Thursday 16 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গার্মেন্টস শ্রমিকের মৃত্যু কেন কেবলই সংখ্যা?

সাদিয়া সুলতানা রিমি
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:২১

বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি আয়ের উৎস পোশাক শিল্প। আর এই বিশাল অর্থনীতির মূল কারিগর হলেন প্রায় ৪০ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিক, যাদের অধিকাংশই নারী। যাদের রক্ত-ঘাম ঝরানো শ্রমে দেশের জিডিপি সমৃদ্ধ হচ্ছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বহু অঙ্গন চলছে নামমাত্র খরচে, তাদের জীবন কেন আজও সমাজের চোখে শুধু একটি ‘সংখ্যা’ হয়ে রইল? বারবার আগুন লাগা, ভবন ধসে পড়া এবং কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতার মর্মান্তিক ঘটনাগুলো আমাদের সমাজের গভীরতম অকৃতজ্ঞতা ও নিস্পৃহতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন এবং কর্মসংস্থান দেশের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার ভিত্তি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের এই খ্যাতি অর্জনের পেছনে রয়েছে শ্রমিকদের ‘পানির দামে’ বিক্রি করা শ্রম। আন্তর্জাতিক গবেষণা থেকে দেখা যায়, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি বিশ্বের অন্য প্রধান পোশাক উৎপাদনকারী দেশগুলোর তুলনায় সর্বনিম্ন পর্যায়ে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ন্যূনতম মজুরিতে একটি সুস্থ জীবন যাপন করা যেখানে অসম্ভব, সেখানে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতা চরম অকৃতজ্ঞতার নামান্তর।
বিশাল অট্টালিকা গড়ার শ্রমিক, যিনি রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা এনে দেন, সেই তিনিই যখন জীর্ণ বস্তিতে থাকেন, যখন তার সন্তানকে স্কুল ছাড়াতে হয়— তখনই প্রশ্ন ওঠে: রাষ্ট্র তার এই সন্তানদের জন্য কী করেছে?

বিজ্ঞাপন

গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে দুর্ঘটনা যেন এক নিয়তি। ২০১২ সালের তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন, যাতে শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু হয়, কিংবা ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস, যা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত এই ট্র্যাজেডিগুলো কেবল ভবন বা আগুনের ঘটনা নয়, বরং রাষ্ট্রের কাঠামোগত দুর্বলতা ও চরম অবহেলার প্রতীক। রানা প্লাজায় ১,১৩৫ জন শ্রমিক নিহত ও আড়াই হাজারেরও বেশি আহত হয়েছিলেন, যাদের অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন। ভবন ধসের আগে ফাটল দেখা গেলেও শ্রমিকদের জোর করে কাজে ফিরতে বাধ্য করা হয়েছিল।

এই শ্রমিকেরা যখন পুড়ে মারা যান বা চাপা পড়ে দম বন্ধ হয়ে মারা যান, তখন প্রথম কয়েকদিন দেশের মিডিয়া ও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা হয়, শোক জানানো হয়। কিন্তু কিছুদিন পরেই সেই শোকের ঢেউ থিতিয়ে আসে, শ্রমিকদের জীবনের মূল্য কেবল একটি খতিয়ান বা মামলার ফাইলে বন্দি হয়ে যায়। আমরা যারা এই শ্রমের সুফল ভোগ করি, তারা দ্রুতই ভুলে যাই সেই রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। তাদের এই ‘অর্থহীন’ হয়ে যাওয়া মৃত্যু প্রমাণ করে, রাষ্ট্রের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে শ্রমিকের জীবন নিতান্তই তুচ্ছ।

নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম মজুরি প্রদান করা, এবং দুর্ঘটনার পর দ্রুত ও ন্যায্য ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা এসবই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও নৈতিক দায়িত্ব। শ্রম আইন, ২০০৬ এবং ইপিজেড শ্রম আইন, ২০১৯-এ শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার প্রয়োগ কতোটা?
যখন বারবার একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে, যখন মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের রাজপথে নেমে আন্দোলন করতে হয়, যখন শ্রমিকের জীবনের বিনিময়ে গড়া প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগে আর তার বিচার হয় না তখনই রাষ্ট্রের এই অকৃতজ্ঞতার হিসাব চাইতে হয়: নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সক্রিয়তা কতটুকু? শত শত কোটি টাকা ঋণের সুবিধা দেওয়া হলেও সেই টাকা দিয়ে ফ্যাক্টরির অবকাঠামো এবং অগ্নি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় কি না, তা কেন বারবার উপেক্ষিত থাকে? শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি কেন জীবনধারণের ব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয় না? তাদের শ্রমে যদি দেশের অর্থনীতি চলে, তবে কেন তারা অনাহারে, অর্ধাহারে থাকবে? রানা প্লাজা বা তাজরীন ট্র্যাজেডির জন্য দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে এত দীর্ঘসূত্রিতা কেন? বিচারের দীর্ঘ অপেক্ষায় শ্রমিক পরিবারের অশ্রু আর হাহাকার কি রাষ্ট্রের অকৃতজ্ঞতার চিহ্ন নয়?

এই অকৃতজ্ঞতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গার্মেন্টস শ্রমিককে কেবল ‘শ্রমিক’ হিসেবে না দেখে, রাষ্ট্রের ‘মেরুদণ্ড’ হিসেবে দেখতে হবে। তাদের জীবনের মূল্য কেবল ডলারের অঙ্কে নয়, মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই পরিশোধ করা সম্ভব। শ্রমিকের রক্ত-ঘামে অর্জিত এই রাষ্ট্রের কাছে তাদের জীবনের মূল্য আর কতকাল শুধু ‘সংখ্যা’ হয়ে থাকবে— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিক ও রাষ্ট্রযন্ত্রের নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণ সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

মোংলায় বিএনপির উঠান বৈঠক
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:১৮

ঢাকা মেডিকেলে ভুয়া চিকিৎসক আটক
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:০৪

আরো

সম্পর্কিত খবর