Monday 27 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এ শহরে বেঁচে থাকতে পারাটাও বিলাসিতা

আজহার মাহমুদ
২৭ অক্টোবর ২০২৫ ১৫:৪৮

এদেশ এখন অনেক উন্নত এবং আধুনিক হচ্ছে। প্রায় প্রতিনিয়ত এই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। উন্নয়ন নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যাথাও নাই আজকাল। এদেশে সাধারণ মানুষ এখন সহজ সরল উক্তিতে বিশ্বাস করে। ‘খেয়ে-পরে সুস্থভাবে বাঁচতে চায়’ এদেশের সাধারণ মানুষ। তবে সেই বাঁচতে চাওয়াটাও এখন স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এখন এ দেশের উন্নত শহরগুলোতে বেঁচে থাকাটাও বিলাসিতার পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। শহরে এখন উন্নয়নের যন্ত্রাংশ ছিটকে পড়েও মানুষের মৃত্যু হয়।

বলছিলাম একজন সাধারণ জনতা আবুল কালামের কথা। গত ২৬ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টায় যার রক্তে ভিজে যায় ফার্মগেটের রাস্তা। প্রায় ১০০ কেজি ওজনের বিয়ারিং প্যাড খুলে আবুল কালামের মাথার ওপর আঁছড়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। নিজের রক্তের ওপর নিথর দেহ নিয়ে প্রাণহীন আবুল কালাম শুয়ে আছেন, এমন দৃশ্য এই উন্নত শহরে নিশ্চয় অস্বাভাবিক বলতে চাইবেন না কেউ। এসবই তো এ দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যে লেখা থাকে। কারণ উপর থেকে বিয়ারিং প্যাড, ইট, লোহা কিংবা অন্যকিছু পড়ে এ দেশে অসাধারণ কেউ মরে না। সব সাধারণ মানুষরাই মরে। তাই এতে কারও কোনো মাথাব্যাথা হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

বিজ্ঞাপন

আবুল কালামের মৃত্যুতে সরকারের খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তার জীবনের মূল্য পাঁচ লাখ টাকা, সেটা সরকার দিবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সেইসাথে তার পরিবারের একজনকে মেট্রোরেলে চাকরি দেওয়া হবে। এই তো হয়ে গেল জীবনের মূল্য!

মাত্র ৩৫ বছর বয়সেই দুনিয়ার জীবনখাতা বন্ধ হয়ে যাওয়া আবুল কালামের জন্য এর চাইতে বেশি রাষ্ট্র কি আর করতে পারে! এই রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের মূল্য এর চাইতেও কম হয় ক্ষেত্রবিশেষে। শুধু আবুল কালামের দুইটি শিশু বাবা হারা হলো। শৈশবে আবুল কালামও মা-বাবাকে হারিয়ে হয়েছিলেন এতিম। তাঁর দুইটি শিশুও আজ এতিম হয়েছেন। আবুল কালামের এতিম হওয়াটা যতটা না তাকে পীড়া দিতো, তার সন্তানরা যখন বুঝতে শিখবে তখন তাদের হাজারগুণ বেশি পীড়া দিবে হয়তো!

এক গণমাধ্যমে পড়লাম, আবুল কালাম তার বাচ্চাদের প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। রাজকীয়ভাবে তাদের লালনপালন করতেন তিনি। যখন এই শিশুরা বুঝতে শিখবে, আর্কাইভে তাদের বাবাকে নিয়ে সংবাদগুলো দেখবে তখন তাদের হৃদয়ে কতটা ধাক্কা লাগবে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা জানেন।

তার স্ত্রী এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সেদিন আবুল কালামকে বাসা থেকে বের হতে দিতে চাইছিলেন না। জোর করে বের হয়েছেন তিনি। সেই বের হওয়া একেবারে শেষ বের হওয়া হলো। জীবিত আবুল কালাম ফিরেছেন নিথর দেহ হয়ে।

আবুল কালাম হয়তো জীবিতও ফিরতে পারতেন। যদি দায়িত্বশীলরা আরেকটু দায়িত্ববান হতেন। গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মেট্রোরেলে এই জায়গাতেই একটি বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে। এ কারণে ওই সময় আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১১ ঘণ্টা বন্ধ থাকে ট্রেন চলাচল। বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ, নকশায় ভুলের কারণেই দ্বিতীয়বার বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে পথচারীর নির্মম মৃত্যুর ঘটনা ঘটলো।

এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে বলেও জানিয়েছেন। তবে সবসময়ের মতো এবারও তদন্ত কি কাগজের প্রতিবেদনেই সীমাবদ্ধ থাকবে কি-না সেটা দেখার বিষয়। কারণ গত বছরের ঘটনায়ও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এমন দুর্ঘটনা রোধে সে তদন্ত প্রতিবেদনে কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দেশে তদন্ত হয়, তবে সেই তদন্তের পর কোনো সুপারিশ আমলে নেওয়া হয় না। এটাই তো এদেশের সিস্টেম!

দেশের মানুষের জীবনের নিশ্চয়তা, আর্থিক স্বচ্ছলতাকেই এদেশের মানুষ উন্নয়ন ভাবতো একসময়। তবে গত এক দশক ধরে সেটা পরিণত হয়েছিলো অবকাঠামোগত উন্নয়নে। সেই উন্নয়নও যে অপ-উন্নয়ন, সেটাও এখন স্পষ্ট। ভবিষ্যতে এদেশের সাধারণ মাসুষের ভাগ্যে আরও কি কি লেখা আছে সেটা আল্লাহ মালুম।

তাছাড়া মেট্রোরেলের অতিরিক্ত নির্মাণব্যয় ও নি¤œমানের বিয়ারিং প্যাডের কেনাকাটা নিয়েও অনেক প্রশ্ন উঠেছিলো বিগত সময়ে। অনেক গণমাধ্যমে এসব নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়েছিলো। তবে বাংলায় প্রবাদ আছে, চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী। এটাই হয়ে আসছে এ দেশে।

আবুল কালাম তার ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘ইচ্ছে তো অনেক, আপাতত যদি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে পারতাম।’ তবে এভাবে পালাতে হবে সেটা আবুল কালামও ভাবতে পারেননি। হয়তো বিয়ারিং প্যাডের আঘাতে যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন, তখন তার দুটি অবুঝ শিশুর কথা ভেবেছেন। তাদের জন্য আরেকবার জীবনে ফিরে আসার ব্যার্থ চেষ্টাও হয়তো করছিলেন।

এই মৃত্যু অনেকের কাছে দুর্ঘটনা মনে হতে পারে, তবে দুর্ঘটনার আড়ালে এসব মৃত্যু অবকাঠামোগত হত্যা হিসেবেও বিবেচিত হয়। আবুল কালামের পরে হয়তো এই তালিকায় আপনি, আমি কিংবা আমাদের পরিবারের কেউ যুক্ত হবেন। সেটা মেট্রোরেলের যন্ত্রে হোক, কিংবা ছাদ থেকে ইট পড়ে। প্রস্তুত থাকতে হবে সবসময়, আর যতদিন বাঁচবো, ভাববো এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় বিলাসিতা।

লেখক: সাংবাদিক