আমাদের দেশে নিরাপদ খাদ্য পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। কোনটা যে নিরাপদ আর কোনটা ভেজাল তা নিরুপণ করা যায় না। হয়তো যে খাদ্যটিকে সুস্বাদু ভেবে তৃপ্তি করে খাচ্ছেন কাল দেখবেন সেই খাদ্যই চরম ভেজাল বা অস্বাস্থ্যকর। আমরা প্রাপ্ত বয়স্করা যা খাচ্ছি সে এক কথা। আর শিশুরা কি খাচ্ছে বা তাদের খাদ্য কতটা নিরাপদ সে খোঁজ তো কেউ রাখছি না। হাতের কাছে যা পাচ্ছি কিনে দিচ্ছি। আমরা যা দিচ্ছি সেটার থেকে ওরা নিজেরা যা কিনে খাচ্ছে সেটি বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ ওরা জানে না কোন খাদ্য নিরাপদ আর কোন খাদ্য অনিরাপদ। চকচকে মোড়কে আকর্ষণীয় খাবার দেখেই ওরা কিনে থাকে। উৎপাদনকারী এবং বিক্রেতারাও এই সুযোগ নেয়। ঠিক শিশুদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে সেভাবেই মুখরোচক খাদ্য তৈরি করে। ফলে দেদারছে বিক্রি। মুখের স্বাদের যেটি ভালো লাগে সেটিই কিনছে। কোনো টং দোকানে গেলেই আপনি দেখবেন এমন কিছু খাদ্য যা স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত অথচ সেসব কে অনুমোদন করছে তার ঠিক নেই। দুঃখজনক হলো, সেসব খাবারই আমাদের সন্তানরা বেশি কিনে খাচ্ছে। কারণ দামে সস্তা। সেসব খাবারের অনেকগুলোরই কোনো অনুমোদন নেই। বিশেষত আশেপাশের দোকান থেকে এক টাকা, দুই টাকা বা পাঁচ টাকা দিয়ে যা কিনে খাচ্ছে আমরা কি লক্ষ্য করেছি সেসব কি দিয়ে তৈরি? কিভাবে এসব খাবার শিশুদের পর্যন্ত পৌছায় সেও এক রহস্য।
কারণ কোনো উন্নত বিশ্বেই অনিরাপদ খাদ্য শিশুর হাতে তুলে দেওয়া হয় না। নানা পরীক্ষা নীরিক্ষার পর দোকানে পৌছে শিশু খাদ্য। আবার খুব ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্য গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলেন অভিভাবকরা। আমাদের এই দুটোর বিষয়ের কোনোটাই নেই। আমরা সেক্ষেত্রে ভিন্ন। কারণ আমাদের সেসব নজরদারির কেউ নেই। এমনকি অভিভাবকও নেই। মাত্র এক টাকা দিয়ে কোনো পণ্য এ দেশে পাওয়া যায়, ভাবা যায়? কি আছে সেসব খাদ্যে? আমার, আপনার সন্তান এসব কিনে খাচ্ছে। ওদের শরীরে আমাদের স্বচোখে বিষ ঢুকছে, আমরা দেখছি অথচ নির্বিকার। সবাই নির্বিকার। ওরা এসব বিষ নিয়েই বড় হচ্ছে। যদিও সকালে স্কুলে যাওয়ার পর অধিকাংশ অভিভাবকই জানেন না তাদের সন্তান কি কিনে খাচ্ছে। অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীর হাতেই টাকা থাকে স্কুলে কিছু কিনে খাওয়ার জন্য। কিন্তু কি খাচ্ছে সেই নিয়ন্ত্রণ থাকে না অথবা থাকা সম্ভবও না। সেই সুযোগ নেয় অসাধু খাদ্য প্রস্তুতকারীরা। গ্রামের দোকানে গেলেই আপনি পাবেন এক টাকা, দুই টাকার প্লাষ্টিকের প্যাকেটে আইসক্রিম, পাবেন বিভিন্ন স্বাদের পানি। এছাড়া তেঁতুল বা চাটনি বা পলিথিনে মোড়ানো খাদ্য। এসব যে স্বাস্থ্যসম্মত তার প্রমাণ নেই।
মাঠ পর্যায়ে এসব দেখভাল কেউ করছে না। কয়েকটি মৌলিক এবং প্রতিদিনের অতি জরুরি পণ্যের মধ্যে প্রধান হলো খাদ্য। অসাধু ব্যবসায়ীরা পণ্যে ভেজাল দিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। এসব ব্যবসায়ী বা পণ্য প্রস্তুতকারীর কাছে এটা ব্যবসা। তাদের নিজেদেরও সন্তান আছেন। আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি তাদের সন্তানদের এসব খেতে দেন না। কারণ তারা নিজেরাও জানেন এটা সঠিক খাদ্য নয়। খাদ্যে ভেজাল আমাদের এই দুর্ভোগ বছরের পর বছর জুড়ে চলে আসছে। একজন ব্যবসায়ী আমাদের কাছে নিরাপদ খাদ্যপণ্য সরবরাহ করবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এই স্বাভাবিক বিষয় এতটা অস্বাভাবিক হয়েছে যে আজকাল খাদ্য কিনে বিশ^াসই হয় না যে এতে কোনো ভেজাল নেই। আমাদের চোখের অলক্ষ্যে যে খাদ্য তৈরি হচ্ছে সেগুলোতে মাঝে মধ্যেই লোভী মানুষের যে ভয়ংকর কারসাজি দেখতে পাই তাতে বিশ^াস করাও যায় না। এমন কোনো খাদ্য হয়তো আজ খুঁজে পাওয়া যাবে না যে সেখানে কিছু লোভী মানুষ তাদের কারসাজি করছে না। নিরাপদ খাদ্য পাওয়াটা আজ আমাদের জন্য সত্যি খুব দরকার হলেও তা চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। একমাত্র বাড়িতে যখন কোনো কিছু তৈরি করে খাওয়া হচ্ছে অথবা ছাদে নিজের উৎপাদিত সবজি খেতে পারছি সেটাই যা একটু নিশ্চয়তা দেয়। বাকি সব খাদ্যেই সন্দেহ থাকছে। কোন খাদ্য নিরাপদ আর কোন খাদ্য ভেজাল দেওয়া তা চেনার উপায় নেই। আমরা তা পারিও না। আবার অনেকটা মেনেও নিয়েছি। আমরা জানি আমার সন্তান কি খাচ্ছে কিন্তু আমরা এতটাই অসহায় যে জানার পরেও কিছু বলার থাকছে না। কারণ সবাই তো তাই খাচ্ছে। তাহলে আমারই বা অসুবিধা কেন? খাদ্যে ভেজালকারীদের ভিতর যারা শিশু খাদ্য অনিরাপদ তৈরি করছেন তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে প্রথম কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। এরা নিজেদের এত নিচে নামিয়ে এনেছে যে ভবিষ্যত প্রজন্মের শরীর বিষাক্ত করে তুলেছে।
অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাদের সন্তানরা স্কুলে পৌছে তাদের দেওয়া টাকা দিয়ে কি কিনে খাচ্ছে সেটি নজরদারি করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে এবং কি খাওয়া উচিত সেটি অভ্যাস করাতে হবে। প্রয়োজনে শাসন করতে হবে।
লেখক: কলামিষ্ট