Monday 03 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাড়ছে ক্ষুধার্ত মানুষ, তারপরও খাদ্য অপচয়ে শীর্ষে বাংলাদেশ

ড. মিহির কুমার রায়
৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:৫৭

ক্ষুধা কোনো অনিবার্য প্রাকৃতিক অবস্থা নয়; এটি হলো সরকার এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পছন্দের ফল, যা বৈষম্যের প্রতি চোখ ফেরাতে বেছে নিয়েছে। যে বৈশ্বিক ব্যবস্থা ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষের পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকার অস্বীকার করে, সেই একই ব্যবস্থা মাত্র ৩,০০০ বিলিয়নেয়ারের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকে বৈশ্বিক মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪.৬ শতাংশের মালিকানা ধরে রাখতে সক্ষম করে। এই চরম বৈষম্য প্রমাণ করে যে, মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য সম্পদের অভাব নেই, অভাব রয়েছে ন্যায়সঙ্গত বণ্টন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার। জীবন টিকে থাকে খাদ্যের ওপর। মানুষের মৌলিক চাহিদার তালিকায় খাদ্যই সর্বাগ্রে, কারণ অন্নই জীবনের প্রাণস্বর। অথচ বিস্ময়ের বিষয়-আজ পৃথিবীতে খাদ্য উৎপাদনের প্রাচুর্য থাকলেও, কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর। পৃথিবীতে যত খাদ্য উৎপাদিত হয়, তা দিয়ে বৈশ্বিক জনসংখ্যার দেড়গুণ মানুষকে আহার করানো সম্ভব। তবু আজও প্রায় ৭৮৩ মিলিয়ন মানুষ অভুক্ত, আর বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ ভুগছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায়। কেন এমন বৈষম্য এর মূল কারণ উৎপাদনের ঘাটতি নয়, বরং অপচয়, অব্যবস্থাপনা ও অসম বণ্টন। পৃথিবীর মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ নষ্ট বা অপচয় হয়-যার পরিমাণ দৈনিক ১ বিলিয়ন মিল। বছরে এই ক্ষতির অর্থমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১ ট্রিলিয়ন ডলার। শুধু অর্থ নয়, এর সঙ্গে নষ্ট হয় মূল্যবান জমি, পানি, শ্রম ও শক্তি-নষ্ট হয় মানবতার চেতনা। খাদ্য পচনের ফলে নির্গত গ্রিনহাউস গ্যাসের অংশ প্রায় ১০ শতাংশ । ব্রাজিল তার জি২০ প্রেসিডেন্সির সময় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জোটও (গ্লোবাল এলিয়েন্স এগিনেস্ট হাংগার এন্ড প্রোভার্টি) প্রস্তাব করেছিল। এই উদ্যোগে ইতোমধ্যে ২০০ সদস্য রয়েছে, ১০৩টি দেশ এবং ৯৭টি অংশীদার ফাউন্ডেশন ও সংস্থা। এই জোটটি কেবল অভিজ্ঞতা বিনিময়ের জন্য নয়, বরং সম্পদ একত্রিত করা এবং প্রতিশ্রুতি সুরক্ষিত করার জন্য কাজ করবে। এই জোটের মাধ্যমে, দেশগুলোকে এমন জননীতি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম করা হবে যা সত্যিই বৈষম্য হ্রাস করে এবং পর্যাপ্ত খাদ্যের অধিকার নিশ্চিত করে। ব্রাজিলের অভিজ্ঞতা এই উদ্যোগের ভিত্তি। যখন দেশটি ২০২৩ সালে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইকে সরকারি অগ্রাধিকার দিয়েছিল, তখন দ্রুত ফলাফল এসেছিল। গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস অনুযায়ী, ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত ৮ বছর বিশ্বের যেসব দেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে অবস্থান করছিল সেখানে বাংলাদেশ ছিল তৃতীয়। জিআরএফসির রিপোর্ট মতে, তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে সর্বোচ্চ স্তরে ছিল নাইজেরিয়ার মানুষ ৩১.৮ মিলিয়ন, সুদান ও কঙ্গোর ২৫.৬, বাংলাদেশের ২৩.৬, ইথিওপিয়ার ২২, ইয়ামেনের ১৬.৭, আফগানিস্তানের ১৫.৮, মিয়ানমারের ১৪.৪, পাকিস্তানের ১১.৮ মিলিয়ন।

বিজ্ঞাপন

র্বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের মধ্যে রয়েছে। প্রায় ২৪ শতাংশ বা প্রতি চারজনের মধ্যে একজন মানুষ বসবাস করছে বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে। এ ধরনের দারিদ্র্যের হার শহরের তুলনায় গ্রামে প্রায় দ্বিগুণ। প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মধ্যে বেশি। জিইডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, গ্রামাঞ্চলে এ হার ২৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ১৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ। শিশুদের মধ্যে এ হার ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ২১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ৬৩ শতাংশ মানুষ পুষ্টিমানসমৃদ্ধ খাবার পায় না। তাতে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করছে। এসবের অন্যতম কারণ খাদ্যপণ্যের বিশাল অপচয়। বাংলাদেশ খাদ্য অপচয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার শীর্ষ ৫ দেশের একটি। খাদ্য নষ্ট হয়ে থাকে উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে। সে হিসেবে বছরে উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় ৩৪ শতাংশই নষ্ট হয়। তা ছাড়া ২০১৬-২০২৪ সাল পর্যন্ত যেসব দেশ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উচ্চস্তরে অবস্থান করছিল সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তৃতীয়। ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনইপি) ‘ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স ২০২৪’ ও ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস (জিআরএফসি) ২০২৫’-এর প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের একটি বাড়িতে বছরে ৮২ কেজি খাদ্য নষ্ট হয়। খাদ্য নষ্টের তালিকায় বিশ্বের শীর্ষস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ। দেশটি বছরে পরিবারপ্রতি ২০৭ কেজি খাদ্য নষ্ট করে। পাকিস্তানে হয় ১৩০, আফগানিস্তানে ১২৭, নেপালে ৯৩, বাংলাদেশ ৮২, শ্রীলঙ্কা ও চীনে ৭৬, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭৩ ও ভারতে ৫৫ কেজি।

সম্প্রতি বিশ্ব খাদ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য চাল। সেই চালের প্রস্তুতির পূর্বে পোস্টহার্ভেস্ট পর্যায়ে ধান নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ। ফসল কাটার পর ধানের গড় ক্ষতি বা নষ্ট হয় ১৭.৮০ শতাংশ কৃষক, মধ্যস্বত্বভোগী এবং মিলারদের স্তরে নষ্ট হয় ১৪.০২ শতাংশ, পরিবহনে ১.৪, মাড়াইয়ে ১.৭, ঝাড়ায় ১.৫, শুকানোতে ২.৬, সংরক্ষণে ৬.৮, মধ্যস্বত্বভোগীতে ১.৬২ এবং মিলারদের ক্ষেত্রে ২.১২ শতাংশ,গমের গড় ক্ষতি ১৭.৫৯ শতাংশ, ফল এবং শাকসবজি কাটার পর ১৭ থেকে ৩২ শতাংশ ,আম ৩১.৭, কলা ১৯.৯, আলু ২১.৮, গাজর ২৬.৮, টমেটো ২৭.৯ শতাংশ। তবে সার্ক কৃষি তথ্যের হিসেবে, বাংলাদেশে বার্ষিক শস্য অপচয় ১২.৯ শতাংশ, শিকড় ও কন্দ ৩৬.৯, তৈলবীজ ও ডাল ১০.৩, ফল ও শাকসবজি ৪০.২, মাংসজাত দ্রব্য ১৪.৯, মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্য ৩০.২, দুগ্ধজাত দ্রব্য ১৭.৫ এবং অন্যান্য খাদ্য ২৪.৯ শতাংশ। গরু ও মহিষের দুধ দোহনের পর নষ্ট হয় ২৪.৩৭ শতাংশ। এর মধ্যে গরুর ৮.০৭ এবং মহিষের ১৫.৬৭ শতাংশ, ডিম নষ্ট হয় ১২.৯ শতাংশ, হাঁস ও মুরগির মাংস ১৬.৯, গরু ও মহিষের মাংস ২১.৪ শতাংশ নষ্ট হয়। তা ছাড়া মাংস এবং মাংসজাত দ্রব্য ৫-৯ এবং দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের প্রক্রিয়াজাতকরণে নষ্ট হয় ৮-১২ শতাংশ। ছোট মাছ ধরার পর নষ্ট হয় ২৫.৪৫ ও কার্পজাতীয় মাছ ১৮.১৩ শতাংশ। মাছের পাত্র বাঁশের ঝুড়িতে ২৩ শতাংশ, ফ্রিজে ২.৫ শতাংশ পর্যন্ত মানের ক্ষতি হ্রাসে ভূমিকা রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, ধনী পরিবারগুলোতে খাদ্যের অপচয় সবচেয়ে বেশি। আর দরিদ্র পরিবারগুলোতে সবচেয়ে কম। উচ্চ আয়ের গোষ্ঠীর ১০০ শতাংশ পরিবার প্রতি সপ্তাহে ০.৫ থেকে ২.০ কেজি খাদ্য অপচয় করে। অর্থাৎ তারা প্রতিবছর প্রায় ২৬-১০৪ কেজি খাদ্য অপচয় করে।

একসময় আমাদের গ্রামীণ সমাজে অপচয় ছিল লজ্জার বিষয়। অগ্রহায়ণ মাসে ফসল কাটার পর মাঠে ছিটকে থাকা ধান শিশুরা কুড়িয়ে আনত, গৃহিণীরা প্রতিটি দানা সযত্নে তুলত। আজ সেই সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আমরা যেন কৃতজ্ঞতা ও সংযম-এই দুটি মানবিক গুণ হারাতে বসেছি। অপচয় রোধে আধুনিক প্রযুক্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সচেতনতা ও মূল্যবোধের নবজাগরণ। সরকার ও বেসরকারি খাতের পাশাপাশি নাগরিক সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিপণ্যের সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বিপণনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণই পারে পরিস্থিতি পাল্টাতে। আজ আমরা যখন অর্ধেক খাওয়া খাবার বিনা দ্বিধায় ফেলে দিই, তখন কেবল খাদ্য নয়-ঐশ্বরিক অনুগ্রহও অপচয় করি। মনে রাখা দরকার, প্রতিবেশীর ক্ষুধা আমাদেরই ব্যর্থতা। খাদ্য অপচয় তাই কেবল অর্থনীতি বা পরিবেশের নয়, এক গভীর মানবিক ও ধর্মীয় দায়ও বটে। প্রতিটি দানা খাদ্য কোনো কৃষকের ঘামের প্রতীক। এর লাগাম টানা দরকার। নতুবা আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে, আর্থিক ক্ষতি বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। এমতাবস্থায় খাদ্য অপচয় ও ক্ষতিরোধে সরকার, বেসরকারি খাত ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। উপযুক্ত কার্যপরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে আধুনিক কলাকৌশল গ্রহণের সঙ্গে কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া এবং তাদেরকে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন।

লেখক: গবেষক ও অধ্যাপক