Tuesday 11 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষার্থী আত্মহত্যা, শিক্ষার দুরবস্থা ও আমাদের দায়বদ্ধতা

কাজী মাসুদুর রহমান
১১ নভেম্বর ২০২৫ ১৯:২৯

সাম্প্রতিক কালে শিক্ষার্থী আত্মহত্যা আশংকা জনক হারে বেড়েছে। এ বিষয়ে বেসরকারি সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আঁচল’-এর পরিসংখ্যান তথ্যে দেখা যায়, ২০২৪ সালে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মোট ৩১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এরমধ্যে মাধ্যমিকে ৪৬.১%, উচ্চ মাধ্যমিকে১৯.৪% ও স্নাতক পর্যায়ে ১৪.৬% আত্মহত্যা করেছেন। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এর মধ্যে ১৩-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের হার সবচেয়ে বেশি যার সংখ্যা ৬৫.৭%। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ২০- ২৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থীরা। বাকিগুলো বিভিন্ন বয়সী।

এর আগে ২০২৩ সালে ৫৮৩ জন এবং ২০২২ সালে ৫৩২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিলেন। সমীক্ষায় দেখা যায় যে, এর মধ্যে ১৩-১৯ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদের হার সবচেয়ে বেশি যার সংখ্যা ৬৫.৭%। তথ্যানুযায়ী, ১৪.২% শিক্ষার্থী একাডেমিক চাপ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। বাকিগুলো পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক বিচিত্র কারণে। সম্প্রতি এইচএসসি পরীক্ষা ‘২০২৫ এর ফলাফল বিপর্যয়ে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। দেশের ১১টি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১২ লাখ ৫১ হাজার ১১১ জন। পাশের হার ৫৮.৮৩ শতাংশ। বিগত দুই দশকের মধ্যে এবারের পরীক্ষায় পাশের হার সবচেয়ে কম। ফল বিপর্যয়ের কারণে সারা দেশে অন্তত পাঁচজন আত্মহত্যা করেছেন। এর আগে এসএসসি পরীক্ষা ২০২৫ এ অকৃতকার্যের কারণে সারা দেশে মোট ছয় জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নেয় যা খুবই দুঃখজনক। উল্লেখ্য, অধিকাংশ শিক্ষার্থী বরাবরের মতো ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য হওয়ার কারণেই এমন ফল বিপর্যয় ঘটেছে মর্মে তথ্য মতে দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

বলাবাহুল্য, ইংরেজি একটি সংবেদনশীল বিষয়। ফলে,এ দুটি পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক ও পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার অনেকাংশে ইংরেজি বিষয়ের উপর নির্ভর করে। সংবেদনশীল এ অর্থে যে, ইংরেজি বিষয়টি বি জাতীয়ভাষা ভিত্তিক। ফলে, স্বাভাবিকভাবে এ বিষয়ের লেখাপড়া বাংলা মিডিয়াম শিক্ষার্থীরা সহজে বোধ করতে পারেন না। সর্বশেষ, এই দু’টি বৃহৎ পাবলিক পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ে লক্ষণীয় ফল বিপর্যয় ঘটেছে।

উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীর শিক্ষা ও ফলাফল ভালো-মন্দ হওয়ার নেপথ্যে যে বিষয় গুলো কাজ করে তা হলো- ১) শিক্ষকের যথার্থ গাইডিং ২) শিক্ষার্থীর শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতা ৩) পারিবারিক পরিষেবা ৪)আর্থিক পরিপোষণ ৫) শিক্ষা বান্ধব সামাজিক প্রতিবেশ ও পরিবেশ এবং ৬) রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক উপযোগিতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ২০২০ ও ২০২১ সালে সংঘটিত বৈশ্বিক মহামারি ‘করোনা’ এর প্রাদুর্ভাব বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর মত বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও নিদারুণ আঘাত হানে যার রেশ এখনো প্রবহমান। এর প্রকটতা এত বেশি ছিল যে, ২০২০ সালের এইচএসসি বাতিলপূর্বক অটোপাশ দিতে কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়েছিল। এমনকি, ২০২১ থেকে ২০২৫ সাল অবধি সাবজেক্ট ম্যাপিং ও সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা নিতে হয়েছে। এমনিতেই করোনার কষাঘাত তার ওপর আবার ‘২৪ এর রাজনৈতিক দুর্যোগ ২০২৫ এর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে সামগ্রিক ফল বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে আরো দুটি কারণ হলো- ১) করোনার কারণে শ্রেণি পাঠ বন্ধ হওয়ার ফলে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বে উদ্ভূত ক্লাস বিমুখতা ও ২) অনলাইন ক্লাসের নামে মোবাইল নির্ভরতার ফলে সৃষ্ট মোবাইল আসক্ততা। তবে, ইংরেজির ফল বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে আরেকটি কারণ যোগ হতে পারে; তা হলো- বাণিজ্য নির্ভর একশ্রেণীর কোচিং সেন্টার ও ব্যাচ গুলোতে ম্যাজিক কৌশলের নামে শর্টকাট তথা অবিশ্লেষণিক পদ্ধতিতে শিক্ষাদান। পাশাপাশি লক্ষ্যনীয় যে, অনলাইন ভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতির ফলে অপেক্ষাকৃত অগ্রগামী শিক্ষার্থীরা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পছন্দ নির্বাচন করে ভর্তি হয়। বিপরীতে, শহরতলীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিক্ষার্থী পায়। প্রশ্ন থাকে যে, অনগ্রসর তথা দুর্বল শিক্ষার্থীদের মানোন্নয়নের দায় শুধু শহরতলির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর বর্তাবে কেন? প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ায় দুর্বল ও সবল শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে একটি প্রতিযোগিতা পূর্ণ পড়ালেখার পরিবেশ সৃষ্টি হলে তাতে দুর্বল শিক্ষার্থীরাও এগিয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে, উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীর প্রচলিত ভর্তি পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা উচিত বলে সচেতন মহল মনে করেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থা ‘গ্রেড অর্জন’ ও ‘ক্যারিয়ার গড়ন’ নির্ভর হয়ে পড়েছে। এখানে নৈতিকতার মূল্যবোধ অনেকটাই শূন্য। শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবক এই দু’য়ের প্রতি এখন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছেন। নৈতিক দীক্ষা অর্জনের মাধ্যমে মানবিক মূল্যবোধের জাগরণ ঘটানোই হলো শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য; অথচ, সেই শিক্ষাই এখন নৈতিকতা বিবর্জিত অন্তঃসারশুণ্য! শিক্ষক সমাজ এই দায় এড়াতে পারেন না। যেমন, একজন গণিত শিক্ষক তিনি তার বিষয়ভিত্তিক ‘ফ্রেমওয়ার্ক’ এর বাইরে শিক্ষার্থীদেরকে সাধারণত কোন শিক্ষা-দীক্ষা দেন না। সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীগণকে ‘গণিত বিশেষজ্ঞ’ বানানোই তার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এভাবে অন্য বিষয়ের শিক্ষকগণও। অথচ, প্রতিটি বিষয়ের সমান্তরালে ‘স্বদেশ প্রেমবোধ’ ও ‘মানবিক মূল্যবোধ’ এর নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা দানের নৈতিকদায় তদসংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের রয়ে গেছে যা তারা (ব্যতিক্রম বাদে) লালন এবং পালন কোনটিই করেন না। বলা যায়, যে শিক্ষায় নৈতিকতার সংমিশ্রণ থাকেনা সে শিক্ষা কখনই সুশিক্ষা হতে পারে না। নৈতিকতা বিবর্জিত শিক্ষা মূর্খতার চেয়ে ভয়ংকর! গভীর পরিতাপের বিষয় হলো- ঔপনিবেশিক আমল হতে আমাদের সমাজ একশ্রেণীর ‘শিক্ষিত দুর্জন’ দ্বারা শাসিত ও শোষিত হয়ে আসছে। এখানে ‘সুশিক্ষিত সুজন’ এর বড়ই অভাব। আবহমানকাল হতে শিশুর মনস্তত্ত্বে ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’ মর্মে বিলাসী শিক্ষা প্রবিষ্ট করানো হচ্ছে; এভাবে ব্রিটিশ বেনিয়াদের সেই পুঁজিবাদী ও সাম্রজ্যবাদী প্রভুত্ব [Lordship] প্রবণতামূলক শিক্ষা প্রজন্ম পরম্পরায় গ্রথিত হয়ে আসছে। অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, পড়ালেখার মূল উদ্দেশ্যই প্রভাব প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা। আমাদের সমাজে শিক্ষিত শ্রেণীর প্রায় সকলেই এখন ‘শাসক’ হতে চায় কিন্তু কেউ ‘সেবক’ হতে চায় না। সম্প্রতি মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও কৃষিশিক্ষার মতো বিশেষায়িত শিক্ষায় শিক্ষিত শিক্ষার্থীরা বিসিএস-এর প্রশাসন ক্যাডারে ঝুঁকছেন। বিসিএস এর পরম লোভাতুর নেশায় উচ্চতর শিক্ষার্থীরা এখন বুদ্ হয়ে থাকেন। ফলে, উচ্চতর শিক্ষায় গবেষণার ক্ষেত্র দিনে-দিনে সংকুচিত হয়ে তা প্রায় শূন্যের কোঠায় পৌঁছেছে যা দেশ ও জাতির জন্য কখনই শুভ ফল বয়ে আনবে না। বলাবাহুল্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মুখ্যত গবেষণার ওপরই নির্ভর করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ভিত্তিক আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিং-এ বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের অবস্থান বেশ অবনমন পর্যায়ে রয়েছে যা হতাশার বটে। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, ‘বিসিএস’ এ আসক্ত শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় পরিচালিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত। উক্ত তিন অনুষদের পেশা খুবই সংবেদনশীল এবং সেবাধর্মী হিসেবে সর্বজনবিদিত; অথচ, স্ব-স্ব অনুষদ সংশ্লিষ্ট পেশায় নিযুক্ত হয়ে দেশ ও জনগণের পরিষেবায় ব্রতী না হয়ে তাদের অনেকেই প্রশাসন ক্যাডারে আকৃষ্ট হচ্ছেন যা কখনোই আদর্শিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, লক্ষ্য একটাই আর তা হলো- ক্ষমতা ও অর্থের যথেচ্ছা চর্চা যা ঐ তিন পেশায় এতটা সম্ভব নয়।

বলাবাহুল্য- ধৈর্য, সহনশীলতা, পরিশীলতা শিক্ষার একেকটি অলংকার। এগুলো এখন শুধু বইয়ের পাতায় আর লেখনীতে শোভিত হয় কিন্তু শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনে প্রতিফলিত হয় না। কেননা, এ লক্ষ্যে তাদেরকে জীবনধর্মী মোটিভেশনাল শিক্ষা দিতে শিক্ষক, অভিভাবক, রাজনীতিক সর্বোপরি সমাজ অনেকটাই ব্যর্থ। ফলে, হতাশার আঁধারে হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষিত তারুণ্যের স্বপ্ন এমনকি জীবনও।

লেখক: কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর