Thursday 30 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

অর্থনীতিতে নোবেল ও উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি

ড. মিহির কুমার রায়
৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:৩১

সম্প্রতি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে অনেক আলোচনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে। বলা হয় উচ্চ প্রবৃদ্ধির দেশ কোনটি। একটি দেশ উন্নয়নের কোন স্তরে রয়েছে তার একটি নিয়ামক হলো মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) এর হার যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক স্থর বিবেচনা করে তা নির্ধারণ করা হয়। তবে প্রবৃদ্ধি মানে উন্নয়ন নয়। কোন দেশের অথনৈতিক অবস্থার গাণিতিক সূচক হিসাবে জিডিপির ধারণার প্রথম প্রস্তাব করেন আমেরিকান অর্থনীতিবিদ সায়মন কুজনেট ১৯৩৭ সালে যেখানে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেন জিডিপি কিভাবে একটি দেশের সার্বিক অর্থনীতির উন্নতি ও অবনতি নির্দেশ করে। তার মতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জিডিপি শুধু আর্থিক অবস্থার সূচক উন্নয়নে নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আইএমএফ বিশ্বব্যাংক একযোগে জিডিপিকে উন্নয়নের সূচক হিসাবে ব্যবহার করতে শুরু করে পরবর্তীতে এটাকেই উন্নয়নের পরিমাপ বলে গ্রহণ করে নেয়। তবে অনেক গবেষকই উন্নয়ন পরিমাপের ভ্রান্ত ধারণার সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সোচ্চার ছিলেন যার মধ্যে সর্বাগ্রে ছিলেন মোজেস আব্রামোভিজ যিনি ১৯৫৯ সালেই এর সমালোচনা করছেন। আর ২০১৯ সালে অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিতজ জিডিপিকে বাতিল করার আহ্বান জানান। তবে পঞ্চাশ দশকের ধ্রুপদি উন্নয়ন অর্থনীতিবিদরা বলেন টেকসই উন্নয়ন প্রবৃদ্ধির জন্য অর্থনৈতিক বিকাশ শ্রমসাধ্য অথচ দেশীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি অপরিহার্য এবং অর্থনীতিবিদ পেইকাং, রয় এফ হ্যারোড, ইভজি ডোমার ও রাবর্ট সলো দেখিয়েছেন দারিদ্র্য দেশগুলোর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দেশীয় সঞ্চয় বৃদ্ধি কতটা জরুরী। তাদের বক্তব্য ছিল কৃষি কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা কৃষকও জানেন ভবিষ্যতে উন্নতির জন্য যা দিয়ে জমি, কৃষি উপকরণ, যন্ত্রপাতি ক্রয় করা যায় যেখান থেকে বেশি ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়। পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে চীন দেশীয় সঞ্চয় বৃদ্ধির মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহ শুরু করে যার ফলে সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে চীনের জিডিপি কখনও বিশ শতাংশের নিচে নামেনি যা ২০০৮ সালে ৫২ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছানোর ঘটনা ঘটে।

বিজ্ঞাপন

এই বিষয়টি এখন আন্তর্জ্যাতিক পুরস্কারের ক্ষেত্র হয়ে দাড়িয়েছে যার প্রমান ২০২৫ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার যার বিষয় হলো উদ্ভাবননির্ভর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ব্যাখ্যা ও তাত্ত্বিক ভিত্তি তৈরি। এবছর অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জোয়েল ময়কার, ফ্রান্সের ফিলিপ এজিও এবং পিটার হাউইট। রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ সময় বিকেল চারটায় এই পুরস্কার ঘোষণা করে। এই পুরস্কারের আনুষ্ঠানিক নাম ‘দ্য স্ভেরিয়েস রিক্সব্যাংক প্রাইজ ইন ইকোনমিক সায়েন্সেস ইন মেমোরি অব আলফ্রেড নোবেল’। জোয়েল মোকিয়র ১৯৪৬ সালে নেদারল্যান্ডসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত। ফিলিপ আগিয়োঁ ১৯৫৬ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৮৭ সালে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। বর্তমানে তিনি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস, ইনসিয়াড এবং ফ্রান্সের কলেজ দ্য ফ্রঁস-এ অধ্যাপনায় নিযুক্ত আছেন।পিটার হাউইট ১৯৪৬ সালে কানাডায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করছেন। এ বছর পুরস্কারের আর্থিক মূল্য ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনা, যা প্রায় ১২ লাখ মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। এর অর্ধেক পাবেন জোয়েল মোকিয়র, আর বাকি অর্ধেক ভাগ করে নেবেন আগিয়োঁ ও হাউইট। প্রসঙ্গত, এই অর্থনৈতিক পুরস্কারটি মূলত নোবেল পুরস্কারের আনুষ্ঠানিক বিভাগ নয়। এটি ১৯৬৮ সালে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আলফ্রেড নোবেলের স্মরণে চালু করে। সেই থেকে প্রতিবছর এই পুরস্কার দিয়ে আসছে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস। সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেলের সম্মানে এই পুরস্কারের পুরো নাম রাখা হয় ‘আলফ্রেড নোবেল স্মৃতি রক্ষার্থে অর্থনীতিতে ভেরিজ রিক্সব্যাংক পুরস্কার।’ অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এ বছরের নোবেল মৌসুম শেষ হলো। । আগামী ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের স্টকহোমে আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

এখন আসা যাক মূল আলোচনায় যা এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক ।, গত দুই শতাব্দীতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশ্ব দেখেছে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। এর ফলে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি পেয়েছে বিপুলসংখ্যক মানুষ, আর এর ওপরই গড়ে উঠেছে আমাদের সমৃদ্ধির ভিত্তি। এ বছরের অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানী দেখিয়েছেন, কীভাবে উদ্ভাবন আরও অগ্রগতির প্রেরণা জোগায়। প্রযুক্তি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে এবং তা আমাদের সবার জীবনেই প্রভাব ফেলছে। নতুন পণ্য ও উৎপাদন পদ্ধতি পুরোনোকে প্রতিস্থাপন করছে এক নিরবচ্ছিন্ন চক্রে। এই ধারাবাহিক পরিবর্তনই টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল, যা বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনমান, স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক জীবনযাত্রার মান উন্নত করছে। তবে ইতিহাসে এমনটা সব সময় ঘটেনি, বরং দীর্ঘ সময় স্থবিরতাই ছিল স্বাভাবিক অবস্থা। মাঝেমধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার জীবনযাত্রার মান ও আয়ে সাময়িক উন্নতি আনলেও, তা টেকসই হয়নি—অবশেষে প্রবৃদ্ধি থেমে গিয়েছিল। জোয়েল ময়কার ঐতিহাসিক দলিলের মাধ্যমে খুঁজে দেখেছেন, কীভাবে টেকসই প্রবৃদ্ধি মানবসমাজে ‘নিউ নরমাল বা নয়া স্বাভাবিক’ অবস্থা হয়ে উঠল। তিনি দেখিয়েছেন, ধারাবাহিকভাবে উদ্ভাবন ঘটতে হলে কেবল কোনো কিছু কার্যকর তা জানাই যথেষ্ট নয়, বরং কেন তা কার্যকর—তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও জানা জরুরি। শিল্পবিপ্লবের আগে এই বৈজ্ঞানিক বোঝাপড়ার অভাবের কারণেই নতুন আবিষ্কারগুলোর ওপর ভিত্তি করে অগ্রসর হওয়া কঠিন ছিল। পাশাপাশি, সমাজের নতুন ধারণার প্রতি উন্মুক্ততা এবং পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর গুরুত্বও তিনি তুলে ধরেছেন। ফিলিপ এজিওঁ ও পিটার হাউইটও টেকসই প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করেছেন। ১৯৯২ সালে তাঁরা তৈরি করেন এক গাণিতিক মডেল, যার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয় ‘creative destruction বা সৃষ্টিশীল ধ্বংস’ প্রক্রিয়াকে। অর্থাৎ, যখন কোনো নতুন ও উন্নত পণ্য বাজারে আসে, তখন পুরোনো পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিযোগিতায় হার মানে। নতুন উদ্ভাবন তাই যেমন সৃষ্টিশীল, তেমনি ধ্বংসাত্মকও—কারণ এটি পুরোনো প্রযুক্তিকে অচল করে দেয়। বিভিন্নভাবে এই নোবেলজয়ীরা দেখিয়েছেন, সৃষ্টিশীল ধ্বংসের এই প্রক্রিয়া সংঘাতও সৃষ্টি করে, যা গঠনমূলকভাবে সামলাতে হয়। অন্যথায়, বড় কোম্পানি বা প্রভাবশালী স্বার্থগোষ্ঠী নিজেদের ক্ষতির আশঙ্কায় নতুন উদ্ভাবনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।‘নোবেলজয়ীদের গবেষণা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি স্বয়ংক্রিয় কিছু নয়।

আমাদের অবশ্যই সেই প্রক্রিয়াগুলো টিকিয়ে রাখতে হবে, যা সৃষ্টিশীল ধ্বংসকে সম্ভব করে তোলে। তা না হলে আমরা আবার স্থবিরতার যুগে ফিরে যেতে পারি। বর্তমান বিশ্বে প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষক বলেন, ‘মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে উচ্চ শুল্ক আরোপের যে হুমকি দিয়েছেন, সেটি একটি ঝুঁকি। প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হলো উন্মুক্ততা। এতে বাধা তৈরি করে এমন যে কোনো কিছু প্রবৃদ্ধির অন্তরায়।’ প্রযুক্তি খাতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব মোকাবিলায় ইউরোপকে সতর্ক হওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন এই গবেষক গন । তাই শেষ কথা হলো উদ্ভাবননির্ভর প্রবৃদ্ধি ব্যাখ্যা করে অর্থনীতিতে নোবেল মানব কল্যাণে কাজে আসুক এই প্রত্যাশা রইল ।

লেখক: সাবেক ডিন ও সিন্ডিকেট সদস্য, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এএসজি