Thursday 30 Oct 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আবর্জনার রাজ্যে বেঁচে থাকে জীবন

রাকিবুল ইসলাম
৩০ অক্টোবর ২০২৫ ১৯:৪৬

শহর যখন ঘুমিয়ে থাকে, তখনও তার হৃদপিণ্ড ধুকপুক করে। তবে সেই শব্দ আমাদের পরিচিত নয়। এখানে ভোরের আজান বা পাখির ডাকের বদলে শোনা যায় আবর্জনাবাহী ট্রাকের গর্জন আর বুলডোজারের ঘর্ঘর শব্দ। ঢাকার ফুসফুস যদি হয় কোনো সবুজ পার্ক, তবে এর পাকস্থলী নিঃসন্দেহে আমিনবাজারের এই সুবিশাল ল্যান্ডফিল। বলছি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আমিনবাজার ল্যান্ডফিলের কথা। ৫০ একর জায়গা জুড়ে ময়লা ফেলার জন্য নির্ধারিত এই স্থানে বর্তমানে আরও বিস্তৃত এলাকায় বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। প্রতিদিন এখানে ফেলা হয় প্রায় ৩২০০ টন বর্জ্য। এই ময়লার স্তূপের ভেতরেই প্রতিদিন সকালে জন্ম নেয় এক অন্য শহর—এক আশ্চর্য শহর, যেখানে আবর্জনাই জীবন, আর বেঁচে থাকাটাই জীবিকা।

বিজ্ঞাপন

টিপটিপ বৃষ্টির ভেতর এক ভোরের প্রতিচ্ছবি

ভোর ছয়টা টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। পচা জৈব ও রাসায়নিক বর্জ্যের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে চারপাশ ভারী হয়ে আছে। নিঃশ্বাস নেওয়াই কঠিন। ভোরের আবছা আলোয় ময়লার স্তুপগুলো দেখায় পাহাড়ের মতো—জীবন্ত, কিন্তু মৃতপ্রায়। সকাল সাড়ে ছয়টা বাজতেই ল্যান্ডফিলের প্রবেশপথে বাড়তে থাকে আনাগোনা। এদের বেশিরভাগই শিশু-কিশোর; পরনে ময়লা, ছেঁড়া জামা। হাতে বড় বস্তা আর ধারালো লোহার শিক। তারা এই ভাগাড়ের অলিখিত কর্মী।তাদের সকালের লক্ষ্য একটাই—ময়লার স্তূপের ভেতর থেকে প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা কাঁচ, শক্ত কাগজ, লোহার টুকরো বা পলিথিন খুঁজে পাওয়া।তাদের কোনো নির্দিষ্ট সময় নেই। ট্রাক আসামাত্রই শুরু হয় দৌড় কে আগে দামী কিছু পাবে, সেই নীরব প্রতিযোগিতা চলে প্রতিদিন ভোরে।

জীবিকা ও ঝুঁকির সমান্তরাল জীবন

আবর্জনার স্তূপে জীবনধারণের উপকরণ খুঁজে বের করা এক ভয়ংকর কাজ, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই ঝুঁকিপূর্ণ। ধারালো টিন, ভাঙা কাঁচ, সুচ, সিরিঞ্জ, ব্লেড বা পেরেক—এসবই তাদের প্রতিদিনের সঙ্গী। খালি পায়ে বা ছেঁড়া স্যান্ডেল পরে কাজ করার কারণে পা প্রায়ই কেটে যায়। হাতে গ্লাভস না থাকায় হাতও ক্ষতবিক্ষত হয়। এই ক্ষত থেকে জন্ম নেয় টিটানাস বা সেপটিসিমিয়ার মতো সংক্রমণ।আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেওয়া ব্যাটারি, কীটনাশকের বোতল, হাসপাতালের রাসায়নিক বর্জ্য, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কিংবা শিল্পবর্জ্য তাদের শরীরে নিঃশব্দে বিষ ঢেলে। এর ফলে দেখা দেয় ত্বকের রোগ, শ্বাসকষ্ট, স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা, এমনকি ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের আশঙ্কা। পচনশীল বর্জ্য হলো কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, জন্ডিস ও চর্মরোগের জীবাণুর ভান্ডার। এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে তারা প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে।

তার ওপর আছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি—বৃষ্টিতে ভিজে গেলে বিশাল স্তূপগুলো অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। কোনো দিন হঠাৎ ধসে পড়ে, আর তার নিচে চাপা পড়ে মরে যায় কেউ একজন—যার খবর শহরের কেউ রাখে না।

অদৃশ্য অথচ অপরিহার্য অর্থনীতি

ঢাকার এই বর্জ্য সংগ্রাহকরা শহরের অর্থনীতির এক নীরব অংশ। তাদের শ্রমেই রিসাইক্লিং শিল্প সচল। তারা শহরের আবর্জনা থেকে আলাদা করে দেয় প্লাস্টিক, লোহা, কাগজ, বোতল—যেগুলো পরে রূপ নেয় নতুন কাঁচামালে।তাদের সংগ্রহ করা জিনিসপত্র থেকেই গড়ে ওঠে প্লাস্টিক দানা, রড, কাগজের মণ্ড ও নানা পণ্য। এভাবেই তারা এক বিশাল শিল্পকে টিকিয়ে রাখে, অথচ নিজেরা থাকে অনানুষ্ঠানিকতার ছায়ায়। কোনো শ্রম আইন, সুরক্ষা বা ন্যায্য মজুরি নেই তাদের।ভাঙারি ব্যবসায়ীরা নির্ধারণ করে দামের হার, আর তারা বাধ্য হয় সেই দামেই বিক্রি করতে। তবুও প্রতিদিন এই শিশু-কিশোররা ফিরে আসে ভাগাড়ে, কারণ অন্য কোনো বিকল্প নেই।সমাজ তাদের ডাকে ‘টোকাই’—একটি শব্দ, যা আসলে শ্রেণিবৈষম্যের প্রতীক। অথচ তারাই শহরকে বাঁচিয়ে রাখে পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিয়ে।

সকাল, যুদ্ধ আর এক চিলতে আশা

সকাল ৯টা। টিপটিপ বৃষ্টি থামেনি। দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। চারপাশে কাক, চিল আর মানুষের এক অদ্ভুত সহাবস্থান।বুলডোজারের গর্জনের সঙ্গে মিশে যায় শিশুদের চিৎকার, হাসি, দৌড়ঝাঁপ। এখানে সকাল মানে এক মুঠো ভাতের জন্য লড়াই।

এখানে সকাল মানে আবর্জনার ভেতর থেকে নিজের ভবিষ্যৎ খোঁজার করুণ প্রচেষ্টা। এখানে বিশ্রাম মানে ময়লার পাহাড়ের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে থাকা।এই মানুষদের কাছে শহরের সকালের সৌন্দর্য—শিশিরভেজা ঘাস, সূর্যের মোলায়েম আলো বা পাখির গান—কোনো অর্থই বহন করে না। তাদের সকাল মানেই যুদ্ধ, যেখানে প্রতিপক্ষ হলো ক্ষুধা।সিটি করপোরেশনের ট্রাকগুলো যখন আবর্জনা ফেলে রেখে চলে যায়, তখন এই মানুষগুলো সেই বর্জ্যের ভেতর থেকে জীবনের উপাদান খুঁজে নেয়।এই ভাগাড় শুধু একটি আবর্জনা ফেলার জায়গা নয়; এটি এক জীবন্ত শহর, যেখানে সকাল নামে হতাশা নিয়ে, তবু জেগে থাকে এক চিলতে আশা।

আমিনবাজারের ভাগাড়ে সকাল নামে যখন, তখন শহরের অন্য প্রান্তে শুরু হয় বিলাসিতার দিন। এক প্রান্তে যখন শিশুরা স্কুলে যায়, অন্য প্রান্তে তখন শিশুরা হাত বাড়াচ্ছে ময়লার স্তূপে।এই শিশুরা দারিদ্র্যের নয়, আমাদের সামাজিক উদাসীনতার প্রতীক। তারা শহরের বর্জ্য পরিষ্কার করে, অথচ শহরই তাদের চোখে ময়লা ছুড়ে দেয়।রাষ্ট্র, সমাজ ও নাগরিক—সবাইকে ভাবতে হবে, এই শিশুদের ভবিষ্যৎ কেমন হবে? বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় যারা প্রথম সারিতে কাজ করছে, তাদের স্বীকৃতি, নিরাপত্তা ও পুনর্বাসন জরুরি।শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপদ জীবিকার সুযোগ দিতে হবে তাদের। কারণ, তারা সমাজের বোঝা নয়—অদৃশ্য শ্রমিক, যারা আমাদের শহরটিকে টিকিয়ে রেখেছে।একটি শহরের সভ্যতা মাপা হয় তার আকাশচুম্বী দালান দিয়ে নয়, বরং তার সবচেয়ে প্রান্তিক মানুষের জীবনে কতটা আলো পৌঁছায়, তা দিয়ে।যেদিন আমিনবাজারের ভাগাড়ের শিশুরা স্কুলের পথে হাঁটবে, সেদিনই এই শহরে সত্যিকার অর্থে সকাল নামবে।

লেখক: সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর