Thursday 16 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষক নিষ্পেষণ ও নির্যাতনের শেষ কোথায়?

কাজী মাসুদুর রহমান
১৬ অক্টোবর ২০২৫ ১৭:৪৮

শিক্ষক কথাটি মনে করতেই মনে পড়ে যায়, মুঘল বাদশা আলমগীরের শিক্ষক বন্দনার সেই কালজয়ী কাহিনী। কাহিনীর সারাংশে দেখা যায়, বাদশার নিজপুত্র কর্তৃক শিক্ষকের পায়ে পানি না ঢেলে দেয়ার কারণে বাদশা পরমব্যথিত হয়ে শিক্ষার্থী পুত্রের নৈতিক শিক্ষা ও দীক্ষা প্রদানের এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। ঘটনাটি জগতের সকল শিক্ষার্থীদের জন্য এক মননশীল তথা হৃদয়গ্রাহী শিক্ষা-দীক্ষা রূপে যুগে যুগে অনুস্মরনীয় হয়ে আসছে। তাইতো, কিংবদন্তী কবি- কাজী কাদের নেওয়াজ’র কালজয়ী কবিতা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’-তে তা এ ভাবেই অলংকৃত হয়েছে, ‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষা গুরুর শির/সত্যই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর।’

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য, পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষকের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মর্যাদা উচ্চতর এমনকি সর্বোচ্চ হলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ চিত্র সুখকর নয়। বিশেষ করে বেসরকারি এমপিও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এ চিত্র বেশ হতাশা জনক ও বেদনা দায়ক । দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দীর্ঘদিন হতে চলমান এ দুরবস্থা দূরীকরণে সরকার, রাজনীতিক, আমলা- কেউই আন্তরিক হয়নি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, এ পেশাটি রাষ্ট্রে অপাংক্তেয়।

প্রসঙ্গত: আমাদের মত এমন উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, দেশের উৎপাদনশীল শিক্ষার সবচেয়ে বৃহৎ ও গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো মাধ্যমিক। কেননা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় দেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে কর্ম জীবনে প্রবেশ করে। আবার উচ্চ শিক্ষাস্তরে প্রবেশের ক্ষেত্রেও এ স্তরটি ট্রানজিট স্তর হিসাবে শতভাগ গুরুত্ব বহন করে। অথচ এই স্তরের প্রায় ৯৭% শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই বেসরকারি যার শিক্ষক ও কর্মচারীর বেতন ভাতা মেটাতে হয় ‘অনুদানভিত্তিক’ মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার (এমপিও) এর মাধ্যমে যা ভাবতেও অবাক লাগে! আবার , তাদের বেতনভাতাও আর্থ- সামাজিক প্রেক্ষাপটে অপ্রতুল ও যথেষ্ট বৈষম্যপূর্ণ। বিশেষ করে চিকিৎসা ভাতা,ঘর ভাড়া ও উৎসব ভাতার মতো মৌলিক খাতে এই বৈষম্য খুবই প্রকট। যেমন: বর্তমানে তাদের চিকিৎসা ভাতা, ঘর ভাড়া ও উৎসব ভাতা দেওয়া হয় যথাক্রমে ৫০০ টাকা, ১০০০ টাকা ও মূল বেতনের শতকরা ৫০ ভাগ। অথচ সরকারি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানের( যার সংখ্যা মাত্র ৩-৪%) শিক্ষকদের এক্ষেত্রে চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ টাকা; ঘর ভাড়া মূল বেতনের ৪০% থেকে ৫০%( উপজেলা ও সিটি কর্পোরেশন ভিত্তিক ) যা কমপক্ষে ৮ হাজার টাকা এবং উৎসব ভাতা মূল বেতনের ১০০% দেওয়া হয়। একই শিক্ষাগত যোগ্যতায়, একই সিলেবাস ও পাঠ্যক্রমের আওতায় শিক্ষাদানরত শিক্ষকদের মাঝে এ হেন আর্থিক বৈষম্য খুবই অযৌক্তিক, অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য। তাছাড়া , ২০১৫ সাল হতে এনটিআরসি এর মাধ্যমে বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগ করা হচ্ছে যা পিএসসির চেয়েও কোন অংশে কম নয়। পিএসসির মতো তাদেরকেও প্রিলিমিনারি , লিখিত ও ভাইভা’র মাধ্যমে প্রখর মেধাভিত্তিক যাচাইয়ের মধ্য দিয়ে নিয়োগ করা হচ্ছে। তথ্যমতে, ২০২৪ সাল অবধি মোট ১,৩২,৮৯৮ জন শিক্ষক এ পদ্ধতির আলোকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ষষ্ঠ গণ বিজ্ঞপ্তি ২০২৫ এ মোট ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৯৮ টি শূন্য পদের বিপরীতে মোট ৪১ হাজার ৬২৭ জন যোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ দান প্রক্রিয়াধীন আছে। স্মর্তব্য, এর আগে সরকারি শিক্ষকদের ৫% বাৎসরিক ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হলেও এ থেকে এমপিও শিক্ষকদের দীর্ঘদিন বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এমনকি বৈশাখী ভাতা সরকারি সকলকে দেওয়া হলেও তাদেরকে এ সুবিধার বাইরে রাখা হয়েছিল। ফলে সামাজিকভাবে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে বেশ হীনমন্যভাবে বাস করত। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের পর তারা ২০১৮ সাল থেকে এই সুবিধার আওতায় আসেন। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, শিক্ষা যদি হয় জাতির মেরুদন্ড তবে শিক্ষক হলো সেই মেরুদন্ডের মজ্জা। নিশ্চয়ই পরিপুষ্ট মজ্জা ছাড়া মেরুদন্ড টেকসই হতে পারে না। এমন নিগুঢ় বাস্তবতায় শিক্ষকরা কেন রাষ্ট্রের কাছে এভাবে উপেক্ষিত ও অবহেলিত হতে থাকবে? বস্তুত: দেশের বৃহৎ এই পেশাজীবীদের(প্রায় ৫ লাখ) সামাজিক ও আর্থিক বঞ্চনায় রেখে এবং বৈষম্যের কোপানলে ফেলে কখনই জাতীয় শিক্ষা পরিপুষ্ট হতে পারে না। স্বয়ং রাষ্ট্রকেই এই বাস্তবতা উপলব্ধি করা উচিত বলে মনে করি।

প্রসঙ্গত: এমপিও শিক্ষক ও কর্মচারীরা ২০% ঘর ভাড়া , ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও ৭৫% উৎসব ভাতার দাবি দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন যা জাতীয় ও বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রতাপের তুলনায় যৎসামান্য। সর্বশেষ গত ১৩ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে তারা উল্লেখিত দাবি বাস্তবায়নের লক্ষে পদযাত্রার মধ্য দিয়ে গেল ১২ অক্টোবর পর্যন্ত সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেন। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তাদের দাবি বাস্তবায়নে অর্থ মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মধ্যে যথেষ্ট গড়িমসি লক্ষ্য করা যায়। সর্বশেষ পাঁচ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ এর বিশেষ দিনে শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া মাত্র ৫০০ টাকা বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন জারি করে উপহাস সৃষ্টি করে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে ব্যথিত করে তোলা হয়। ঠেলে দেয়া হয় রাজপথের আন্দোলনে। শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমাতে ১৩ অক্টোবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডের মত ভয়াবহ অস্ত্র ব্যবহার করে। এমনকি বেধড়ক লাঠিপেটা করে শিক্ষকদের যাচ্ছেতাই ভাবে লাঞ্ছিত করা হয়েছে- যা সমগ্র দেশবাসীকে হতবাক করেছে। সচেতন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, এ রাষ্ট্র কি তবে শিক্ষকদেরকে অবলা প্রাণী মনে করে? যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও কেন এ বিষয়ে যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত কর্তৃপক্ষ নিতে পারেনি? দাবি বাস্তবায়নে ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৪ অক্টোবর হতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সমগ্র দেশের এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে এবং তদানুযায়ী তা পালিত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বছর শেষের এই সময়ে ক্লাস ও পরীক্ষা বর্জন শিক্ষার্থীরদের জন্য অপুরনীয় ক্ষতি বয়ে আনবে। কেননা, আর মাত্র কয়েক মাস পর ২০২৬ সালের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক এর মত দেশের বৃহত্তম দুই পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে, অনেক প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মাধ্যমিকের প্রাক- নির্বাচনী পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। মাধ্যমিকের নির্বাচনী পরীক্ষাও অত্যাসন্ন। এছাড়াও, অন্যান্য শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা আগামী মাস থেকে শুরু হবে। এমনিতেই শিক্ষায় মহামারি করোনার প্রকোপে সৃষ্ট ক্ষতি আজও পূরণ করা সম্ভব হয়নি, তার ওপর আবার সরকারের এ হেন অবহেলা ও অদূরদর্শিতায় সৃষ্ট এরকম অরাজক পরিস্থিতি মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে হুমকির মুখে ঠেলে দিবে বৈকি। এ হেন অচলাবস্থায় দেশের তাবৎ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে গভীর উদ্বিগ্নতা সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে, বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল শ্রেণী পেশার মানুষ অনতিবিলম্বে এমপিও শিক্ষকদের দাবি-দাওয়া বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সমস্যার অশু সমাধানের আওয়াজ তুলেছেন। অর্থাৎ, বলা যায়, এ বিষয়ে একপ্রকার গণচেতনা সৃষ্টি হয়েছে।

উল্লেখ্য, শিক্ষাকতা হলো শতভাগ সৃজনশীল (creative) ও বুদ্ধিবৃত্তিক (intellectual) পেশা। তাই শিক্ষকদের মৌলিক চাহিদা অপূর্ণ বা টানাপোড়েনে রেখে এবং পাশাপাশি অবলা প্রাণীসুলভ অসদাচরণ করে কখনোই ফলপ্রসূ শিক্ষা আশা করা যাবেনা। এতে ক্ষুন্ন হবে রাষ্ট্রের মর্যাদা, ক্ষতিগ্রস্ত হবে প্রজন্ম পরম্পরা শিক্ষা। তাই কালক্ষেপণ না করে শীঘ্রই সৃষ্ট সমস্যার বাস্তবসম্মত সমাধান করে শিক্ষকদের সম্মানের সাথে শ্রেণী কক্ষে ফিরিয়ে দেওয়া হোক।

লেখক: কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর