Saturday 01 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’: উন্নয়ন না ঋণের ফাঁদ?

সাদিয়া সুলতানা রিমি
১ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:১৭

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৩ সালে যখন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা সংক্ষেপে BRI ঘোষণা করলেন, তখন অনেকে ভাবলেন এ যেন এক নতুন উন্নয়নের সূচনা। পুরনো সিল্ক রোডের আদলে তৈরি এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানো। কিন্তু এক দশক পার হতে না হতেই প্রশ্ন উঠেছে এটি কি সত্যিই উন্নয়নের রূপরেখা, নাকি আসলে এক নতুন ধরনের ঋণের জাল?

চীনের দাবি, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ হলো ‘উইন-উইন পার্টনারশিপ’, যেখানে সবাই লাভবান হবে। অবকাঠামো, বন্দর, রেলপথ, বিদ্যুৎকেন্দ্র—সবকিছু তৈরি হবে সহযোগিতার ভিত্তিতে। এই প্রকল্পে ইতিমধ্যেই ১৫০টিরও বেশি দেশ যুক্ত হয়েছে, আর চীনের বিনিয়োগের পরিমাণ ট্রিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানের ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর’, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোট বন্দর, আফ্রিকার রেলপথ এসবই এই উদ্যোগের দৃশ্যমান ফল। অনেক আফ্রিকান দেশ এখন এই প্রকল্পের কারণে বিদ্যুৎ পাচ্ছে, শিল্প কারখানা গড়ে তুলছে, বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। তবে এই প্রকল্পের ভেতরে লুকিয়ে আছে এক বড় রাজনৈতিক কৌশল। অর্থনৈতিক সহযোগিতার আড়ালে চীন আসলে ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি আজ স্পষ্ট। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, মালদ্বীপ সবখানে চীনের বিনিয়োগ। এই বন্দরগুলো শুধু বাণিজ্যের নয়, ভবিষ্যতে কৌশলগত ঘাঁটিতেও পরিণত হতে পারে। একে অনেকেই বলেন, ‘স্ট্রিং অব পার্লস’ অর্থাৎ মুক্তার মালার মতো একের পর এক চীনা প্রভাবকেন্দ্র।

সমালোচকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ এখানেই। তারা বলেন, BRI প্রকল্পে চীন এমনভাবে ঋণ দেয় যে, শেষ পর্যন্ত দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে কৌশলগতভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে আলোচিত উদাহরণ শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোট বন্দর। ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়ে দেশটি বন্দরের নিয়ন্ত্রণ ৯৯ বছরের জন্য চীনের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাকে অনেকে বলেন ‘Debt Trap Diplomacy’— অর্থাৎ ঋণের ফাঁদে ফেলে কূটনৈতিক নিয়ন্ত্রণ নেওয়া।

একই ধরণের সংকটে পড়েছে জাম্বিয়া, লাওস, কেনিয়া, এমনকি পাকিস্তানও। চীনা ব্যাংকের সুদের হার অনেক সময় বাণিজ্যিক, অর্থাৎ তুলনামূলক বেশি। ফলে ঋণ শোধ না করতে পারলে, প্রকল্পের মালিকানাই হারিয়ে যাচ্ছে অনেক দেশে। চীন অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলে, সবকিছুই পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, উন্নয়নশীল অনেক দেশ এই ‘সহযোগিতা’-র বোঝা বইতে গিয়ে বিপদে পড়ছে।

বাংলাদেশও BRI-এর অংশীদার। পদ্মা রেল সংযোগ, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, বিদ্যুৎ প্রকল্প এসবের কিছুতে চীনা অর্থায়ন আছে। তবে বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত তুলনামূলকভাবে সতর্কভাবে ঋণ নিচ্ছে। সরকার চীনের পাশাপাশি জাপান, এডিবি, বিশ্বব্যাংক সব দিক থেকেই অর্থায়ন নিচ্ছে। ফলে ঝুঁকি ছড়ানো আছে, একদিকে কেন্দ্রীভূত নয়। তবে ভবিষ্যতে যদি চীনা বাণিজ্যিক ঋণ বেড়ে যায়, তাহলে অর্থনৈতিক চাপে পড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

চীনের এই উদ্যোগ পশ্চিমা বিশ্বকে স্পষ্টভাবে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর জবাবে ‘Build Back Better World (B3W)’ এবং ‘Global Gateway’ নামে বিকল্প প্রকল্প চালু করেছে। তাদের লক্ষ্য, উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীনের ঋণনির্ভর পথ থেকে বিকল্প অর্থায়নের সুযোগ দেওয়া। ভারতও এই প্রকল্পে যোগ দেয়নি। কারণ চীনের ‘চায়না-পাকিস্তান করিডর’ কাশ্মীরের বিতর্কিত অঞ্চল দিয়ে গেছে যা ভারতের কাছে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন।

BRI একদিকে উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, অন্যদিকে তৈরি করছে নতুন নির্ভরতা। চীনের পুঁজি অনেক দেশে শিল্প গড়ছে, কিন্তু সেই শিল্পের নিয়ন্ত্রণও চীনের হাতে থেকে যাচ্ছে। ফলে অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এটি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক উপনিবেশবাদের সূচনা হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য চীনের মতো দ্রুত অর্থায়নের বিকল্প এখনো খুব কম। বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ যেখানে শর্ত আরোপ করে, সেখানে চীন অর্থ দেয় অপেক্ষাকৃত সহজে।

বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে এক কথায় ভালো বা খারাপ বলা যায় না। এটি উন্নয়নের সুযোগ, আবার কৌশলগত ঝুঁকিও। যে দেশগুলো এই সুযোগকে সঠিকভাবে পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করতে পারবে তাদের জন্য এটি উন্নয়নের হাতিয়ার। কিন্তু যারা অন্ধভাবে ঋণ নিচ্ছে, তাদের জন্য এটি হতে পারে ভবিষ্যতের বোঝা। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি হলো ব্যালান্সড কূটনীতি যেখানে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকবে, কিন্তু নির্ভরতা নয়; সহযোগিতা থাকবে, কিন্তু শর্ত নিজের হাতে।

চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ নিঃসন্দেহে ২১ শতকের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক প্রকল্প। এটি যেমন নতুন উন্নয়নের দিগন্ত খুলছে, তেমনি আনছে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ।অতএব, এই উদ্যোগকে আমরা ‘ঋণের ফাঁদ’ বলে অবহেলা করতে পারি না, আবার ‘উন্নয়নের একমাত্র রাস্তা’ হিসেবেও দেখলে ভুল হবে। সময় এসেছে বাস্তবতা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়ারউন্নয়ন যেন হয় নিজের শর্তে, অন্যের ছায়ায় নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়