একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এইচআর ম্যানেজার হিসেবে দূর্দান্ত ক্যারিয়ার ছিলো রত্নার। প্রথম সন্তান গর্ভে আসায় শাশুড়ি মায়ের আদেশে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছাড়তে হয় চাকরী। বর্তমানে তার বয়স ৪৭ বছর। স্বামী আর দুই সন্তান নিয়ে তার পরিবার। রত্নাকে যেনো আর হাসিমুখে দেখে না কেউ। কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই। ডায়াবেটিক, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা রোগ ধরেছে তাকে। সামাজিক কোন অনুষ্ঠানেও আর যেতে চায় না রত্না। একা ঘরে শুয়ে বসে থাকে। স্বামীর সাথেও খুব একটা কথা বলেনা। যেনো জীবন থেকে মায়া উঠে গেছে তার। রত্নার ছেলেমেয়েগুলোও কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যে যার মতো ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে। ছেলেটা মাদক আসক্ত। মেয়েটা কেবল ছবি আঁকে আর কথায় কথায় রেগে যায়। পুরো পরিবারটাই যেনো ছন্নছাড়া।
কিছুদিন আগে স্নাতক পাশ করা ২৩ বছর বয়সী তন্বি স্বপ্ন দেখেছিলো উদ্যোক্তা হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াবে, বাবা-মায়ের আর্থিক অস্বচ্ছলতা ঘোঁচাবে। কিন্তু পরিবার থেকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। স্বামীর পরিবার চায় না সে কাজ করুক। তাই, নিজের ইচ্ছাতে মেরে ফেলে সবার কথা মেনে নিতে হয় তার। বাবা-মা পরিস্কার জানিয়ে দিয়েছে স্বামীর ঘর করতে না পারলে তন্বিও জন্য বাবার বাড়ির দরজা বন্ধ।
রাফিজা ১ বছর বয়সী সন্তানের মা। চাকরীজীবী। অনেক বছর চেষ্টা করেও সন্তান হচ্ছিলো না। বহু অপেক্ষার পর সন্তানের মুখ দেখেছে রাফিজা। মাতৃত্বকালীন ছুটি শেষে অফিসে ফিরে একদমই কাজে মন বসে না তার। ঘরে এতো ছোট বাচ্চা কাজের মেয়ের হাতে দিয়ে এসেছে। যদিও ঘরের কোনায় কোনায় ক্যামেরা লাগিয়ে অফিসে বসে বাচ্চার দিকে নজর রাখে সে। তবুও চিন্তায় কাজে মনযোগ দিতে পারে না সে। হঠাৎ একদিন রাফিজার ছেলে রান্নাঘরে গিয়ে চুলার আগুনে হাত দিয়ে অনেকটা পুড়ে যায়। গুরুতর আহত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়ে রাফিজা। নিত্যদিনই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ভেবে বাধ্য হয়ে চাকরী ছেড়ে সন্তানের দিকে মনযোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কেবলই ভাবে, অফিসে ডে-কেয়ার বা শিশু দিবাযত্ন সেন্টার থাকলে চাকরিটা ছাড়তে হতো না তার।
এসব নারীদের কেউই কর্মজীবন ছেড়ে ঘরের কোনায় পড়ে থাকতে চাননি। নিজেদের মেধা কাজে লাগিয়ে সফলতাকে, আর্থিক সচ্ছলতার মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক রীতিনীতির বেড়াজালে তা আর হয়ে ওঠে নি। এবিষয়ে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সালাউদ্দিন কাউসার বিপ্লব বলেন, সৃজনশীল কাজের মাধ্যমে মানুষ তার মেধা-মননের সাক্ষর রাখে। আর আর্থিক স্বচ্ছলতা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কোন মানুষকে আত্মনির্ভরশীল ও আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তবে, সেটি বাধা পেলে সৃষ্টিশীল কাজে মন দিতে না পারার যে আক্ষেপ তা মানুষের মনে নেতিবাচক ছাপ ফেলে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাওকে কোন কাজে বাধ্য করা হলে তখন সে বিষয়টি তার কাছে বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। সংসার জীবন হলো সাদরে হাসিমুখে আঁকড়ে বেঁচে থাকার মতো জীবন। কিন্তু জোর করে সে জীবনে কাওকে বেঁধে রাখতে গেলে তা সুখকর না হয়ে পরিবারের সবার মানসিক অশান্তির কারন হতে পারে। ফলে হতাশা, মনোমালিন্য, পারিবারিক গন্ডোগোল তৈরি হয়। শারীরিকভাবেও এমন পরিস্থিতি মানুষকে অসুস্থ করে তোলার আশঙ্কা থাকে। উচ্চ-রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোকসহ নানা রোগ দেখা দিতে পারে। তাই, কারো ওপর কিছু চাপিয়ে না দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে যে কোন সমস্যার সমাধান খোঁজা উচিৎ। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক থাকলে একে অপরের ভালো লাগা-মন্দ লাগাগুলো জেনে নেয়া যায়। পরস্পরকে বুঝতেও সুবিধা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. মশিউর রহমানের মতে, বিয়ে, সন্তান জন্মদান মানুষের জীবনের স্বাভাবিক ঘটনা। তবে প্রাচীনকাল থেকে যেহেতু নারীরা গৃহস্থালীর সব কাজ সামলে আসছে, সামাজিকভাবে যে দায়িত্ব নারীদের ওপরই চাপিয়ে দেয়া হয়। তবে, যুগের সাথে সে অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। এখন দেশের অনেক নারীরাই সংসার সন্তান সামলে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়ছেন। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে ঘরে বাইরে তাদেরকে অতিরিক্ত কাজের চাপ সামলাতে হচ্ছে। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা গেলে পুরুষরা যদি সংসারের কাজ ভাগ করে নেন তাহলে কর্মক্ষেত্রেও নারীদের পদচারনা বৃদ্ধি পাবে। সেই সাথে বিভিন্ন অফিসগুলোতে শিশু-দিবাযত্ন বা ডে কেয়ার সেন্টার চালু থাকলে তা নারীদের কাজের পরিবেশ স্বাচ্ছন্দকর করে তুলবে। নারীরা পুরুষের পাশাপাশি বিভিন্ন পেশায় কাজের সুযোগ পেলে দেশের অর্থনীতির জন্যেও তা মঙ্গলজনক। দেশের জিডিপি বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে মনে করেন তিনি।
লেখক: সাংবাদিক