একটা উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই। ধরা যাক, এনটিআরসিএ’র (বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ) মাধ্যমে ঢাকা শহরের একটি এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন শিক্ষক নিয়োগ পেল। বিদ্যমান বেতন কাঠামোয় ‘বি.এড’বিহীন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক শুরুতে সরকার প্রদত্ত প্রাপ্ত বেতন সর্বসাকুল্যে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা(বিশেষ প্রণোদনাসহ) পাবেন (কল্যাণ ও অবসরের ১০% কর্তনের পর)। নিয়োগ কর্তৃপক্ষ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, দেশের শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও দেশের নীতিনির্ধারকসহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে প্রশ্ন করতে চাই- এই অতি স্বল্প বেতনে ঢাকা শহরে একজন শিক্ষকের পক্ষে পরিবার নিয়ে জীবন ধারণ করা কি আদৌ সম্ভব? সরকার প্রদত্ত ১০০০ টাকায় কী বাড়িভাড়া পাওয়া সম্ভব? পরিবার-পরিজন মিলে মাসিক ৫০০ টাকায় চিকিৎসার প্রয়োজন মেটানো সম্ভব কি? ঢাকা শহরের কথা বাদ দিলাম, জেলা শহর বা উপজেলা শহরে কিংবা গ্রামে এই ১৩ হাজার ৫০০ টাকায় কী পরিবার-পরিজন নিয়ে চলা সম্ভব? অনেকেই বলে থাকেন, শিক্ষকরা সরকার প্রদত্ত বেতন বাদে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেও কিছু অর্থ পান! কথাটা ঢালাওভাবে সত্য নয়। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংখ্যা ও আয়ের উপর ভিত্তি করে কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের সামান্য কিছু অর্থ প্রদান করে থাকে। বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের কোনো অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করে না। অনেককে বলতে শুনেছি, মাধ্যমিক শিক্ষকরা প্রাইভেট-কোচিং করে! বাস্তবতা হচ্ছে, ঢাকা শহরে নামিদামী কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক কোচিং-প্রাইভেটের কথা স্মরণ করে পুরো বাংলাদেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের এক কাতারে কল্পনা করা সমীচীন নয়। তাছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুটি কয়েকজন শিক্ষক কোচিং এর যুক্ত থাকলেও থাকতে পারে! ঢালাওভাবে সকল শিক্ষক কোচিং এর সাথে যুক্ত নয়। তাহলে একজন শিক্ষক এই সামান্য বেতনে সন্তানের লেখাপড়ার খরচসহ পুরো মাস চলবেন কীভাবে? আবার অনেককে বলতে শুনেছি, শিক্ষকরা তো বাড়িতে বসে চাকরি করে- তাহলে আবার বাড়িভাড়া কিসের? উল্লেখ্য, এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা অধিকাংশই নিজ উপজেলা, জেলা ও বিভাগের বাইরে নিয়োগ পেয়েছেন। তাছাড়া সকল চাকরিতে বাড়িভাড়া রয়েছে। এমনকি প্রাথমিক বিধ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজ উপজেলায় চাকরি করলেও বিধি মোতাবেক বাড়ি ভাড়া পেয়ে থাকেন। অন্য সব পেশায় শতাংশ হারে বাড়িভাড়া পেলে শিক্ষকরা পাবেন না কেন?
মোটাদাগে বলা যায়, যুগের পর যুগ ধরে মাধ্যমিক শিক্ষাকে অবহেলিত করে রাখা হয়েছে। যেখানে দেশের ৯৫ ভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেসরকারি তথা মাধ্যমিক পর্যায়ে ৯৫ ভাগ শিক্ষার্থী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে তাহলে মাধ্যমিক শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে তামাশা করার সুযোগ আছে কী? এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক থেকে শুরু করে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পর্যন্ত প্রত্যেকে ১০০০ টাকা করে বাড়ি ভাড়া পান। যেখানে প্রধান শিক্ষক ও কর্মচারীদের বেতন কাঠামো সবার আলাদা আলাদা সেখানে বাড়িভাড়া কীভাবে সমান হতে পারে? তাছাড়া শহরে ও গ্রামে কীভাবে বাড়িভাড়া সমান হতে পারে? সরকারিসহ অন্যান্য চাকুরিতে শহরে-গ্রামের বাড়ি ভাড়ার পার্থক্য রয়েছে। তাহলে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যার যার মূল বেতনের শতাংশ হারে ও শহর-গ্রাম বিবেচনায় কেন বাড়িভাড়া পাবে না? শিক্ষকদের যৌক্তিক আন্দোলনের মুখে ন্যূনতম চলার মতো বেতন-ভাতা সমন্বয় করার কথা যখন আসে তখন সরকার থেকে প্রতিবার আর্থিক সক্ষমতার কথা বলা হয়। কিন্তু দেশের সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাপনা দেখে কখনোই মনে হয় না যে, শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন-ভাতা দেওয়ার মতো সক্ষমতা সরকারের নেই! জনগণের করের টাকার যখন হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও অপচয়ের কাহিনী জনসম্মুখে আসে তখন ‘আর্থিক সক্ষমতা’র মতো শব্দ পরিহাসের মতো লাগে।
যে জাতি শিক্ষককে চলার মতো বেতন-ভাতা দিতে পারে না, সে জাতি ভালো শিক্ষাও আশা করতে পারে না। পেশায় আর্থিক নিরাপত্তা না থাকলে মাথায় পরিবার চালানোর টেনশন ও পেটে ক্ষুধা নিয়ে পাঠদান করা কী সম্ভব? অতি দুঃখের সাথে বলতে হয়, ২০২৪ সালে তৈরি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন কাঠামোয় চাকরির শুরুতে ১২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাহলে একজন অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারী শিক্ষক কেন পোশাক শ্রমিকের সমতুল্য বেতন পাবে? তাছাড়া একজন পোশাক শ্রমিক অতিরিক্ত উিউটি মিলে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করছেন। সেখানে একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকের বেতন কেন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা হবে?
বেশ জোরেশোরে সবার মুখে বলতে শোনা যায়- শিক্ষকতা মহান পেশা, শিক্ষা জাতির মেরুদ-। আচ্ছা, মহান পেশার বেতন ১৩ হাজার ৫০০ টাকা কেন? মহান পেশার বাড়ি ভাড়া কেন ১০০০ টাকা? মহান পেশার চিকিৎসা ভাতা কেন অন্য সব পেশার চেয়ে কম (৫০০ টাকা)? যেসব পেশায় বেতন ৩০, ৪০ কিংবা ৫০ হাজার টাকার উপরে তাহলে তাদের পেশাকে কী ধরনের পেশা বলা যেতে পারে? শিক্ষকতা মহান পেশায় যদি হবে তাহলে অন্যসব কমিশন হলেও ‘শিক্ষা কমিশন’ কেন করা হলো না? মহান পেশায় কেন শিক্ষককে পরিবার চালাতে ঋণ করে চলতে হয়? যে শিক্ষকদের সংসার চলে না, ধার করে সংসার চালাতে হয়, সেখানে শিক্ষকের মেরুদ- থাকে কীভাবে? যেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকের আর্থিক মেরুদ- নেই সেখানে শিক্ষার মেরুদ- কী সোজা থাকতে পারে? একথা ভুলে গেলে চলবে না, শিক্ষক না বাঁচলে শিক্ষা বাঁচবে না। ‘শিক্ষা জাতির মেরুদ-’ হয়ে উঠবে তখন যখন শিক্ষক বাঁচার মতো অর্থ পাবে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরে বাড়িভাড়া, চিকিৎসাভাতা ও শতভাগ বোনাসের দাবি জানিয়ে আসছে। বিগত সরকারগুলোর আমলে এই যৌক্তিক দাবি সবসময় ছিল। সব সরকার শুধু আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের গুরুত্ব দেয়নি কেউ!
তাই আর আশ্বাসে বিশ্বাস করতে রাজি নয় চার লাখ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। শিক্ষকদের মূল বেতনের ২০% বাড়িভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা আর শতভাগ উৎসব ভাতা চাওয়া কী খুব বেশি? এই চলার মতো চাওয়া পূরণ করলে কী রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে যাবে? নাকি শিক্ষা ও শিক্ষকদের অবহেলিত রেখে শিক্ষাকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার পায়তারা চলছে! অতি সম্প্রতি এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষক-কর্মচারীদের মূল বেতনের ২০% বাড়িভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। কিন্তু সে আশ্বাসও রাখতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। গত ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবসে মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে পুরো শিক্ষক সমাজের সাথে তামাশার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। ক্ষুদ্ধ হয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ক্লাস বর্জন করে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে। তাই শিক্ষামন্ত্রণালয়সহ দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে দাবি, শিক্ষার মেরুদ- ঠিক রাখতে হলে শিক্ষক ও শিক্ষাকে গুরুত্ব দিন। বেতন-ভাতার বৈষম্য দূর করতে হবে সবার আগে। শিক্ষাখাত যদি অবহেলিত হয় আর শিক্ষকরা যদি দুর্দশাগ্রস্ত থাকে তাহলে সে জাতি মেরুদ- সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।
লেখক: শিক্ষক ও পরিবেশকর্মী