দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির মানচিত্রে সবচেয়ে অস্থিতিশীল সীমান্ত যদি কোনোটি হয়, তা হলো আফগানিস্তান–পাকিস্তান সীমান্ত। বহু দশক ধরে এই সীমান্ত শুধু ভৌগোলিক বিভাজন নয়, বরং রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সন্ত্রাসবাদী ও ভূ–রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষমঞ্চ। ২০২৫ সালের শেষ দিকে এসে সেই পুরোনো উত্তেজনা আবারও নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে। সীমান্তে গোলাগুলি, পারস্পরিক বিমান হামলা, আর পরবর্তী শান্তি আলোচনা সব মিলিয়ে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সম্পর্ক সবসময়ই দ্ব্যর্থতায় ভরা। ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতে আঁকা ‘ডুরান্ড লাইন’ আজও এই সম্পর্কের প্রধান বিভাজক রেখা। পাকিস্তান একে তার আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে মেনে নেয়, কিন্তু আফগানিস্তান তা কখনোই স্বীকার করেনি। ফলে এই রেখা বরাবর বসবাসকারী পশতুন জাতিগোষ্ঠীর জীবন জুড়ে রয়েছে দ্বৈরথ ও বিভাজনের বেদনা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যখনই দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন বেড়েছে, এই সীমান্তই হয়ে উঠেছে সংঘাতের আগুন।
২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর পাকিস্তান শুরুতে আশা করেছিল, আফগানিস্তানে একটি ‘বন্ধুত্বপূর্ণ সরকার’ প্রতিষ্ঠা পেলে সীমান্ত পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল হবে। কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা। পাকিস্তান এখন অভিযোগ করছে—আফগান ভূখণ্ডে আশ্রয় নিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। অন্যদিকে, তালেবান প্রশাসনের বক্তব্য, তারা এই গোষ্ঠীর কার্যক্রম পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই পারস্পরিক অভিযোগই আজ সীমান্তের প্রতিটি চেকপোস্টে সন্দেহ ও ক্ষোভের বাতাবরণ তৈরি করেছে।
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংঘর্ষ পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আফগান সীমান্তের কিছু এলাকায় বিমান হামলা চালায়, দাবি করে তারা সন্ত্রাসীদের ঘাঁটি লক্ষ্যবস্তু করেছে। এর পরপরই আফগান বাহিনী পাল্টা প্রতিক্রিয়া জানায় সীমান্ত বরাবর। কয়েক দিনের মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এমন মাত্রায় পৌঁছায় যে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো সম্ভাব্য ‘খোলা যুদ্ধ’-এর আশঙ্কা উত্থাপন করে। বেসামরিক মানুষের মৃত্যু, সীমান্তে ঘরবাড়ি ধ্বংস, আর শরণার্থী আশ্রয়ের হাহাকার— সব মিলিয়ে পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হতে থাকে।
এই ভয়াবহ অবস্থার মধ্যেই শুরু হয় শান্তি আলোচনার প্রচেষ্টা। দোহা ও ইস্তাম্বুলে কয়েক দফা বৈঠকে বসে দুই দেশের প্রতিনিধি দল। মধ্যস্থতা করে কাতার ও তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্রও দূর থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করে। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল সীমান্তে যুদ্ধবিরতি ও টিটিপি–সংক্রান্ত সমঝোতা। প্রথম দিকে কিছুটা আশাবাদ দেখা গেলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়। আফগান পক্ষ স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, তারা পাকিস্তানের দাবিমতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক অভিযান চালাবে না। পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ছিল কড়া—তারা বলে, ‘যদি আফগানিস্তান কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাহলে পাকিস্তান নিজেই সীমান্তের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।’ অর্থাৎ, আরেক দফা সামরিক অভিযানও অস্বীকার করা যায় না।
দুই দেশের মধ্যে এই অবিশ্বাসের দেয়াল শুধুই সামরিক নয়, রাজনৈতিকও বটে। আফগানিস্তানের তালেবান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে এখনও পূর্ণ স্বীকৃতি পায়নি। ফলে তারা অনেক ক্ষেত্রে একপ্রকার কূটনৈতিক একাকিত্বে ভুগছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান নিজের ভেতরেই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। বৈদেশিক মুদ্রার অভাব, জ্বালানি ঘাটতি, রাজনৈতিক অস্থিরতা—সব মিলিয়ে ইসলামাবাদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী সীমান্ত সংঘর্ষ আরেকটি চাপের বোঝা। কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকার জনমতের চাপে আপস করতে পারছে না। ফলে যুদ্ধ ও কূটনীতির মধ্যে দোদুল্যমান এই অবস্থাই তৈরি করেছে বর্তমান অনিশ্চয়তা।
এমন পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোও উদ্বিগ্ন। ভারত, চীন ও রাশিয়া তিন দেশই আলাদাভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। ভারত বরাবরের মতো পাকিস্তানকে দায়ী করছে ‘সন্ত্রাসবাদে উৎসাহ দেওয়ার’ জন্য, আর পাকিস্তান বলছে ভারত তাদের সীমান্ত অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্রে যুক্ত। অন্যদিকে চীন, যাদের বড় অর্থনৈতিক বিনিয়োগ রয়েছে পাকিস্তানে (বিশেষত চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর), তারা চায় না এই সংঘাত তাদের বাণিজ্য স্বার্থে আঘাত করুক। তাই বেইজিং শান্তিপ্রক্রিয়া টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী।
এই আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশেরও কিছু উদ্বেগ আছে। সরাসরি সংঘাতে জড়িত না হলেও, এ ধরনের উত্তেজনা দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে। যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়লে শরণার্থী সংকট ছড়িয়ে পড়তে পারে, বাণিজ্যপথ ব্যাহত হতে পারে, এমনকি জ্বালানি সরবরাহেও প্রভাব পড়তে পারে। বাংলাদেশ সবসময় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পক্ষে—তাই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী এই সংঘাত সমাধানে মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর উদ্যোগকে সমর্থন করাই উচিত।
প্রশ্ন হলো, এই অবস্থা থেকে পথ বের হবে কীভাবে? প্রথমত, দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই। ইতিহাস বলে, তৃতীয় পক্ষের চাপ দিয়ে হয়তো যুদ্ধ থামানো যায়, কিন্তু স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা হয় না। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে নিজেদের রাজনৈতিক সাহস দেখাতে হবে বিশ্বাস পুনর্গঠন করতে হবে মাঠপর্যায়ের সীমান্ত কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে মন্ত্রীস্তর পর্যন্ত। দ্বিতীয়ত, উভয় দেশকেই সন্ত্রাসবাদবিরোধী অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। আফগানিস্তান যদি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে চায়, তাহলে তাদের এই প্রমাণ দিতে হবে যে, তারা আর কোনো দেশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীর আশ্রয়স্থল নয়। তৃতীয়ত, সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষের জীবনে উন্নয়ন আনতে হবে। যতদিন দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও বঞ্চনা থাকবে, ততদিন সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো সহজেই মানুষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করবে।
তবে এসব পরামর্শের বাস্তবায়ন সহজ নয়। কারণ এখানে শুধু দুই দেশের সম্পর্ক নয়, যুক্ত রয়েছে বৃহত্তর ভূ–রাজনৈতিক শক্তির খেলা। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া—প্রত্যেকেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানকে নিজেদের প্রভাব বলয়ের মধ্যে টানতে চায়। ফলে, এক দেশের শান্তি অন্য দেশের উদ্বেগ হয়ে দাঁড়ায়। এই ক্ষমতার প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষই হারাচ্ছে সবচেয়ে বেশি— সীমান্তের পশতুন গ্রামগুলোতে আজও গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়, শিশুদের স্কুল বন্ধ, কৃষকরা মাঠে যেতে পারে না, বাণিজ্যপথ স্থবির।
তারপরও, আশার আলো পুরোপুরি নিভে যায়নি। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে আলোচনার নতুন রাউন্ডের খবর পাওয়া গেছে, যেখানে জাতিসংঘের অংশগ্রহণও সম্ভব বলে জানা যায়। হয়তো সাময়িক যুদ্ধবিরতি বা সীমান্তে যৌথ টহলের মতো কিছু ব্যবস্থা আসতে পারে। এসব পদক্ষেপ স্থায়ী সমাধান না হলেও, রক্তপাত ঠেকাতে পারে—যা এখন সবচেয়ে জরুরি।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তান দুই দেশই যুদ্ধ ক্লান্ত। উভয় দেশের জনগণ শান্তি চায়, নিরাপত্তা চায়, স্বাভাবিক জীবন চায়। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি তা বোঝে, যদি তারা নিজেদের স্বার্থের বাইরে গিয়ে জনগণের স্বার্থে ভাবতে পারে—তবেই এই দীর্ঘ রক্তপাতের ইতি ঘটানো সম্ভব। অন্যথায়, ইতিহাস যেমন দেখিয়েছে, নতুন প্রজন্মও হয়তো উত্তরাধিকার হিসেবে পাবে সীমান্তের গোলাগুলি, মৃত্যু ও অবিশ্বাসের এক অশেষ কাহিনি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়