বাংলাদেশের জলবায়ু সংকট দিন দিন ঘনীভূত হচ্ছে। একদিকে তাপমাত্রা বাড়ছে, অন্যদিকে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর মানুষ বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততার শিকার হচ্ছে। এমন এক সময়, যখন পৃথিবীজুড়ে মানুষ পরিবেশের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার ভয়াবহতার মুখোমুখি, তখন সাতক্ষীরার একটি শিশুকে ঘিরে শুরু হয়েছে এক নতুন দৃষ্টান্ত। এই শিশুর নাম আয়ান খান- বাংলাদেশের প্রথম ‘কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু’। তার জন্মের পর বাবা-মা ৫৮০টি গাছ লাগিয়েছেন সাতক্ষীরার বিভিন্ন স্থানে, যার প্রতিটি গাছই তার জীবনের সঙ্গে যুক্ত একটি প্রতীক-জীবন, বায়ু ও ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি। এমন তথ্য প্রকাশ করেছে দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিক অনলাইন সংস্করণে।
‘কার্বন-নিরপেক্ষ’ বা carbon-neutral অর্থ হলো, একজন মানুষ বা একটি প্রতিষ্ঠান যতটুকু কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ করে, ততটুকু আবার প্রকৃতির মাধ্যমে শোষণ করা হয়। ফলে নিঃসরণের মোট প্রভাব শূন্যে এসে দাঁড়ায়। বর্তমানে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি, মেরু অঞ্চলের বরফ গলন, অনিয়মিত বৃষ্টি ও খরার মূল কারণ এই কার্বন গ্যাসগুলোর অতিমাত্রায় উপস্থিতি। জাতিসংঘের তথ্যমতে, যদি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর বহু অঞ্চল বাসযোগ্য থাকবে না।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কোনো শিশুকে ঘিরে কার্বন-নিরপেক্ষ ঘোষণা কেবল প্রতীক নয়, এটি জলবায়ু সচেতনতার এক নতুন সূচনা। এতে করে ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন হলো।
আয়ানের মা আয়শা আক্তার খুলনার একটি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তিনি যেমন মা, তেমনি প্রকৃতির সন্তানও। তার ভাষায়, ‘সন্তানের প্রাকৃতিক সুরক্ষার কথা ভেবেই গাছ লাগানোর চিন্তা এসেছে। গাছের সংখ্যা এখানেই শেষ নয়, আরও বাড়বে।’
অন্যদিকে, আয়ানের বাবা ইমরান রাব্বী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটিতে Climate Change and Development বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। তিনি পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনম্যান-এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তার হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে ০.৭ টন কার্বন নিঃসরণ করে, যা শোষণ করতে প্রায় ৫৪টি কাঁঠালগাছ প্রয়োজন। এই হিসাব থেকেই তিনি ভাবেন, ছেলের জন্য অন্তত ৫০০ গাছ লাগাতে হবে। সেটি পরে ৫৮০-তে পৌঁছায়। এই ৫৮০টি গাছের মধ্যে আছে আম, কাঁঠাল, জাম, নিম, সুপারি, ও ফলদ বনজ বৃক্ষ। কোনোটি গ্রামের পথের ধারে, কোনোটি পুকুরের পাড়ে, কোনোটি আত্মীয়স্বজনের জমিতে। গাছগুলো শুধু কার্বন শোষণই করবে না, ভবিষ্যতে গ্রামের মানুষকেও দেবে ছায়া ও ফল। আর এতে করে মানুষ জানলো কার্বন নিরপেক্ষ শিশুর কথা।
বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশের মাথাপিছু বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ ০.৭ টন। শুনতে কম মনে হলেও, জনসংখ্যার ঘনত্ব বিবেচনায় এটি মোট কার্বন নির্গমনে বিশাল ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক শক্তিধর দেশগুলো-বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ও ভারত-বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। অথচ এর মারাত্মক প্রভাব পড়ছে আমাদের মতো নিন্মভূমি ও উপকূলীয় দেশগুলোর ওপর।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষত সাতক্ষীরা, খুলনা ও ভোলার মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনের সরাসরি শিকার। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিতে কৃষিজমি লবণাক্ত হচ্ছে, পানির উৎস হারাচ্ছে স্বাদ। এই অবস্থায় যদি ব্যক্তি পর্যায়েও কেউ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগিয়ে আসে, সেটি এক যুগান্তকারী উদ্যোগ। আর এই প্রচেষ্টা কেবলই শুরুর স্বাক্ষী হয়ে রইলো।
বাংলাদেশের আগে বিশ্বের প্রথম ‘কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু’ ছিলেন ভারতের তামিলনাড়ুর আদাভি নামের এক শিশু। তার জন্মের আগে-পরে মা-বাবা প্রায় ৬০০০ গাছ লাগিয়েছিলেন। সেই উদ্যোগকে স্বীকৃতি দেয় Asia Book of Records।
সেই আদাভির গল্প থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেন আয়ানের বাবা-মা। তবে পার্থক্য হলো-ভারতে এটি রেকর্ডস্বরূপ একটি উদ্যোগ, আর বাংলাদেশে এটি পরিবেশ-সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার আন্দোলন হিসেবে দেখা হচ্ছে। তা-ও কম কিসে। এর মধ্যে দিয়ে জানা হলো একই নতুন ধারণা। যদিও মানুষ আগেও প্রচুর গাছ লাগিয়েছে। তবে গাছ কাটার হারের তুলনায় তা সামান্যই বলা চলে। কারণ বন উজাড় করে মানুষের বসতি গড়ার ফলে গাছ লাগানোর জায়গা সংকুলান না হওয়ায় মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়িয়েও কার্যকর ফল পাওয়া যাচ্ছিল না। ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে হিমবাহ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠ বেড়ে যাওয়ার শংকা রয়েছে আশংকাজনক। এর ফলে বহু আবাসস্থল ডুবে যাওয়ার পূর্বাভাস তো চোখ রাঙাচ্ছে রীতিমত।
গাছ লাগানোই সব নয়। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ICCCAD)-এর প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সুমাইয়া বিনতে সেলিম বলেন, ‘গাছ লাগালেই হবে না, তা বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিতে হবে। একটি গাছের মৃত্যু মানে একটি অক্সিজেনের ফুসফুস হারানো।’
তার মতে, আয়ানের উদ্যোগে ‘কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু’ ঘোষণার বিষয়টি কেবল সম্মানের নয়, বরং জনসচেতনতা তৈরির হাতিয়ার। যদি প্রতিটি পরিবার নিজেদের নতুন সদস্যের জন্য ১০-২০টি গাছও লাগায়, তবে সেটিই হবে সবুজ বিপ্লবের সূচনা।
বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৫ লাখ শিশু জন্ম নেয়। যদি প্রত্যেক নবজাতকের নামে গড়ে ৫০টি করে গাছ লাগানো হয়, তাহলে বছরে ১২৫ কোটি গাছ রোপণ সম্ভব-যা বাংলাদেশের বনভূমির পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ করে দিতে পারে।
এই ধারণা যদি নীতিনির্ধারকদের নজরে আসে, তাহলে নবজাতক জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে একটি ‘সবুজ জন্ম সনদ’ যুক্ত করা যেতে পারে- যেখানে থাকবে কতটি গাছ লাগানো হলো, কোথায় লাগানো হলো, ও কীভাবে তা রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। এই মডেলটি শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য হতে পারে এক অনন্য জলবায়ু-অভিযোজন পরিকল্পনা।
গাছ মানেই শুধু পরিবেশ নয়- এটি অর্থনীতিরও সহায়ক। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, একটি পরিপূর্ণ গাছ বছরে প্রায় ২০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করতে পারে। অন্যদিকে, ফলদ গাছ স্থানীয় পর্যায়ে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, গ্রামীণ অর্থনীতিতে আয়ে সহায়তা করে। যেমন কাঁঠাল, আম বা লেবুগাছ ভবিষ্যতে আয়ানের পরিবারের জন্য হবে আয়ের উৎস, একইসঙ্গে গ্রামের অন্য শিশুরা পাবে বিনামূল্যে ফলের স্বাদ।
এছাড়া গাছ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ পরিবেশে বেড়ে ওঠা শিশুদের মনোযোগ, মস্তিষ্কের বিকাশ ও সামাজিক সহমর্মিতা বেশি হয়। তাই আয়ান শুধু একটি প্রতীক নয়, বরং নতুন প্রজন্মের শিক্ষা ও মানবিকতার প্রতিফলন।
আয়ানের বাবা ইমরান রাব্বী বিশ্বাস করেন, ‘এই গাছগুলোই একদিন আমার সন্তানের জন্য বিশেষ সহায়তা হবে। প্রকৃতি কোনো না কোনোভাবে প্রতিদান দেয়।’
এমন ধারণা যদি প্রতিটি বাবা-মায়ের মধ্যে ছড়িয়ে যায়, তবে শিশুরা ছোটবেলা থেকেই শিখবে-প্রকৃতিকে ভালোবাসা মানে নিজেদের ভবিষ্যতকে ভালো রাখা। প্রতিটি স্কুল যদি তাদের শিক্ষার্থীদের নামে গাছ রোপণ করে, প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদ যদি ‘গাছের ব্যাংক’ তৈরি করে, তাহলে কার্বন-নিরপেক্ষ বাংলাদেশ আর কল্পনা নয়, বাস্তবতা হবে।
বাংলাদেশের প্রথম ‘কার্বন-নিরপেক্ষ শিশু’ আয়ান খান হয়তো এখনো কথা বলতে শেখেনি, কিন্তু তার জন্মই বলছে এক শক্তিশালী কথা- ‘আমি এই পৃথিবীকে নিঃশেষ নয়, নবজীবন দিতে এসেছি।’
এই উদ্যোগ শুধু আয়ানের নয়, বরং প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের দায়িত্বের প্রতিচ্ছবি। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহতা রোধে সরকার, সংগঠন ও জনগণের যৌথ প্রয়াস ছাড়া পথ নেই।
কিন্তু আশা এখানেই-একটি ছোট শিশুকে ঘিরে যখন একটি গ্রাম ৫৮০টি গাছ লাগায়, তখন বোঝা যায়, মানুষ এখনো প্রকৃতিকে ভালোবাসতে জানে।
সবশেষে, আয়ান যেন এক অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে-যে শিশু শেখায়, পৃথিবীকে ভালোবাসা মানেই নিজেকে ভালো রাখা। যদি প্রতিটি শিশু এমন একটি গাছের বন্ধু হয়ে বড় হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পাবে এক শীতল, সবুজ, প্রাণবন্ত পৃথিবী।
লেখক: অ্যাডভোকেট ও কলামিস্ট