Tuesday 04 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়: অবস্থান, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

সাদিয়া সুলতানা রিমি
৪ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:৪৪

গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে একটি রাষ্ট্রের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আর শুধু তার দেশের সীমানার ভেতরে সীমাবদ্ধ করে দেখা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জ্ঞান ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে এখন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অংশ। তাই বিশ্বের শীর্ষ র‍্যাংকিং তালিকায় একটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপস্থিতি শুধু মর্যাদার বিষয় নয়, বরং তা একটি দেশের শিক্ষা মান, গবেষণা সক্ষমতা ও মানবসম্পদের প্রতিফলন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোথায় দাঁড়িয়ে? কেন পিছিয়ে আছে? আর এই অবস্থান থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার উপায়ই বা কী?

বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে আলোচিত দুটি প্ল্যাটফর্ম হলো যুক্তরাজ্যভিত্তিক QS World University Rankings এবং Times Higher Education (THE) World University Rankings। এই তালিকাগুলোতে বিশ্বের হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয় নানা সূচকের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হয়— যেমন গবেষণা, একাডেমিক সুনাম, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী উপস্থিতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, উদ্ধৃতির পরিমাণ, শিল্প সহযোগিতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান এসব তালিকায় অংশ নেয় বটে, কিন্তু শীর্ষ স্থানে পৌঁছাতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে THE র‍্যাংকিংয়ে সাধারণত ৮০১–১০০০ অথবা তারও পরের ক্যাটাগরিতে রাখা হয়। QS র‍্যাংকিংয়েও এটি প্রায় ১০০১+ স্তরে অবস্থান করে। বুয়েটও কখনও কখনও সামান্য ভালো জায়গায় উঠে এলেও, এখনও তা বিশ্বের সেরা ৫০০ এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। অর্থাৎ সার্বিকভাবে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ ৫০০ এর তালিকায় এখনও জায়গা করে নিতে পারেনি।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থানের পেছনে প্রথমত যে কারণটি সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য তা হলো গবেষণার পরিমাণ ও মান। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় মানেই শুধু ক্লাসরুমে জ্ঞান বিতরণ নয়; বরং নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা সংস্কৃতি এখনও সম্পূর্ণভাবে বিকশিত হয়নি। গবেষণায় অর্থায়নের অভাব, ল্যাব ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা, বিদেশি জার্নালে প্রকাশনার জটিলতা এসব কারণে আমাদের গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে পারে না। বিশ্বে হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড বা ন্যানইয়াং টেকনোলজিকাল ইউনিভার্সিটি গবেষণার ওপর যে গুরুত্ব দেয়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেখানে এখনও পথচলার শুরুতে।

আরেকটি বড় ঘাটতি দেখা যায় আন্তর্জাতিকীকরণে। বিশ্ব র‍্যাংকিং মূল্যায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ মানদণ্ড হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে কতজন বিদেশি শিক্ষার্থী ও শিক্ষক রয়েছেন এবং তাদের সাথে কতটা আন্তর্জাতিক সহযোগিতা রয়েছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থী বা প্রফেসরের সংখ্যা খুবই কম। আমাদের বেশিরভাগ পাঠক্রমও আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে তৈরি নয়। এতে আন্তর্জাতিক একাডেমিক বিনিময় ও বহুভাষিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠে না। তুলনামূলকভাবে ভারত, মালয়েশিয়া বা চীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিদেশি শিক্ষার্থী আকর্ষণে অনেক এগিয়ে গেছে।

শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, অবকাঠামো ও একাডেমিক পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে শিক্ষক, আধুনিক ল্যাব, লাইব্রেরি, গবেষণা তহবিল বা আবাসিক পরিবেশ তৈরি হয়নি। ফলে মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদানের ক্ষেত্রে চাপ তৈরি হয়। একই সঙ্গে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক জটিলতা, রাজনীতি, সেশনজট, শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতার সংকটও শিক্ষার মানকে প্রভাবিত করে।

তবে সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়তো মানগত উন্নয়নের পরিকল্পনায় ধারাবাহিকতার অভাব। অনেক সময় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লক্ষ্য থাকে শুধুই ডিগ্রি প্রদান; কিন্তু বিশ্বমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তারা সমাজকে বদলে দেওয়ার জন্য কাজ করে উদ্ভাবন, স্টার্টআপ সংস্কৃতি, শিল্পখাতের সঙ্গে গবেষণা সহযোগিতা, প্রযুক্তিগত আবিষ্কার এগুলোকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ও গবেষণাকে গড়ে তোলে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব বিষয়ে পরিকল্পনা থাকলেও, বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ এখনও কম।

তবে এই ছবির মাঝেও রয়েছে আশার আলো। প্রথমত, বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম আজ অভূতপূর্বভাবে প্রযুক্তি, গবেষণা ও আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্পর্কে আগ্রহী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে Robotics Club, Research Cell, Debate Forum বা Innovation Hub গড়ে উঠছে। পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় খাতেই কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক মানের ল্যাব, গবেষণা ফান্ড ও প্রযুক্তিগত সুবিধা তৈরি করছে। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি এখন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে বেশ সক্রিয়।

সরকারও এখন উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছে। ‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংকিং’, ‘গবেষণা অনুদান’, ‘স্পেশালাইজড বিশ্ববিদ্যালয়’ এসব প্রকল্প ধীরে ধীরে কার্যকর হচ্ছে। ডিজিটাল লার্নিং, অনলাইন ক্লাস, ইনোভেশন হাব, বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নতুনভাবে উঠে দাঁড়াতে শুরু করেছে। উচ্চশিক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি, স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও গবেষণা তহবিল নিশ্চিত করা গেলে এই অগ্রগতি আরও তরান্বিত হতে পারে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন নির্ভর করবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির ওপর। শিক্ষাব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক মানের করতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শুধু র্যাংকিংয়ের কথা মাথায় না রেখে জ্ঞান ও উদ্ভাবনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় যদি তার নিজস্ব বিশেষায়িত ক্ষেত্র তৈরি করে কারও কৃষি গবেষণায় দক্ষতা, কেউ মেরিন সায়েন্সে, কেউ প্রযুক্তি বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে তাহলে দেশের সামগ্রিক শিক্ষা পর্যায়ে পরিবর্তন ঘটবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে গবেষণা তহবিল তৈরি করতে হবে, শিল্পখাতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কার্যকর প্রকল্প হাতে নিতে হবে এবং তরুণদের বিশ্বমানের গবেষণায় আগ্রহী করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণা চুক্তি, বিদেশে পিএইচডি ও ফেলোশিপ সুবিধা বাড়ানো অপরিহার্য।

সবশেষে বলা যায়, বাংলাদেশ এখন বিশ্ব র‍্যাংকিংয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে নয় কিন্তু সম্পূর্ণ বাইরে নয়। আমরা এখনও ৮০০ কিংবা ১০০০ এর গণ্ডিতে অবস্থান করছি। এটা হয়তো গৌরবের জায়গা নয়, কিন্তু শুরু করার জায়গা। যদি পরিকল্পনা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ও গবেষণা বিনিয়োগ একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে আগামী এক দশকেই বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের শীর্ষ ৫০০-র তালিকায় পৌঁছাবে এমন আশা অমূলক নয়। আমাদের প্রয়োজন লক্ষ্যভিত্তিক কাজ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং একাডেমিক সততা। তাহলে “বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়” আর শুধু স্বপ্ন থাকবে না, হতে পারে আমাদের বাস্তবতা।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর