃশ্য দৌরাত্ম্যের মধ্যে আটকে আছে। কে কোন ক্লাবের, কে কার ঘনিষ্ঠ—এই অদ্ভুত সম্পর্কের জালে অনেক মেধাবী খেলোয়াড় হারিয়ে গেছে। কোচ পরিবর্তন হয়, কিন্তু মানসিকতা পরিবর্তন হয় না। ফলাফলও তাই একই থেকে যায়।সুতরাং এই সিন্ডিকেট ভাঙা ছাড়া কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়। জাতীয় দলে নির্বাচনের ক্ষেত্রে ক্লাব লবিং বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিবর্তে পারফরম্যান্স ও পেশাদার দক্ষতাকেই মাপকাঠি বিবেচনা করতে হবে।

এখনই সময় সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখনই সময়। ফুটবলের আধুনিক কৌশল অনুযায়ী, বাংলাদেশ জাতীয় দলের মূল একাদশে যোগ্যতা অনুযায়ী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিদেশি খেলোয়াড়দের মূল একাদশে রাখা উচিত। এর কয়েকটি যৌক্তিক কারণ হলো— তারা ইউরোপীয়, আমেরিকাসহ অন্যান্য পেশাদার লিগের শৃঙ্খলা, পুষ্টি, ফিটনেস ও মনোভাবের শিক্ষা পেয়েছে। তাদের পাসিং, পজিশনিং, ও ফিনিশিং স্কিল উন্নত। মাঠে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তে তারা ঠান্ডা মাথায় কৌশল তৈরি করতে পারে। তাদের উপস্থিতি তরুণদের মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করবে, যা সামগ্রিকভাবে পারফরম্যান্স উন্নত করবে।

হংকং ম্যাচ আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমরা এখনো নিজেদের সীমাবদ্ধতার মধ্যে বন্দী। যদি এই মানসিকতার পরিবর্তন না আসে, তাহলে আগামী বিশ বছরেও ফুটবলে আমরা কোনো বড় সাফল্য দেখতে পাবো না।

বাংলাদেশে ফুটবলপ্রেমী মানুষের অভাব নেই। গ্যালারি ভর্তি দর্শক, মাঠে-রাস্তায় প্রাণবন্ত ফুটবল খেলা ফুটবলের প্রতি আমাদের অফুরান ভালোবাসার প্রমাণ। কিন্তু সেই ভালোবাসা ফলপ্রসূ হয় না, কারণ মাঠের সিদ্ধান্তগুলো কৌশলগতভাবে দুর্বল। যদি আমরা সত্যিই আন্তর্জাতিক ফুটবলে নিজেদের স্থান তৈরি করতে চাই, তাহলে এখনই বিদেশি বংশোদ্ভূত খেলোয়াড়দের যোগ্যতা অনুযায়ী মূল একাদশে খেলার সুযোগ দিতে হবে। এবং খেলোয়াড় নির্বাচনের ক্ষেত্রে সকল বহুল কথিত সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।

লেখক: যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক

সারাবাংলা/ইউজে/এএসজি

বাংলাদেশ ফুটবল মুক্তমত রিয়াজুল হক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর