Thursday 27 Nov 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিজিটাল হ্যারেসমেন্ট: নারীর মুখ বন্ধ হলে সমাজ কোথায় হারায়?

সুমিত বণিক
২৭ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:২৫

আজকাল আমরা সবাই কম-বেশি সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করি। এই ডিজিটাল যুগে এসে নারীরা সোশ্যাল মিডিয়াতে শুধুমাত্র যাপিত জীবনের অম্ল-মধুর অভিজ্ঞতাই শেয়ার করছেন না, তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাধীনভাবে কথা বলছেন, প্রশ্ন তুলছেন, আর নানা অন্যায়-অসঙ্গতির প্রতিবাদও করছেন। এই ভার্চুয়াল দুনিয়া যেন আমাদের স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের জন্য নতুন একটি জানালা খুলে দিয়েছে।

কিন্তু এই স্বাধীনতার উল্টো পিঠে আছে এক ভয়ঙ্কর বাস্তবতা! অনলাইনে কথা বলতে গেলেই অনেক সময় তার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হয় আক্রমণাত্মক এবং ভয়ঙ্কর। যখন মত প্রকাশের এই স্বাধীনতা নারীদের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো হয়ে ওঠে, তখন শুধু তাদের জীবনই না, পুরো সমাজটাই যেন থমকে যায়, পিছিয়ে পড়ে। আসলে, সাইবার বুলিং ও ডিজিটাল হ্যারেসমেন্ট এখন আর কেবল কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি সামাজিকভাবে ভয়ংঙ্কর বিপদের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই ব্যবহার করে তৈরি করা নকল ছবি বা ভিডিও অর্থাৎ ডিপফেক দিয়ে মানহানি করার ঘটনাও খুব বাড়ছে।

বিজ্ঞাপন

নভেম্বর ২৫ থেকে ডিসেম্বর ১০ তারিখ হলো ‘জেন্ডার-ভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনব্যাপী প্রচারাভিযান’ এর সময়। এই ১৬টি দিন বিশ্বজুড়ে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, নারীর প্রতি সহিংসতা কেবল একটি মানবাধিকার লঙ্ঘন নয়, বরং আমাদের সমাজের জন্য এক বড় সমস্যা। এটি আমাদের সম্মিলিত উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা। ২০২৫ সালের এই প্রচারণার মূল ভাবনা বা থিম হলো: ‘সকল নারী ও কন্যার বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা বন্ধ করতে ঐক্যবদ্ধ হোন’। এই থিমটি আজকের দিনে অত্যন্ত জরুরি, কারণ প্রযুক্তির ব্যবহারের সাথে সাথে নারীরা একটি নতুন ধরনের বিপদের সম্মুখীন হচ্ছেন – যা হলো ডিজিটাল সহিংসতা।

এই বিশ্বব্যাপী প্রচারণার আয়োজন যখন চলছে, তখন বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার দিকে নজর দেওয়া খুবই জরুরি। আমাদের দেশেও নারীর প্রতি সহিংসতা একটি বড় সমস্যা, আর এখন এই সহিংসতার ধরন বদলাচ্ছে। সাইবার জগৎ বা ইন্টারনেট এখন নারী ও মেয়েদের জন্য একটি নতুন আক্রমণের ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, হয়রানি করা, ছবি বিকৃত করা বা অনলাইনে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের মতো ঘটনাগুলো বাংলাদেশে দ্রুত বাড়ছে। এর ফলে অনেক নারী ও মেয়ে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন, এমনকি নিজেদের জীবনও বিপন্ন মনে করছেন।

এই পরিস্থিতিতে, ২০২৫ সালের থিমটি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই প্রচারণার মাধ্যমে আমাদের সমাজকে বোঝাতে হবে যে, শারীরিক সহিংসতার মতোই ডিজিটাল সহিংসতাও গুরুতর অপরাধ। সরকার, পুলিশ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষ করে পরিবার—সকলের উচিত এই ধরনের সহিংসতা রোধে এগিয়ে আসা। নারী ও মেয়েদের নিরাপদ অনলাইন জীবন নিশ্চিত করতে এবং এই অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে সম্মিলিতভাবে কাজ করা দরকার। ১৬ দিনের এই কর্মযজ্ঞ বাংলাদেশে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার জন্য একটি নিরাপদ ও সমান সমাজ গড়ে তোলার জন্য কাজ করার জন্য একটি বৈশ্বিক আহ্বান ও প্রেরণা।

এই বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ ও গবেষণার সংখ্যাগত তথ্যগুলো দেখলে চমকে উঠতে হয়। কারণ আমাদের চারপাশেই এই নীরব সহিংসতা চলছে। অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের একটি জরিপে এই সংক্রান্ত ভয়ংকর কিছু তথ্য উঠে এসেছে: বাংলাদেশে ৬৩.৫১% নারী অনলাইনে কোনো না কোনোভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। হ্যারেসমেন্টের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে ফেসবুকে (৪৭.৬%), এরপরই আছে মেসেঞ্জার (৩৫.৩৭%) এবং ইনস্টাগ্রাম (৬.১১%)। এসব হয়রানির মধ্যে ৮০.৩৫% নারীই অশ্লীল বা যৌন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য পেয়েছেন, আবার ৫৩.২৮% নারী পেয়েছেন অবাঞ্ছিত বা অনাকাঙ্ক্ষিত ছবি কিংবা যৌন বার্তা। ভয়াবহ ব্যাপার হলো, ১১.৭৯% নারীর ব্যক্তিগত ছবি তাদের অনুমতি ছাড়াই অনলাইনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের হয়রানির শিকার হওয়ার পর ৬৫.০৭% নারী জানিয়েছেন যে তারা মানসিক চাপ, উদ্বেগ বা ডিপ্রেশনে ভুগেছেন। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এই নারীদের ৮৫ শতাংশই কোনো অভিযোগ করেননি—এর পেছনে কাজ করেছে ভয়, সামাজিক চাপ কিংবা পাশে কোনো ধরনের সাপোর্ট সিস্টেম না থাকা।

এই সাইবার হামলা নারীর মনে গভীর ক্ষত তৈরি করে। গবেষণা বলছে নারীরা অনলাইন হামলার ‘ক্ষতি’ সবচেয়ে বেশি অনুভব করেন—বিশেষত ব্যক্তিগত ছবি বা তথ্য ফাঁস হলে। এর ফলে যা হয়, তা হলো—অনেকেই অনলাইন হামলার ভয়ে মত প্রকাশ কমিয়ে দেন। এটি কেবল তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকেই সীমিত করে না, সেই সাথে সমাজে তাদের অংশগ্রহণকেও ব্যাহত করে। ডিজিটাল হ্যারেসমেন্টের কারণে সমাজে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রতিফলন দেখা যায়; এর মধ্যে আছে আত্মবিশ্বাস ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, মত প্রকাশের অধিকার প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া এবং গণতান্ত্রিক ডিজিটাল স্পেস সংকুচিত হওয়া। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, সাইবার অপরাধের মধ্যে ৫২.২১% হলো সরাসরি সাইবার বুলিং। অথচ আইনগত সাপোর্ট ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতির কারণে অনেক নারী অভিযোগ করতে পর্যন্ত সাহস পান না। প্রতিকার ব্যবস্থার এই ঘাটতি সামগ্রিকভাবে আরও বেশি উদ্বেগজনক।
প্রতিকার পাওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিভিন্ন ধারা ও উপধারা রয়েছে, এর মধ্যে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল জরিমানার বিধান রয়েছে। এসব ক্ষেত্রে তিন থেকে সাত সাত বছরের কারাদণ্ড, জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ডের কথা উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু কার্যকরভাবে এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের সম্মিলিতভাবে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু ভুক্তভোগীকে নয়, পাশে দাঁড়াতে হবে আমাদের সবাইকেই। প্রথমত, প্রয়োজন শক্তিশালী নীতিমালা ও দ্রুত প্রতিকার ব্যবস্থা। সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে এমন নীতিমালা তৈরি করতে হবে যা দ্রুত কাজ করে এবং অপরাধীকে সহজে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে পারে। দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল সচেতনতা ও নিরাপত্তা শিক্ষা জরুরি।

ছোটবেলা থেকেই ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে ডিজিটাল দুনিয়ার সঠিক ব্যবহার ও নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং কীভাবে নিজের তথ্য সুরক্ষিত রাখতে হয়, সে বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া দরকার। তৃতীয়ত, প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা ও অন্যকে সম্মান দেয়ার চর্চা। সবার আগে আমাদের সমাজকে বদলাতে হবে—অনলাইনে কোনো নারীকে অসম্মান করার অর্থ যে পুরো সমাজের মূল্যবোধকে আঘাত করা—এই বোধ তৈরি করতে হবে এবং একে অপরের প্রতি সম্মান ও সহমর্মিতা বাড়াতে হবে। সবশেষে, ডিজিটাল হ্যারেসমেন্টের শিকার নারীদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করা দরকার, যেখানে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের কথা শোনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

নারীর প্রতি অনলাইন অবমাননা বা হামলা কেবল একটি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয় —এটি আমাদের সমাজের মূল্যবোধ, ন্যায্যতা এবং মানবাধিকারকে আঘাত করে। আসুন, আমরা সবাই মিলে প্রতিজ্ঞা করি—আমরা আর চুপ থাকব না। সাইবার বুলিং বন্ধ করা মানে একটি ন্যায়ভিত্তিক, নিরাপদ এবং মানবিক ডিজিটাল সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে নারী তার কণ্ঠস্বরকে ভয় নয়, বরং আত্মবিশ্বাসের সাথে প্রকাশ করতে পারবে। নারীর মুখ বন্ধ করতে চাইলে যে সমাজ কোথায় হারায়, সেই প্রশ্নটি আজ আমাদের সবার সামনে বড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক

সারাবাংলা/জিএস/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর