Thursday 23 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন ও প্রসঙ্গ কথা

জিয়াউল হক মৃধা
২৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:০৭ | আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৮:১০

২৩ অক্টোবর উপজেলা দিবস। ১৯৮৪ সনের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশের ভুতপুর্ব রাষ্ট্রপতি, জাতীয়পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একই দিনে বাংলাদেশের সবকটি থানাকে উপজেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। এতবড় কর্মযজ্ঞ ইতিহাসে কোনকালে সংঘটিত হয়েছে কিনা তা কারো জানা নেই। এর পেছনে আছে বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের অপ্রাপ্তি ও বঞ্চনার ইতিহাস। ৪৭ সনে দেশ তথাকথিত স্বাধীনতা পাওয়ার পরও পূর্ব বাংলার আপামর জনতার ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। উপনিবেশিক ব্যবস্হা জগদ্দল পাথরের মত জনগণের বুকের ওপর চেপে বসে ফলে উন্নয়ন বঞ্চিত হয় গ্রামবাংলা। রাস্তা নেই, ঘাট নেই, কচুরিপানা ভর্তি মজাপুকুর, ঝোপজঙ্গল ডোবা, পানিয় জলের অভাবে সংক্রামক ব্যাধির ছড়াছড়ি, মশার উৎপাতে ম্যালেরিয়ার অবাধ রাজত্ব, গ্রাম্য সুদখোরদের নিষ্ঠুর সুদি/লগ্নি ব্যবসা, বিচারের নামে গ্রাম টাউট-বাটপারদের সীমাহীন দৌরাত্ম্য তদুপরি বিদ্যুৎ হীনতা গ্রাম্য জীবনকে সাধারণ মানুষের বাস অনুপযোগী করে তোলে।

বিজ্ঞাপন

এ গেলো গ্রামের চিত্র পাশাপাশি আমরা যদি তাকাই থানার দিকে তাহলে পাকিস্তানের প্রথম দিকে থানা বলতে বোঝাতো বৃটিশ শাসন-শোষনের কোন্দল। কজন দারোগা, কয়েকজন কনষ্টেবল, কিছু গাদাবন্দুক, কিছু চৌকিদার, দফাদার অপর দিকে খাজানা আদায়ের তহশিল কাছারি, সাবরেজিষ্ট্রার, সেনিটারি ইন্সপেক্টর, ঠিকানা বিহীন, স্কুল ইন্সপেক্টর, অদক্ষ কৃষিকর্মকর্তা যারা মাস শেষে আসতেন বেতন নিয়ে চলে যেতেন। পরবর্তীতে ১৯৫৯ এর দিকে কুমিল্লায় জন্ম নিল পাকিস্তান পল্লীউন্নয়ন একাডেমী পার্ড পরবর্তীতে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বার্ড। আখতার হামিদ খান নামক এক মহান কর্মবীর আই, সি, এস অফিসার যিনি পরিচালকের দায়িত্ব নিলেন। তিনি থানা পরিষদ গঠন করেন যার নেতৃত্বে ছিলেন একজন সার্কেল অফিসার উন্নযন এবং ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানগণ ছিলেন সদস্য। তার পরামর্শে গঠিত হয় থানা সচিবালয় জাতি গঠণ মুলক বিভাগ সমুহের কর্মকর্তাদের এক ছাদের নীচে বসার ব্যবস্হা হয় সচিবালয়ে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মৎস্য চাষ, সমবায়ের মাধ্যমে সমষ্টিগত উন্নয়ন, আধুনিক জলসেচও চাষাবাদের জন্য সৃষ্টি করেন থানা প্রশিক্ষণও উন্নয়ন কেন্দ্র। অফিসারদের পরিবার নিয়ে বসবাসেরর জন্য টুইন কোয়ার্টার। পল্লীর জনগনের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য দ্বিস্তর বিষিষ্ট সমবায় ব্যবস্থা চালু করেন যা গ্রাম পর্যায়ে গ্রাম সমবায় সমিতি আর থানা পর্যায়ে থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি কেন্দ্রীয় সমিতির পরিচালক ছিলেন একজন প্রশাসনিক প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা। পরীক্ষামুলক ভাবে বৃহত্তর কুমিল্লা জেলায় কৃষি, সেচ, আধুনিক চাষাবাদ, সমবায় ভিত্তিক ব্যবসা, সঞ্চয়ের মাধ্যমে পুঁজি গঠন, গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়ন, কৃষি, স্বাস্থ্য, কুটির শিল্পের প্রশিক্ষণ ইত্যাদিতে বিরাট সফলতা অর্জিত হয়।

স্বাধীন বাংলাদেশে কুমিল্লা মডেল গ্রহন করে এবং সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসুচী নামে দেশের সবকটি থানায় ছড়িয়ে দেয়। যা বর্তমানে বিআরডিবি নামে পরিচিত। অপরদিককে থানা পরিষদ জনসাধারণের কাছে দায়ব্ধতা না থাকায়, জন প্রতিনিধির কাছে জবাবদিহিতার ব্যবস্হা না থাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থানা গুলোর কর্মকর্তারা আগের মতই স্বাধীন ভাবে চলতে থাকেন। ফলশ্রুতিতে কাঙ্কিত উন্নয়ন মুখ থুবড়ে পড়ে।

এমনি যখন অবস্থা তখন দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেন এক বিপ্লবী শাসক। বিনা রক্তপাতে যিনি ক্ষমতা গ্রহন করেন দেশের নৈরাজ্যকর পরিস্হিতিতে। ক্ষমতা হাতে নিয়ে ই তিনি ভাবলেন ঘুণেধরা প্রশাসন ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে চূড়ে একটা বিশ্বমানের, স্বাধীন দেশের উপযোগী কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তিনি ভাবলেন, গ্রামবাংলাকে অবহেলা করে এদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয় তাই তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোঘণা করেন, ‘আটষট্টি হাাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’ শুরু হল সাধকের কর্মযজ্ঞ। প্রথমেই বৃটিশ উপনিবেশিক থানা ব্যবস্হাকে ভেঙে তিনি প্রথম ধাপে ৫০টি থানাকে ঘোষণা করেন উন্নীত থানায় রূপান্তর করেন পরীক্ষামুলক ভাবে। থানায় এডিসি লেভেলের নির্বাহী কর্মককর্তা এলো, ম্যজিষ্ট্রেট এলো। জাতি গঠণমুলক সকল ডিপার্টমেন্টে পদস্হ কর্মকর্তারা এলো। থানায় এলো পুলিশ ইন্সপেক্টর। উন্নীত থানায় শুরু হল উন্নয়নের জয়যাত্রা। বহু প্রত্যাশিত বিচারব্যবস্থা এল মানুষের দোরগোড়ায়। দেওয়ানীও ফৌজদারি আদালত কার্যক্রম চালু করল। আইনজীবী, মোহরার, বিচারপ্রার্থী, ফেরিওয়ালা, ফলওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, হোটেলওয়ালা সকল শ্রেণিপেশার মানুষের কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠল উন্নীত থানা। থানাগুলো ব্যবসা বানিজ্যের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।

অতঃপর প্রথমধাপের সফলতায় দ্বিতীয় ধাপে আরো ৫০টি থানাকে উন্নীত থানায় রুপান্তর করা হয়। উন্নীত থনায় সফলতা থাকলেও গণপ্রতিনিধিদের কাছে কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতা না থাকায় আমলাতন্ত্রের জোয়াল থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন উপজেলায় একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান। নির্বাচিত চেয়ারম্যানের অধীনে সমস্ত কর্মকর্তাদের ন্যস্তকরা। এবং উপজেলাকে একটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে পরিনত করা। সে লক্ষ সামনে রেখেই ১৯৮৪ সনের ২৩ অক্টোবর তিনি তৎকালীন ৪৬০টি থানাকে একযোগে উপেজেলা ঘোষণা করেন। উপজেলা ঘোষণার সাথে সাথ সপ্তদশ শতাব্দীর গভীর অন্ধকারে ঘুমিয়ে থাকা গ্রামবাংলা আলোর বন্যায় ভাসতে থাকে। গ্রাম থেকে ইউনিউনে, ইউনিয়ন থেকে উপজেলা, উপজেলা থেকে রাজধানী সর্বত্র যোগাযোগব্যবস্থা স্হাপিত হয়। অসংখ্য ব্রিজ কালবার্ট নির্মিত হয়। গ্রামগুলো হয়ে উঠে উন্নয়নের প্রাণকেন্দ্র। উপজেলাগুলো হয়ে উঠে ব্যবসা বানিজ্য তথা শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র। রাজধানী থেকে, জেলাশহর থেকে আইনজীবী, পেশাজীবী, ব্যবসায়ীরা উপজেলায় এসে বসতি স্হাপন করতে থাকে ফলে প্রত্যেকটা উপজেলা সুন্দরস্নিগ্ধ নগরীতে পরিনত হয়। সবচেযে সুবিধার কথা হল এইযে, বিচার ব্যবস্হা সাধারণ মানুষের দোর গোড়ায় আসায় মানুষ বাড়ি থেকেই পায়ে হেটে কিংবা রিক্সা, সিএনজিতে আদালতে এসে হাজিরা দিতে পারত। দ্রুত মামলার জট কমে যেতে লাগল। সকল বিভাগের কর্মকর্তাদের নৈমিত্তিক ছুটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে ন্যস্ত হল আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানের কাছে তার সকল কাজের জন্য দায়ী থাকতে হত। এক কথায় উপজেলা ছিল একটা নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থা। কিন্তু এত সত্বেও এই ব্যবস্হা সহ্য হয়নি আমলাদের যারা মনে করে বৃটিশ আমলাতন্তের নীল রক্ত তাদের রক্তে প্রবাহিত।

এক শ্রেণীর মানুষ যারা রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় প্রচার করতে থাকে যে, উপজেলা হচ্ছে ঘুষদুর্নীতির কেন্দ্রবিন্দু। উপজেলা আদালতে ঘুষের ছড়াছড়ি। আমার দৃষ্টিতে একটা ছোট ডোবায় যদি একটা ইঁদুর মরে পড়ে থাকে তাহলে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়ায় কিন্তু মেঘনা পদ্মায় কত বড়বড় পশুর মৃত দেহ ভেসে যায় কেউ কি তার খবর রাখে? কত নিষ্ঠুরতম মামলার জঘন্য আসামি যখন জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায় তখনতো কাউকে সমালোচনা করতে শুনিনা। আসল কথা আমলারা চায়না, প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীরা চায়না ঢাকা ছেড়ে, বড়শহর ছেড়ে উপজেলায় আসতে।

পরবর্তীতে দেখা গেল ৯০-এর পট পরিবর্তনের পর বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে উপজেলা ব্যবস্হা কলমের এক খোঁচায় নির্বাহী আদেশে বিলুপ্ত করে পল্লী বাংলার আর্থ সামজিক কাঠামোর বারোটা বাজিয়ে দেয়। খুশির কথা এইযে, যারা একদিন এরশাদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে উপজেলা ব্যবস্হার বিরোধিতা করছিল তারাই সর্বসম্মতি ক্রমে, সর্বদলীয় ভাবে পল্লী উন্নয়নের জন্য একমত্র ব্যবস্হা হিসেবে উপজেলাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একজন প্রাজ্ঞ রাজনীতবিদ হিসেবে, একজন মহান সংস্কারক হিসেবে এরশাদের জন্য এরচেয়ে বড় পাওয়ার আর কি থাকতে পারে। বিচিত্র এইদেশ! উপজলা মেনে নিলাম, উপজেলা চেয়ারম্যান মেনে নিলাম, নির্বাচন করলাম, উপজেলার মাধ্যমে সমস্ত উন্নয়ন কর্মকাণ্ড মেনে নিলাম কিন্তু উপজেলায় আদালত পুনস্হাপণ মেনে নিলামনা। জনগণ নিশ্চয়ই এমন বিকলাঙ্গ উপজেলা প্রত্যাশা করেনা। হালে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সিদ্ধান্ত হয়েছে উপজেলায় আদালত পুন:স্হাপনের। এই সিদ্ধান্ত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বৃহত্তর স্বার্থে নেয়া হয়েছে বিধায় প্রশংসার দাবি রাখে। হাজারো উন্নয়ন, হাজারো জনহিতকর কাজ করে গেছেন পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। সব কর্মই যদি আমরা সময়ের ব্যাবধানে ভুলে যাই তবু উপজেলা ব্যবস্হার প্রবর্তক হিসেবে ইতিহাস তাকে অমর করে রাখবে কত না যুগযুগান্তরে।

লেখক: রাজনীতিবিদ

সারাবাংলা/পিটিএম/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর