বাংলা অভিধানে রুচি শব্দের মানে হচ্ছে শোভা, দীপ্তি, পছন্দ, মার্জিত বুদ্ধি বা প্রবৃত্তি, স্পৃহা, ইচ্ছা ইত্যাদি। রুচিশীল শব্দের কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড না থাকলেও কিছু মাপকাঠি বা বৈশিষ্ট্য দিয়ে তা নির্ধারণ করা যায়। ‘রুচিশীল’ বলতে বোঝায় যার রুচি বা সৌন্দর্যবোধ উন্নত, পরিশীলিত ও সুশিক্ষিত। অর্থাৎ, যিনি ভালো-মন্দ, শোভন-অশোভন, সুন্দর-অসুন্দর ইত্যাদির মধ্যে পার্থক্য করতে জানেন এবং সর্বদা ভালো, শালীন ও নান্দনিক দিকটি বেছে নেন। রুচিশীল ব্যক্তি সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। কারণ, রুচিশীল মানুষ কেবল নিজের জীবনকে সুন্দর করে তোলে না, বরং তার চিন্তা, আচরণ ও মূল্যবোধের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।
বর্তমানে বাংলাদেশে খাদ্যের দুর্ভিক্ষ না থাকলেও চারদিকে কেবল রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে যার দরুন সমাজের কাঠামোও অনুন্নত রুচির বেষ্টনীতে দিনেদিনে খসে পড়ছে। ‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ নিয়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, ‘এখন তো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনো ছবি হয় না।’ এই উক্তিটি আজও প্রাসঙ্গিক । এই প্রাসঙ্গিকতার বিভিন্ন উদাহরণ আছে বাংলাদেশে। তবে তার মধ্যে প্রধান হলো সিগারেট খাওয়াকে নর্মালাইজ করা। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অর্থাৎ যখন আমাদের বাবা মায়েরা তরুণ এবং দাদা দাদু , নানা নানুরা বিদ্যমান ছিলেন তখনকার সময়ও যেকোনো ছেলে ধূমপানের জন্য গোপনীয়তা রক্ষা করতো কিংবা সবার অগোচরে কাজটা করতো । কারণ বড়োরা দেখলে কিংবা লোকসম্মুখে ধূমপান তখন লজ্জার বিষয় ছিল যা নেতিবাচক হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু বর্তমানে প্রকাশ্যে এবং লোকসম্মুখে ধূমপান করে নাক দিয়ে ধোঁয়া বের করা যেন একটা ফ্যাশন হয়ে গেছে। এর পেছনের কারণ হিসেবে জানা যায় ধূমপায়ীদের মধ্যে যারা তরুণ কিংবা যুবক তারা এটাকে স্মার্টনেস হিসেবে দেখে যা কিছু মেয়েদের দ্বারা স্বীকৃত। মেয়েদেরকে ইমপ্রেস করার জন্য সিগারেট হাতে নাকে ধোঁয়া নিয়ে কিছু ছেলে তো ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দেয় । পাবলিক প্লেসে এখন অহরহ ধূমপান করে থাকে পুরুষরা।এদের মধ্যে কিছু থাকে অজ্ঞ আবার কিছু লোক জেনেবুঝেও এই কাজ করে থাকে কারণ তাদের কাছে থিওরি একটাই — ‘মেয়েরা ধূমপায়ী ছেলেদের স্মার্ট বলে’। নিয়মিত সিগারেট খেলে ব্রেনের নিউরো কেমিক্যাল পরিবর্তন হয়। তখন সিগারেট না খেলে শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি হয়। একবার মাদক শুরু করলে আস্তে আস্তে ডোজ বাড়াতে হয়। আমরা মনে করি গাঁজা, ইয়াবা মাদক। অথচ সিগারেটও একটা মাদক। প্রকাশ্যে মাদক সেবনকে যারা স্মার্টনেস বলে প্রোমোট করে তাদের রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে বলাই যায়। আর এর সংখ্যাও কিন্তু কম নয়।
সমাজে শিক্ষিত মানুষের কদর কমে যাওয়া এবং মূর্খ এবং টিকটকারদের কদর বেড়ে যাওয়া রুচির দুর্ভিক্ষের আরেকটা বড় উদাহরণ। কে কত ডিগ্রীধারী কিংবা জ্ঞানী তা বিবেচনা করার আগে দেখে কার কত ভিউ , কে কতটা ভাইরাল ব্যক্তি। এর প্রভাবে এখনকার ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রতি বাড়ছে অনাগ্রহ এবং লক্ষ্য হিসেবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রত্যয় না নিয়ে একজন কন্টেন্ট ক্রিয়েটর কিংবা টিকটকার হওয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করে বসে। যার জন্য এখন একটা ক্যামেরা আর মোবাইল ফোন হলেই নেমে পড়ে সস্তা ভিডিও বানানোর প্রতিযোগিতায়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এসব বস্তা পঁচা ভিডিওতে ভিউ বাড়ায় শিক্ষিত সমাজের লোকেরাই যার ফলশ্রুতিতে রুচিশীল মানুষের সংখ্যা হ্রাস পেতে থাকে। সমাজ হারায় তার সৌন্দর্য, বেড়ে যায় বিশৃঙ্খলা , সাংস্কৃতিক ও নৈতিক অবক্ষয় দেখা দেয়। এভাবে চলতে থাকলে দেশে নৈতিক অবক্ষয়, সাংস্কৃতিক অবনতি ও সামাজিক বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। মানুষ শালীনতা, ভদ্রতা ও ন্যায়বোধ হারাবে, অশালীনতা, সহিংসতা ও অসহিষ্ণুতা বাড়বে, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিতে মানহীনতার ছোঁয়া আসবে, সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা নষ্ট হবে, শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে।
রুচির দুর্ভিক্ষ মানে শুধু সৌন্দর্যের অভাব নয়—এটি সমাজের মানসিক ও নৈতিক পতনের সূচনা। রুচিশীল ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের নৈতিক, সাংস্কৃতিক ও নান্দনিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা শালীনতা, সততা ও সৌন্দর্যবোধের মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেন এবং অন্যদের অনুপ্রাণিত করেন। একটি সুশৃঙ্খল, ন্যায়ভিত্তিক ও উন্নত রাষ্ট্র গঠনে রুচিশীল মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি করা জরুরী হয়ে পড়েছে। রুচির দুর্ভিক্ষ দূর করতে সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষকে একযোগে নৈতিকতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিচর্চা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়