বাংলাদেশ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ প্রতিদিন নতুন অনিশ্চয়তার জন্ম দিচ্ছে। আর এই অস্থিরতার ধাক্কা সরাসরি এসে লাগছে আমাদের দোরগোড়ায়। কখনো গুলির শব্দ, কখনো মর্টারের গোলা, কখনো বা প্রাণ বাঁচাতে ছুটে আসা রোহিঙ্গাদের ভিড়—সব মিলিয়ে সীমান্তের পরিস্থিতি এখন দীর্ঘস্থায়ী এক নিরাপত্তা সংকটে পরিণত হয়েছে। মাদক পাচার, অনুপ্রবেশ ও মানবিক বিপর্যয়ের ছায়া বাংলাদেশের সামগ্রিক নিরাপত্তাকে আরো চ্যালেঞ্জ করে তুলেছে। যেখানে শান্ত সীমান্তের জন্য কূটনীতি, নজরদারি ও মানবিক দায়িত্ব একসঙ্গে কাজ করার কথা, সেখানে বাস্তবতা হয়ে উঠছে আরও জটিল, আরও উদ্বেগজনক।
মিয়ানমারের রাখাইন, চিন, কারেন এবং শান প্রদেশসহ বহু অঞ্চলে এখন সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর লড়াই চলছে। আরাকান আর্মিসহ দেশটির প্রতিটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী কোনো না কোনো এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। এসব অঞ্চলের অনেক জায়গায় ভেঙে পড়েছে প্রশাসন; গ্রাম-শহর হয়ে উঠেছে যুদ্ধক্ষেত্র। বিশেষ করে মংডু ও বুথিডং—সীমান্তসংলগ্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিদ্রোহীরা অনেক জায়গায় সামরিক ঘাঁটি দখল করেছে, আবার কোথাও সেনাবাহিনী পাল্টা হামলা চালাচ্ছে। এমন অস্থিরতার মধ্যে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে তারা সীমান্তের দিকে, বিশেষ করে বাংলাদেশের দিকে পালিয়ে আসছে আশ্রয়ের জন্য। এ অবস্থায় তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়ছে সীমান্ত নিরাপত্তায়। বাংলাদেশের ভেতরে একাধিকবার মর্টার শেল ও গুলি এসে পড়ে হতাহতও হয়েছেন অনেকে। সীমান্তজুড়ে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যেন স্থায়ী উদ্বেগে বন্দি।
অন্যদিকে এই অস্থিরতার সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হচ্ছে মাদক কারবারি ও অস্ত্র চক্র। মিয়ানমারের রাখাইন ও সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চল বহুদিন ধরেই ইয়াবা উৎপাদনের কেন্দ্র। সরকারি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব অঞ্চলে মাদক উৎপাদন ও পাচার আরও বেড়ে গেছে। মাদক কারবারিরা এখন পাহাড়ি রুট, নৌপথ ও অনিরাপদ সীমান্ত ব্যবহার করে লাখ লাখ ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত অভিযানেও এই প্রবাহ থামানো যাচ্ছে না, কারণ পাচারের রুট ও কৌশল প্রতিদিনই পাল্টাচ্ছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজে মাদকের বিস্তার, অপরাধ বৃদ্ধি এবং সীমান্তে সংঘবদ্ধ চক্রের শক্তি বাড়ার পেছনে এই অস্থিতিশীলতা বড় ভূমিকা রাখছে।
মিয়ানমারের অস্থিরতার আরেকটি গুরুতর প্রতিক্রিয়া হলো নতুন করে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ। ২০১৭ সালে গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা এখনো বাংলাদেশ বহন করছে। এর মধ্যে আবারো নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। সীমান্তে সংঘর্ষ দেখা দিলেই রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসে বাংলাদেশের দিকে আশ্রয় চাইছে। মানবিক দিক বিবেচনায় সীমান্ত বন্ধ রাখা কঠিন। কিন্তু বাস্তবতা হলো নতুন অনুপ্রবেশ মানেই আশ্রয় শিবিরে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ, অপরাধ বৃদ্ধি, অস্ত্র-মাদক চক্রের সঙ্গে সংযোগ তৈরি হওয়া এবং স্থানীয় জনগণের সঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক সংকটগুলোর একটির দায় কাঁধে নিয়েছে। এর ওপর নতুন চাপ দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির জন্য মারাত্মক হুমকি।
সীমান্তের ভৌগোলিক কাঠামোও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জকে আরো জটিল করে তুলছে। উঁচু পাহাড়, ঘন বন, নদী ও নালা—এমন ভূপ্রকৃতি পুরো সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত। বিজিবির সক্ষমতা ও মনোবল প্রশংসনীয় হলেও বাস্তবতা হলো, শত কিলোমিটারজুড়ে এমন দুর্লভ ভূখণ্ডে প্রতিটি রুট পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধে নতুন নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠী সক্রিয় হওয়ায় বাংলাদেশকে সীমান্তে প্রতিনিয়ত নতুন নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণ করতে হচ্ছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে এক জটিল দোটানার মধ্যে পড়তে হচ্ছে—মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা নাকি দৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা? দুই দায়িত্বই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু বাস্তবতা হলো সীমান্তের প্রতিটি সিদ্ধান্ত এখন বাংলাদেশকে অনেক হিসাব-নিকাশের মধ্য দিয়ে নিতে হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে সম্মান অর্জন করলেও এই অসহায় জনগোষ্ঠীকে ধারণ করার সীমা আছে। তাদের নিরাপত্তাহীনতা ও দুঃখ আমরা অনুভব করি ঠিকই, তবে দেশের জাতীয় নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও সামাজিক স্থিতিশীলতার বিষয়টি আমাদের ভাবতে হবে।
এ অবস্থার সমাধান কোনো একক পদক্ষেপে সম্ভব নয়। সবচেয়ে জরুরি হলো সীমান্ত নিরাপত্তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া। প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি, বর্ডার সড়ক সম্প্রসারণ, বিশেষায়িত টহল দল, নৌপথে কঠোর নিয়ন্ত্রণ—এসবকে দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার।
ইয়াবা ও আইস পাচার রোধে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা যেতে পারে, যার মধ্যে থাকবে বিজিবি, পুলিশ, র্যাব, কাস্টমস এবং গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ সমন্বয়।
স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে ‘কমিউনিটি পর্যায়ের নজরদারি’ গড়ে তোলাও কার্যকর হতে পারে। কারণ পাচারকারীরা বেশিরভাগ সময় স্থানীয়দের ভয়ে পাল্টা রুট ব্যবহার করতে পারে না।
রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে কূটনীতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াতে বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। চীন, ভারত, আসিয়ান ও পশ্চিমা দেশগুলো—সব পক্ষকে সংলাপে যুক্ত করতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন ছাড়া এই সংকট কখনোই শেষ হবে না। পাশাপাশি রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে অপরাধী গোষ্ঠী দমনে কঠোর আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে।
সীমান্ত অর্থনীতি উন্নয়ন করাও অত্যন্ত জরুরি। সীমান্তের মানুষ যদি দারিদ্র্যের মধ্যে থাকে, তবে পাচার ও অপরাধে জড়ানোর ঝুঁকি থাকে সবসময়। অর্থনৈতিক জোন, পর্যটন উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করলে সীমান্তের মানুষ রাষ্ট্রের পক্ষেই দাঁড়াবে; অপরাধচক্রের পাশে নয়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মিয়ানমারের সঙ্গে নিয়মিত সামরিক ও কূটনৈতিক সংলাপ বজায় রাখা। বাংলাদেশের ভূখণ্ডে গুলিবর্ষণ বরদাস্ত করা হবে না—এ কথা দৃঢ়ভাবে জানাতে হবে। একই সঙ্গে উত্তেজনা যাতে বাড়ে না, তাও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত শান্তিপূর্ণ সীমান্ত—কিন্তু শান্তির জন্য প্রয়োজন দৃঢ়তা, স্পষ্ট অবস্থান এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্ত জটিল নিরাপত্তা বাস্তবতার নাম। এখানে মানবিকতা আছে, রাজনীতি আছে, আন্তর্জাতিক স্বার্থ আছে, আবার আছে অপরাধচক্রের গভীর বিস্তার। এই বাস্তবতা অস্বীকার করা যাবে না। তাই এখনই প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি, বাস্তবভিত্তিক ও শক্তিশালী কৌশল গ্রহণের। কারণ সীমান্ত কেবল ভৌগোলিক রেখা নয়—এটি দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সামনে চ্যালেঞ্জ বড় কিন্তু তার মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়। এখন প্রয়োজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কূটনীতি, শক্তিশালী সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, আঞ্চলিক সহযোগিতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়। সংকট যতই গভীর হোক, বাংলাদেশকে এ সমস্যার সামনে দুর্বল নয়, দৃঢ় ও বিচক্ষণ রাষ্ট্র হিসেবে দাঁড়াতে হবে। কারণ সীমান্ত যদি স্থিতিশীল না হয়, নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত না হয় তাহলে দেশের ভবিষ্যৎও অনিশ্চয়তায় ডুবে যায়। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে—সীমান্তের স্থিতিশীলতা মানে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট