Tuesday 11 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষিত বেকারত্ব ও ভবিষ্যতের ঝুঁকি: বাংলাদেশের লুকানো সংকট

মাসুদ রানা
১১ নভেম্বর ২০২৫ ১৮:৫২

বাংলাদেশ বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে এক উদীয়মান শক্তি হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। দ্রুত জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পের বাস্তবায়ন এবং মাথাপিছু আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধি— এসবই দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্পষ্ট সাক্ষ্য বহন করে। কিন্তু এই সাফল্যের উজ্জ্বল চিত্রের আড়ালে চাপা পড়ে আছে এক গভীর এবং নীরব সংকট—শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক বেকারত্ব। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই তরুণ, যাদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত; অথচ তাদের একটি বিশাল অংশ কর্মহীন। এই নীরব সংকট কেবল বর্তমানের অর্থনৈতিক চাপ নয়, বরং দেশের ভবিষ্যৎ সামাজিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকেই সরাসরি হুমকির মুখে ফেলছে।

বিজ্ঞাপন

জনমিতিগত লভ্যাংশের হাতছানি ও তার ব্যর্থতা

কোনো দেশের কর্মক্ষম জনসংখ্যা (১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী) যখন নির্ভরশীল জনসংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি থাকে, তখন তাকে ‘জনমিতিগত লভ্যাংশ’ (Demographic Dividend) বলা হয়। এই সুবিধা কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে এই সোনালী যুগে প্রবেশ করেছে এবং ২০৪০ সাল পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি থাকবে। কিন্তু এই বিশাল কর্মক্ষম জনশক্তিকে যদি সঠিক সময়ে কাজে লাগানো না যায়, তবে এই লভ্যাংশ দ্রুতই এক ‘জনমিতিগত বোঝায়’ (Demographic Burden) পরিণত হবে। দেশে বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করছে। সরকারি তথ্যমতে, দেশে শিক্ষিত বেকারের হার ২০ শতাংশের বেশি, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় যথেষ্ট বেশি। এই বেকারত্ব প্রমাণ করে—আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান মানবসম্পদকে কাজে লাগাতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। যে তরুণরা দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হতে পারতো, তারা আজ হতাশায় নিমজ্জিত।

শিক্ষা বনাম বাজারের চাহিদা: একটি হতাশাজনক ব্যবধান

বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এবং বর্তমান শ্রমবাজারের চাহিদার মধ্যে একটি বিশাল ও হতাশাজনক ব্যবধান বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতি বছর যে হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছেন, তাদের অর্জিত জ্ঞান বাজারের প্রয়োজনীয় দক্ষতা (প্রযুক্তিগত জ্ঞান, যোগাযোগ দক্ষতা, বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা) থেকে অনেক দূরে। প্রথাগত, সনদ-নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা এখনও মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভরশীল। ফলস্বরূপ, একজন স্নাতকের হাতে ডিগ্রি থাকলেও চাকরির বাজারের উপযোগী ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ দক্ষতা এবং বিশ্লেষণাত্মক ক্ষমতা থাকছে না। বিশেষ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারে প্রবেশ করেই হতাশায় পড়েন। অন্যদিকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেলেও সেখানে বেতন কম এবং ক্যারিয়ার বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত থাকে, যা তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ ও সামাজিক অসন্তোষ বাড়ায়।

দেশের শিল্প-কারখানাগুলোও দক্ষ জনবলের অভাবে ভুগছে। একদিকে যেমন শিক্ষিত বেকারত্ব বাড়ছে, তেমনি নির্মাণ বা প্রযুক্তি খাতের মতো অনেক শিল্প এখনও দক্ষ বা আধা-দক্ষ জনবলের জন্য বিদেশিদের ওপর নির্ভরশীল। জনমিতিগত লভ্যাংশ থাকা সত্ত্বেও এই বৈদেশিক কর্মনির্ভরতা আমাদের দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণ কাঠামোরই ফল। অন্যদিকে, দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ মূলত মধ্যপ্রাচ্যনির্ভর অদক্ষ শ্রমিকদের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষিত বেকারদের দক্ষতা বাড়ানো গেলে তারা দেশের ভেতরে বিদেশি কর্মীদের স্থান দখল করতে পারতেন এবং বিদেশে উচ্চ বেতনে কাজ করে রেমিট্যান্স প্রবাহকে শক্তিশালী করতেন।

সামাজিক অস্থিরতা ও নীরব ক্ষয়

দীর্ঘদিনের বেকারত্ব কেবল অর্থনৈতিক সঙ্কট নয়, এটি সামাজিক কাঠামোর ভেতরেও গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। চাকরি না পাওয়ায় শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে তীব্র হতাশা, মানসিক চাপ এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব প্রকট হয়। এই হতাশা থেকেই জন্ম নেয় সামাজিক অস্থিরতা। অপরাধ মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, হতাশাগ্রস্ত শিক্ষিত বেকার তরুণদের অনেকে সহজেই মাদকাসক্তি, সাইবার অপরাধ এবং সামাজিক নৈরাজ্যের মতো নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমনকি চাকরি পেতেও অবৈধ পথে ঘুষ ও দুর্নীতির আশ্রয় নিতে তারা বাধ্য হন। দেশের টেকসই উন্নয়ন ও শান্তি নিশ্চিত করতে হলে এই সামাজিক ক্ষতটিকে অবিলম্বে সারানো প্রয়োজন।

সংকট সমাধানের পথ: সুদূরপ্রসারী কৌশল ও দক্ষতা উন্নয়ন

এই নীরব সংকট থেকে মুক্তি পেতে হলে সরকারকে অবশ্যই কিছু সুদূরপ্রসারী ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। সবার আগে মনোযোগ দিতে হবে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কারে। শিক্ষাকে বাজারের চাহিদাকেন্দ্রিক করতে হবে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সমমর্যাদা দিতে হবে এবং সিলেবাসে তথ্যপ্রযুক্তি, কোডিং, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং সফট স্কিলস অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

এরপর গুরুত্ব দিতে হবে উদ্যোক্তা উন্নয়নে। সরকারি উদ্যোগে ঋণ সহজলভ্য করে এবং ঝুঁকি নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করে তরুণদের চাকরির পেছনে না ছুটে উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (SME) খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন, কারণ এই খাতই সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে।

দেশীয় ও বিদেশি বিনিয়োগের গতি বৃদ্ধি অপরিহার্য। অবকাঠামো উন্নয়ন, ওয়ান-স্টপ সার্ভিসের কার্যকর বাস্তবায়ন এবং ব্যবসায়িক পরিবেশের উন্নতি ঘটিয়ে শিল্পকারখানা স্থাপনকে সহজ করতে হবে, যা নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করবে।

সরকার ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিটি বিভাগে স্কিল ডেভেলপমেন্ট সেন্টার স্থাপন করতে হবে। মাধ্যমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের কারিগরি ও প্রযুক্তিভিত্তিক শেখার সুযোগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে দ্রুত কর্মসংস্থান তৈরি করতে আইটি ও ফ্রিল্যান্সিং, কৃষি-প্রযুক্তি, স্বাস্থ্যসেবা ও মেডিক্যাল ট্যুরিজম, হালকা প্রকৌশল ও ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প, নবায়নযোগ্য শক্তি এবং ই-কমার্স ও লজিস্টিকস—এই খাতগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে। কারণ এই খাতগুলোতে একই সাথে কর্মসংস্থানের বিস্তৃত সুযোগ, কম মূলধনে প্রবেশের সম্ভাবনা এবং বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে।

কিন্তু এই খাতগুলোর একটি বড় সমস্যা হলো মানসম্মত প্রশিক্ষণের অভাব। আমাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর অধিকাংশই প্রয়োজনীয় ল্যাব, আধুনিক সরঞ্জাম, আপডেটেড কোর্স বা অভিজ্ঞ প্রশিক্ষকের ঘাটতিতে ভুগছে। ফলে প্রশিক্ষণার্থীরা সার্টিফিকেট পেলেও কর্মস্থলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতা তৈরি হয় না।

আইটি ও ফ্রিল্যান্সিং খাতে সফলতা এলেও এখানে ভাষাগত দক্ষতা, ক্লায়েন্ট ম্যানেজমেন্ট এবং বিশেষায়িত দক্ষতা অর্জনের অভাবে অনেকে কাজ পায় না। কৃষি-প্রযুক্তি খাতে স্মার্ট সেচ ব্যবস্থা বা ডেটা-ভিত্তিক মাটি বিশ্লেষণের মতো আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে মাঠ পর্যায়ের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতে নার্সিং দক্ষতা এবং আন্তর্জাতিক মান অনুসরণের জন্য মানসম্মত ট্রেনিং কেন্দ্র খুব সীমিত। হালকা প্রকৌশল ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতেও একই সমস্যা বিদ্যমান—উৎপাদনের সঙ্গে মান নিয়ন্ত্রণ, নকশা উদ্ভাবন এবং আধুনিক প্রযুক্তি শেখানোর উপযুক্ত ব্যবস্থা এখনো দুর্বল।

সুতরাং, এখন দেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দক্ষতা উন্নয়নকে একটি জাতীয় কর্মসূচিতে রূপ দেওয়া—যেখানে তত্ত্ব নয়, কেবল বাস্তব দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রতিটি জেলায় বাস্তব ল্যাবসহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্পক্ষেত্রের মধ্যে কার্যকর অংশীদারিত্ব তৈরি, এবং শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ চালু করলে দ্রুত দৃশ্যমান পরিবর্তন আসবে।

যুব বেকারত্ব আজ আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার মতোই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই নীরব সংকটকে উপেক্ষা করলে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির ভিত্তি দুর্বল হয়ে যাবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সমন্বিত উদ্যোগে এই বিপুল তরুণ শক্তিকে কাজে লাগানো সম্ভব হলে, বাংলাদেশ অচিরেই ‘উন্নয়নশীল দেশ’ থেকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে। অস্ত্রের শক্তি নয়, জ্ঞান এবং কর্মের শক্তিতেই দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর