Sunday 19 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাখাইন সংকট: বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও কূটনীতির নতুন পরীক্ষা

মাসুদ রানা
১৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:৩৫

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাত আজ শুধু সে দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট নয়—এটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা, মানবিক স্থিতিশীলতা এবং আঞ্চলিক ভূরাজনীতির জন্য এক গভীর চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। জান্তা সরকারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এবং কেন্দ্রীয় শাসনের ব্যর্থতার সুযোগে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি দ্রুত শক্তিশালী হয়ে এখন রাখাইনের বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এই পরিবর্তিত বাস্তবতা বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের ওপর এক অনিশ্চিত ছায়া ফেলেছে।

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে তাৎক্ষণিক ঝুঁকি হলো নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা। রাখাইন রাজ্যের উত্তপ্ত পরিস্থিতি ইতিমধ্যেই হাজার হাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, এবং পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা নিরাপত্তার খোঁজে আবারও সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হতে পারে—এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে কক্সবাজার সীমান্তে নতুন অনুপ্রবেশের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিচ্ছে, যা বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী জনগোষ্ঠীগুলোর একটি। এই বিপুল জনসংখ্যা বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। নতুন করে শরণার্থীদের ঢল শুরু হলে সীমিত সম্পদ, প্রশাসনিক সক্ষমতা ও মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আন্তর্জাতিক তহবিল হ্রাস এবং দাতা ক্লান্তির কারণে সংকট আরও ঘনীভূত হবে।

আরাকান আর্মি বর্তমানে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। সীমান্তের অপর পাশে কোনো রাষ্ট্রবহির্ভূত সশস্ত্র গোষ্ঠীর এমন প্রভাব সরাসরি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক। সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের ভেতর থেকে মর্টার শেল, গুলিবর্ষণ ও গোলাগুলি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে এসে পড়ার ঘটনা সীমান্তবর্তী জনগণের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করেছে।

এছাড়া, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইয়াবা পাচার, অস্ত্র চোরাচালান ও মানবপাচারের কার্যক্রম আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এই অস্থিতিশীল পরিবেশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে বিপন্ন করে তুলছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতেও নিরাপত্তা উদ্বেগ বাড়ছে। সেখানে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা এবং রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন আর আরএসও-এর মতো গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়, এবং আরাকান আর্মির সঙ্গে তাদের সংঘাত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও সহিংসতা উস্কে দিতে পারে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এতদিন মিয়ানমারের সামরিক সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের আলোচনার ওপরই প্রধানত নির্ভর করছিলো। কিন্তু এখন রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ কার্যত আরাকান আর্মির হাতে, যার সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই। এতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

আরাকান আর্মির দৃষ্টিতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী একদিকে রাখাইনের স্থিতিশীলতার অংশ, অন্যদিকে তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। ফলে তারা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে সহজে গ্রহণ করবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। এই অবস্থায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া রাজনৈতিকভাবে আরও জটিল হয়ে উঠছে।

রাখাইন এখন আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে। চীন ইতিমধ্যেই রাখাইন রাজ্যে তাদের অর্থনৈতিক করিডর ও বন্দর প্রকল্পের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অন্যদিকে, ভারত কালাদান মাল্টি-মোডাল ট্রানজিট প্রকল্পের কারণে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় সরাসরি স্বার্থ জড়িত রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রভাব মোকাবিলায় রাখাইনকে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে।

এই নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায়, আরাকান আর্মির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টি একটি সূক্ষ্ম কূটনৈতিক ভারসাম্য দাবি করে। একদিকে যেমন সরাসরি ও আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করলে চীনের মতো পরাশক্তি এবং মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মারাত্মকভাবে জটিল হতে পারে, তেমনই রাখাইন রাজ্যের মাঠ পর্যায়ের প্রধান শক্তিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করাও বাস্তবানুগ নয়। কারণ, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এবং সীমান্ত স্থিতিশীলতা—উভয় ক্ষেত্রেই আরাকান আর্মির সহযোগিতা বা অন্ততপক্ষে তাদের মৌন সম্মতি অপরিহার্য। তাই বাংলাদেশের উচিত হবে সীমিত কূটনৈতিক বা গোয়েন্দা ব্যাক-চ্যানেলের মাধ্যমে পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা। এই ব্যাক-চ্যানেল যোগাযোগের মূল লক্ষ্য হবে: সীমান্ত সংঘাত যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ছড়িয়ে না পড়ে তার নিশ্চয়তা নেওয়া এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় আরাকান আর্মির সমর্থন আদায় করা। তবে এই প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কখনোই আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি হিসেবে তুলে ধরা যাবে না, বরং একে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও মানবিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করতে হবে। বিশেষত চীনকে বোঝাতে হবে যে এই যোগাযোগ বাংলাদেশের নিজস্ব নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার স্বার্থে জরুরি, যা প্রকারান্তরে চীনা বিনিয়োগের সুরক্ষা নিশ্চিত করতেও সহায়ক।

এই জটিল সংকট কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশকে তিনটি প্রধান স্তরে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। প্রথমত, সীমান্ত নিরাপত্তা ও সামরিক প্রস্তুতিতে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। যেহেতু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত সরাসরি বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করছে, তাই সীমান্তে বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদান ও অপারেশনাল সমন্বয় আরও শক্তিশালী করা অপরিহার্য। অনুপ্রবেশ এবং সামরিক গতিবিধি দ্রুত শনাক্ত করার জন্য উন্নত প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি ব্যবস্থা যেমন—ড্রোনভিত্তিক টহল, তাপ-সংবেদনশীল ক্যামেরা ব্যবহার এবং অতিরিক্ত ফরওয়ার্ড বেইস বা চৌকি স্থাপন করা জরুরি। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত বাহিনী মোতায়েনের জন্য অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও আঞ্চলিক চাপ বৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইন সংকট কেবল একটি মানবিক সমস্যা নয়, বরং এটি আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তার জন্য একটি গুরুতর হুমকি—এই বার্তাটি আন্তর্জাতিক মঞ্চে আরও জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে। এ লক্ষ্যে জাতিসংঘ, আসিয়ান, ওআইসি এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক ফোরামে মিয়ানমারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক উদ্যোগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে আঞ্চলিক সংস্থা আসিয়ানের অভ্যন্তরে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো সমমনা দেশগুলোর সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে মিয়ানমারের ওপর কার্যকর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করতে হবে। একই সঙ্গে, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে বোঝাতে হবে যে এই দীর্ঘায়িত সংকট তাদের নিজস্ব আঞ্চলিক বিনিয়োগ এবং সাপ্লাই চেইনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। এই অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলো ব্যবহার করে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের নতুন পথ তৈরি করতে হবে।

তৃতীয়ত, মানবিক ব্যবস্থাপনা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর স্থিতিশীলতা বজায় রাখা জরুরি। দীর্ঘদিনের অনিশ্চয়তা এবং ক্যাম্পের ভেতরে বিদ্যমান হতাশা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে, যা বাংলাদেশের স্থানীয় ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। এই ঝুঁকি কমাতে ক্যাম্পের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলার কার্যকর প্রয়োগ এবং নিরাপত্তা নজরদারি জোরদার করতে হবে। এর পাশাপাশি, তরুণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে হতাশা কাটিয়ে তোলার জন্য নিয়ন্ত্রিত ও দক্ষতা-নির্ভর শিক্ষা এবং কারিগরি প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। তবে এই কর্মসূচিগুলো অবশ্যই এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে এটি তাদের দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশে স্থায়িত্ব লাভের সুযোগ না দেয়, বরং ভবিষ্যতে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ তৈরি করে। পরিশেষে, এই মানবিক সংকটের ভার লাঘব করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন অব্যাহত রাখে, সেজন্য দাতাদেশগুলোর সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ বজায় রাখা এবং তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন কূটনৈতিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

আরাকান আর্মি-রোহিঙ্গা সংঘাত বাংলাদেশের জন্য কেবল সীমান্ত নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়—এটি দেশের সার্বভৌমত্ব, মানবিক দায়বদ্ধতা এবং আঞ্চলিক ভারসাম্যের বড় পরীক্ষা। এই সংকট মোকাবিলায় দৃঢ় কূটনৈতিক অবস্থান, সীমান্তে সক্রিয় নিয়ন্ত্রণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে হবে।

সময়ের দাবি হলো—বাংলাদেশ যেন তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা ঝুঁকি মোকাবিলা করার পাশাপাশি একটি দীর্ঘমেয়াদি কূটনৈতিক রোডম্যাপ প্রণয়ন করে। সেই রোডম্যাপের লক্ষ্য হওয়া উচিত রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান, সীমান্তের স্থিতিশীলতা, এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামগ্রিক শান্তি রক্ষা।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর