মার্কিন লেখক ও গবেষক বেলেন ফার্নান্দেজ ২০১৯ সালে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘বেশ কয়েক বছর আমি আর আমার এক বন্ধু ভেনেজুয়েলায় ছিলাম। সেখানে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চিরশত্রু বলে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট হুগো চাভেজের প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিকগুলোতে আমার বিনামূল্যে যে চিকিৎসাসেবা নিয়েছি, তা ভুলবার নয়। আমার দেশ আমেরিকায় আমি বিনামূল্যে এমন উন্নত চিকিৎসাসেবা কল্পনাও করতে পারি না। এর কারণ হলো, পুঁজিবাদের ধ্বজাধারী আমেরিকা যুদ্ধ বাধানো এবং করপোরেট মুনাফা অর্জনের পেছনে এত বেশি সময় দেয় যে মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় সে পায় না। ভেনেজুয়েলার একটি ক্লিনিকের একজন নারী চিকিৎসক আমাকে বলছিলেন, বিশ্বের যেখানেই যুদ্ধ সেখানেই মার্কিন সেনাবাহিনীর দেখা পাওয়া যাবে। আর সেসব যুদ্ধবিধ্বস্ত জায়গায় কিউবার লোকও থাকে। তবে তারা সেনা নন, তারা চিকিৎসক।’
বিশ্ব সভ্যতার অগ্রযাত্রায় পুঁজিবাদ এক অমোঘ বাস্তবতা। শিল্পবিপ্লবের পর থেকে এর প্রভাবে মানবজাতি যে উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তি ও ভোগসুবিধার বিস্ময় প্রত্যক্ষ করেছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন। কিন্তু একই সঙ্গে এই ব্যবস্থাই সৃষ্টি করেছে গভীর বৈষম্য, মানবিক অবক্ষয়, পরিবেশ ধ্বংস ও নৈতিক শূন্যতা। প্রশ্ন উঠছে—পুঁজিবাদ আসলে সৃজনশীল নাকি ধ্বংসমুখী?
বৈষম্যের অর্থনীতি ও অমানবিক বাস্তবতা
যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত পুঁজিবাদী দেশে আজ সামাজিক বৈষম্য ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জাতিসংঘের Special Rapporteur on Extreme Poverty and Human Rights ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক বাস্তবতা নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলেন, সেখানে উল্লেখ করা হয়—আমেরিকায় অন্তত ৪ কোটি মানুষ দরিদ্র, এবং উন্নত বিশ্বে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। একই সঙ্গে মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার প্রবণতা এক মহামারির রূপ নিয়েছে।
US Centers for Disease Control and Prevention (CDC)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আত্মহত্যার হার গত দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। মাদকদ্রব্য, বিশেষ করে ওপিওইড জাতীয় ওষুধের অতিব্যবহার কোটি কোটি আমেরিকানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। অথচ এই মাদকবিপণন থেকে ওষুধ কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ডলারের মুনাফা তুলেছে—একটি ক্লাসিক উদাহরণ, কীভাবে পুঁজিবাদ মানবজীবনের যন্ত্রণা থেকেও লাভের খোঁজে নামে।
প্রযুক্তি বনাম মানবতা
পুঁজিবাদী সমাজে প্রযুক্তির বিকাশ নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, ডিজিটাল ফিন্যান্স—সবই মানুষের জীবন সহজতর করেছে। কিন্তু একই সঙ্গে Automation ও Artificial Intelligence-এর কারণে শ্রমবাজারে কোটি কোটি মানুষ কাজ হারাচ্ছে।
World Economic Forum (2023)-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২7 সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৮৩ মিলিয়ন চাকরি বিলুপ্ত হতে পারে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদনের ফলে। অর্থাৎ, উৎপাদন বাড়লেও মানুষের জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে।
পরিবেশ ধ্বংসের নেপথ্যে পুঁজিবাদ
পুঁজিবাদী অর্থনীতি মূলত ক্রমবর্ধমান ভোগের ওপর দাঁড়িয়ে। উৎপাদন ও ভোগ যত বাড়ে, ততই মুনাফা বাড়ে। এই মডেল পৃথিবীকে এক ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছে।Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)-এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৫০ বছরে যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, তার ৭০ শতাংশের বেশি দায়ভার বহন করছে শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো।
১৯৮৯ সালে মার্কিন অর্থনীতিবিদ পল সুইজি সতর্ক করেছিলেন—পুঁজিবাদ যত বেশি বিস্তৃত হবে, ততই বাড়বে কার্বন নিঃসরণ, গ্রিনহাউস গ্যাস, এবং পৃথিবীর পরিবেশগত বিপর্যয়। আজ তার সেই সতর্কবাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছে। আমাজন বন উজাড়, আর্কটিক গলন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, এবং জলবায়ু উদ্বাস্তু—সবকিছুর মূলে রয়েছে অতি উৎপাদন ও ভোগনির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতি।
পুঁজিবাদের সংকট: মানুষ একা হয়ে যাচ্ছে
নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির মূলনীতি হলো—ব্যক্তি নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা। কিন্তু এই ব্যক্তিকেন্দ্রিক দর্শন সমাজের পারস্পরিক বন্ধন ছিন্ন করে দিয়েছে।
অর্থের পেছনে ছুটতে ছুটতে মানুষ একা হয়ে পড়ছে, পরিবার ও সামাজিক বন্ধন ভেঙে যাচ্ছে। World Health Organization (WHO)-এর তথ্য বলছে, বৈশ্বিকভাবে বিষণ্নতা এখন অন্যতম বড় জনস্বাস্থ্য সমস্যা, বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে।
একদিকে মুনাফা বাড়ছে, অন্যদিকে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ছে—এটাই পুঁজিবাদের বাস্তব চিত্র।
দক্ষিণের দৃষ্টিকোণ: উন্নয়ন না শোষণ?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের প্রভাব সুস্পষ্ট। একদিকে বিদেশি বিনিয়োগ, রপ্তানি বৃদ্ধি ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতিকে গতিশীল করছে; অন্যদিকে বৈষম্য বাড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ মানুষের আয় নিচের ৪০ শতাংশের সম্মিলিত আয়ের চেয়েও বেশি।
অর্থাৎ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটলেও আয়বৈষম্য মারাত্মক আকারে বাড়ছে—যা মূলত পুঁজিবাদী বিকাশের অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্য।
বিকল্প ভাবনা: মানবকেন্দ্রিক অর্থনীতি
পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধ্বংসাত্মক পরিণতি রোধে এখন দরকার মানবকেন্দ্রিক, ন্যায়ভিত্তিক অর্থনৈতিক কাঠামো। কিউবা, ভেনেজুয়েলা, নর্ডিক দেশগুলো (যেমন নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক) দেখিয়েছে—রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতা, সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণমূলক নীতি পুঁজিবাদের বিকল্প হতে পারে। এই দেশগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা রাষ্ট্রীয়ভাবে নিশ্চিত করা হয়; ফলে সমাজে ভারসাম্য বজায় থাকে।
বাংলাদেশেও কৃষিভিত্তিক, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর জোর দিতে হবে। মানুষের কল্যাণকে মুনাফার ওপরে স্থান দিতে না পারলে আমাদেরও একই পরিণতি ঘটবে—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থাকবে, কিন্তু মানুষ হারাবে মানবতা।
উপসংহার
পুঁজিবাদ নিঃসন্দেহে সৃজনশীল—কারণ এটি উদ্ভাবন, প্রযুক্তি ও উৎপাদনে বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু সেই সৃজনশীলতা আজ নিজেই ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীকে।
মানুষের সৃজনশীল শক্তিকে যদি কেবল মুনাফার যন্ত্রে পরিণত করা হয়, তবে তা শেষ পর্যন্ত আত্মধ্বংসই ডেকে আনে।
সুতরাং, মানবতার স্বার্থে আজই প্রশ্ন তুলতে হবে—আমরা কি পুঁজিবাদকে মানুষমুখী করতে পারব, নাকি মানুষকেই এই ব্যবস্থার বলি হতে দেব?
পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এই ধনতান্ত্রিক অস্থির সমাজকে ভাঙতেই হবে। বিশ্বকে জাগতেই হবে।
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট