মিরপুরের একটি গার্মেন্টস কারখানায় আগুনে ১৬ শ্রমিকের মৃত্যু। সংবাদটি আমাদের কাছে হয়তো আরেকটি দুঃখজনক দুর্ঘটনা। কিন্তু যারা এই কারখানাগুলোর ভেতরের বাস্তবতা জানেন, তাদের কাছে এটি কেবল খবর নয়, বরং বহুবার দেখা এক পুনরাবৃত্ত দুঃস্বপ্ন।
কারখানাটির উপরের তলায় আগুন লেগে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে পাশের রাসায়নিক গুদামে। কোথাও ছিল না আগুন নেভানোর কার্যকর ব্যবস্থা, ছিল না নিরাপদ নির্গমনপথ, আর দায় নিতে কেউ এগিয়ে আসেনি। নিহতদের বেশির ভাগই তরুণ নারী শ্রমিক, যাদের ঘামেই এই দেশের অর্থনীতির প্রধান খাতটি দাঁড়িয়ে আছে।
এদের অনেকেই নতুন চাকরি নিয়ে মাত্র জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছিলেন, কেউ বা নববিবাহিতা। আমাদের পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে ওরা বুনছিলেন নিজেদের জীবনের হাজারো স্বপ্ন; নিরাপদ ভবিষ্যতের, স্বাবলম্বী জীবনের। সেই সব স্বপ্ন অকালে পুড়ে ছাই হয়ে গেল নব্য-সামন্তপতিদের অবহেলার আগুনে।
গার্মেন্টসকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করার সুবাধে এ ধরনের ছোট সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করা গার্মেন্টস কারখানাগুলোর ভেতরে ঘুরে আমি নিজের চোখে দেখেছি সেই অবহেলা। কাপড়ের রোলের ফাঁকে চলার জায়গা নেই, তার ঝুলছে মেশিনের ওপর দিয়ে, দেয়ালে ধুলোমাখা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র। এক শ্রমিককে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম ফায়ার ড্রিল হয় না, সে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘ধোঁয়া উঠলে আমরা দৌড়াই, এটাই ড্রিল।’
এই নারীদের পরিশ্রমেই তৈরি হয় সেই পোশাক, যা আমাদের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে, অথচ তাদের জীবনই সবচেয়ে অবমূল্যায়িত।
মিরপুরের এই ট্র্যাজেডি কোনো ব্যতিক্রম নয়। ২০২৪ সালের ৩ জুলাই গাজীপুরের এক গার্মেন্টসে আগুনে প্রাণ হারান সাতজন। আরও আগে ছিল তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন (২০১২) এবং রানা প্লাজা ধস (২০১৩) যেখানে প্রাণ গেছে এক হাজারেরও বেশি মানুষের। বছর পাল্টায়, নাম পাল্টায়, কিন্তু গল্প একই থাকে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে গার্মেন্টস খাতে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ছিল ১৭৭। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৪১। দেশে এখন প্রায় ৩৭০০ কারখানা চালু, যার ২৩ শতাংশ কোনো সংস্থার তদারকির বাইরে। এই অরক্ষিত জায়গাগুলোই আগামী দুর্ঘটনার সম্ভাব্য স্থান।
রপ্তানিমুখী বড় কারখানাগুলো কিছুটা নিরাপদ হলেও হাজারো ছোট ও স্থানীয় কারখানা এখনো অন্ধকারে। এগুলো অনেক সময় আবাসিক ভবনে গড়ে ওঠা, যেখানে শ্রমিকরা রাসায়নিক পদার্থের পাশে বসে খালি হাতে কাপড় ধোয়, মেঝে পিচ্ছিল, দরজা বন্ধ থাকে যাতে কেউ অযথা বাইরে না যায়।
কর্মস্থলের নিরাপত্তা কোনো দয়া নয়, এটি মৌলিক মানবাধিকার। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলেছে, ডিসেন্ট ওয়ার্ক মানে হলো এমন কাজ যা দেয় স্বাধীনতা, সমতা, নিরাপত্তা ও মানবমর্যাদা। বাংলাদেশ এই সংস্থার বেশির ভাগ নিরাপত্তা বিষয়ক কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু বাস্তবে সেগুলো কেবল কাগজে রয়ে গেছে।
আমরা ভুলে যাই যে এই শ্রমিকরাই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। পোশাক খাত জিডিপির ১০ শতাংশের বেশি যোগান দেয় এবং প্রায় ৪০ লাখ মানুষকে জীবিকা দেয়, যাদের অধিকাংশই নারী। তাদের ঘামে আসে রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশ। অথচ দুর্ঘটনা ঘটলে তাদের নাম হারিয়ে যায় তালিকায়, পরিবার পড়ে অপেক্ষায় হাসপাতালের সামনে, বেতনও আসে বিলম্বে।
প্রশ্নটা তাই খুব সহজ, তারা কি এর যোগ্য? আমরা কি এমন এক উন্নয়ন চাই, যেখানে উন্নয়ন গড়ার মানুষগুলোই সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, সবচেয়ে অবহেলিত? যারা আমাদের পোশাক সেলাই করে, তারাই যেন হয়ে যায় এই অর্থনীতির সবচেয়ে অবাঞ্ছিত অংশ, এ কেমন সভ্যতা?
সমাধান অজানা নয়, দরকার কেবল বাস্তবায়নের ইচ্ছা_
প্রথমত, নিরাপত্তা সবার জন্য সমান হতে হবে। বড় হোক বা ছোট, রপ্তানিমুখী হোক বা স্থানীয়, সব কারখানাকে একই নিয়মে অগ্নি ও ভবন নিরাপত্তা কোডে আনতে হবে। শ্রমিক ইউনিয়ন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে স্বচ্ছ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মালিকদের বুঝতে হবে নিরাপত্তা কোনো খরচ নয়, এটি বিনিয়োগ। স্বল্পসুদে ঋণ ও প্রণোদনার মাধ্যমে ছোট কারখানাগুলোকে নিরাপত্তা সরঞ্জাম স্থাপনে উৎসাহ দিতে হবে।
তৃতীয়ত, আন্তর্জাতিক ক্রেতাদেরও তাদের দায় এড়ানো চলবে না। সরাসরি সরবরাহকারীদের তারা যাচাই করলেও সাবকন্ট্রাক্টরদের দিকে চোখ বন্ধ রাখে। নৈতিক ক্রয় বলতে হবে প্রতিটি পোশাক যেন নিরাপদ ও মানবিক পরিবেশে তৈরি হয়।
চতুর্থত, শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিয়মিত ফায়ার ড্রিল, অভিযোগ ব্যবস্থা ও শক্তিশালী ইউনিয়ন থাকলে নিরাপত্তা হবে সবার দায়িত্ব, শুধু কাগজের নয়।
সবশেষে, ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। আমরা যেন মনে রাখি কম দামের পোশাকের পেছনে অনেক সময় লুকিয়ে থাকে মানুষের জীবন। আমাদের দাবি ও সচেতনতা শিল্পে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারে।
যখন মিরপুরের ধোঁয়া এখনো আকাশে মিশে আছে, তখন সেই শ্রমিক পরিবারের কান্না প্রতিধ্বনিত হচ্ছে দেশের প্রতিটি সেলাই মেশিনে। তারা সংখ্যা নয়, তারা কন্যা, পিতা, মাতা, পুত্র, যারা শুধু জীবিকা অর্জনের আশায় কাজে গিয়েছিল।
তাদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানাতে হলে আমাদের কাজ শুরু করতে হবে পরবর্তী বিপর্যয়ের পর নয়, এখনই। যারা আমাদের সমৃদ্ধি গড়ে, তারা যেন আর কখনো না হয় সবচেয়ে ভুলে যাওয়া মানুষ।
লেখক: গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী