Monday 17 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সন্ত্রাসবাদের নামে বিভ্রান্তি নয়, প্রমাণই হোক সম্পর্কের ভাষা

মাসুদ রানা
১৭ নভেম্বর ২০২৫ ১৬:১৪

সম্প্রতি দিল্লির লাল কেল্লার কাছে সংঘটিত বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার পর ভারতের কিছু গণমাধ্যম যে তথ্য প্রচার করছে, তা বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগজনক। তাদের দাবি, পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার প্রধান হাফিজ সাঈদ নাকি এই হামলার ছক কষতে বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করেছেন। ভারতীয় গণমাধ্যমের এ তথ্য বিশ্বাস করার মতো কোনও কারণ নেই বলে বিবৃতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এই ধরনের সংবেদনশীল এবং ভিত্তিহীন দাবি নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার স্পষ্ট অবস্থান অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত।

ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্যের প্রতীক। এই সম্পর্ক শুধু ভৌগোলিক নৈকট্যের কারণে নয়, বরং ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনের কারণেও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এমন একটি সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে যখন ভারতের কিছু গণমাধ্যম বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন ও অপ্রমাণিত অভিযোগ তোলে—যেমন সাম্প্রতিক দিল্লির লাল কেল্লার কাছে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করা হয়েছে বলে দাবি করা—তখন সেটি শুধু কূটনৈতিকভাবেই নয়, বরং নৈতিকভাবেও উদ্বেগজনক।

বিজ্ঞাপন

প্রথমত, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূলভিত্তি হলো বিশ্বাস ও প্রমাণ। একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন গুরুতর অভিযোগ আনার আগে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করা অপরিহার্য। গণমাধ্যমের কাজ তথ্য প্রচার করা, কিন্তু সেই তথ্য যদি যাচাই-বাছাই ছাড়া, সূত্রবিহীন বা অনুমানের ওপর দাঁড়ানো হয়, তবে তা শুধু সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিকেই ক্ষুণ্ন করে না—বরং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অনর্থক উত্তেজনা সৃষ্টি করে। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো যখন এমন গুরুতর অভিযোগ আনে, তখন তাদের উচিত সুনির্দিষ্ট ও অকাট্য প্রমাণাদি উপস্থাপন করা। কিন্তু তেমন কিছু তারা প্রকাশ করতে পারেনি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের বক্তব্য এই কারণেই বাস্তবসম্মত ও পরিমিত, কারণ তিনি স্পষ্ট করেছেন যে প্রমাণ ছাড়া এমন দাবি কেবল দুই দেশের পারস্পরিক আস্থাকে দুর্বল করে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। গত এক দশকে বাংলাদেশ সরকার জঙ্গিবাদ দমনে যে সাফল্য দেখিয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য একটি মডেল। দেশটি “জিরো টলারেন্স” নীতি গ্রহণ করে কেবল অভ্যন্তরীণ চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোকেই নির্মূল করেনি, বরং প্রতিবেশী দেশগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও ভূমিকা রেখেছে। ভারতের সঙ্গে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা, সীমান্ত নজরদারি, ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এই প্রক্রিয়াকে আরও মজবুত করেছে। এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ তোলা যুক্তি ও বাস্তবতার পরিপন্থী।

তৃতীয়ত, দুই দেশের মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিদ্যমান। যদি সত্যিই ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর হাতে এমন কোনো তথ্য থাকত, তবে তা কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশকে জানানোই ছিল স্বাভাবিক পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে এমন কোনো তথ্য বিনিময়ের প্রমাণ নেই। ফলে গণমাধ্যমে এমন দাবি প্রচার করা উদ্দেশ্যমূলক প্রচারণা বলেই মনে হয়। এই ধরনের প্রচারণা দুই দেশের জনগণের মধ্যে সন্দেহ, অবিশ্বাস ও নেতিবাচক মানসিকতা তৈরি করে—যা পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রভাবও ফেলতে পারে।

চতুর্থত, এই ধরনের অভিযোগের পেছনে ভূরাজনৈতিক প্রভাবও অস্বীকার করা যায় না। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরেই আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সীমান্ত রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ চাপের কারণে জটিল। কখনও কখনও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি আড়াল করতে প্রতিবেশী দেশের ওপর দায় চাপানো একটি প্রচলিত কৌশল হয়ে দাঁড়ায়। দিল্লির বিস্ফোরণের ঘটনার তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে; অথচ তার আগেই বাংলাদেশের নাম টেনে আনা এই প্রবণতাকে সন্দেহজনক করে তোলে।

সবশেষে, এই ঘটনা দুই দেশের গণমাধ্যম ও কূটনৈতিক মহলের জন্য একটি বড় শিক্ষা হতে পারে। গণমাধ্যমের দায়িত্ব হলো উত্তেজনা নয়, বরং বোঝাপড়া ও তথ্যভিত্তিক আলোচনার পরিবেশ তৈরি করা। অপরদিকে, সরকারগুলোর উচিত পারস্পরিক আস্থা রক্ষায় দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া এবং যেকোনো ভুল বোঝাবুঝি তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে নিরসন করা।

বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্ব একদিনে গড়ে ওঠেনি; এটি মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সহযোগিতার মাধ্যমে গঠিত হয়েছে। এই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হলে উভয় পক্ষকেই দায়িত্বশীলতা, সংবেদনশীলতা ও তথ্যভিত্তিক আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের মতো সংবেদনশীল ইস্যুতে একে অপরের বিরুদ্ধে অপ্রমাণিত অভিযোগ নয়, বরং যৌথ তদন্ত ও গোয়েন্দা সহযোগিতাই হতে পারে স্থিতিশীল ও পরস্পরনির্ভর দক্ষিণ এশিয়ার পথনির্দেশক।

পরিশেষে, এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের অবস্থান যুক্তিসংগত—প্রমাণ ছাড়া কোনো অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য নয়, আর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মূলভিত্তি হলো বিশ্বাস, স্বচ্ছতা ও পারস্পরিক সম্মান। এই নীতি রক্ষা করলেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক আরও দৃঢ়, পরিণত ও ভবিষ্যতমুখী হতে পারে।

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর