সীমান্ত একটি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং রাজনৈতিক স্থিতির মূল ভিত্তি। তাই সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেকোনো রাষ্ট্রের অন্যতম জরুরি দায়িত্ব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এমন এক অবস্থানে অবস্থিত, যেখানে দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমার দুটি দিক ঘিরে রেখেছে, আর দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। স্থল, নৌ বা সমুদ্র সব ধরনের সীমান্ত নিয়েই এখানে জটিলতা, সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ সমানভাবে মুখোমুখি হয়। সীমান্ত নিরাপত্তা শুধু অস্ত্রধারী শত্রুর আক্রমণ ঠেকানো নয়, বরং এটি একটি বহুস্তরীয় প্রক্রিয়া, যেখানে রয়েছে চোরাচালান প্রতিরোধ, মানব পাচার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্র ব্যবসা রোধ, সীমান্ত হত্যা কমানো, জলসীমায় সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং সীমান্তবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়। তবে এর পাশাপাশি রয়েছে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় না হলে সীমান্ত নিরাপত্তা কখনোই পুরোপুরি নিশ্চিত করা যায় না। তাই সীমান্ত নিরাপত্তা ও কূটনীতি কার্যত একে অপরের পরিপূরক।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত বিশ্বের দীর্ঘতম অ-সামরিক সীমান্তগুলোর একটি। এই সীমান্তের প্রাকৃতিক গঠন জটিল কোথাও পাহাড়, কোথাও ঘন বন, কোথাও নদী, আর কোথাও জনবসতি। এসব কারণে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন হয়ে পড়ে। বছরের পর বছর ধরে চোরাচালান, গবাদি পশু পাচার, মাদকদ্রব্য প্রবাহ, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং কখনো কখনো সীমান্ত হত্যা এই সীমান্তকে উত্তপ্ত করে তুলেছে। সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) উভয়েই টহল জোরদার করলেও বাস্তবতা জটিল। কারণ সীমান্তের দুই পাশে বসবাসকারী মানুষদের জীবন-জীবিকা, অর্থনৈতিক অবস্থা, সংস্কৃতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক জায়গায় একই রকম। অনেকের ব্যবসা-বাণিজ্য, আত্মীয়তার সম্পর্ক কিংবা দৈনন্দিন কাজ সীমান্ত পেরিয়ে চলে যায়। ফলে কঠোর নজরদারি মানে কখনো সাধারণ নাগরিকের জীবনে জটিলতা সৃষ্টি করা। এর ফলে সীমান্তে মানবিক ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয় এবং অনেক সময় তা সহিংসতায় রূপ নেয়। সীমান্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে তাই মানবাধিকার, স্থানীয় মানুষের প্রয়োজন এবং নিরাপত্তা—এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়, যা সবসময় সহজ নয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বাস্তবতা তৈরি করে। এই সীমান্তের বেশিরভাগ জুড়েই পাহাড়ি অরণ্য, উঁচুনিচু ভূমি এবং দূরবর্তী এলাকার বিস্তৃতি। এখানে মূল সমস্যা হচ্ছে মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সেখানে সামরিক জান্তার আগ্রাসী নীতি এবং রাখাইন সংকট। ২০১৭ সালের রোহিঙ্গা গণহত্যা ও জাতিগত নির্মূল অভিযান লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে। এর ফলে দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত শুধু মানবিক সংকটেই আক্রান্ত হয়নি, বরং নিরাপত্তা ঝুঁকিও বহুগুণে বেড়ে গেছে। এত বিপুল সংখ্যক উদ্বাস্তুকে ধারণ করা বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাগত চাপ তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে মাদক কারবারির গ্রুপ, সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক, অস্ত্রধারী দল ও সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠায় সীমান্ত এলাকা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। মিয়ানমারের ভেতরে বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ মাঝে মাঝে বাংলাদেশের ভেতর পর্যন্ত গুলি বা শেল এসে পড়ার ঘটনা ঘটায়। এসব পরিস্থিতিতে সীমান্তে শান্তি বজায় রাখা এবং নাগরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য একটি অত্যন্ত কঠিন কাজ।
সীমান্ত নিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় যে চ্যালেঞ্জটি দেখা যায় তা হলো চোরাচালান ও মাদক-দ্রব্যের অবৈধ বাণিজ্য। বিশেষত ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ মিয়ানমার থেকে নদী বা পাহাড়ি পথ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই মাদক ব্যবসার সাথে সীমান্তের দুই পাশের গ্রুপ যুক্ত থাকায় এটি সহজে নির্মূল করা কঠিন। এছাড়া সীমান্তজুড়ে রয়েছে মানব পাচার, নারী পাচার ও বন সম্পদ পাচারের মতো অপরাধ, যা একদিকে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে, অন্যদিকে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে দুর্বল করে। সীমান্তের অপরাধগুলো সাধারণত ট্রান্সন্যাশনাল অর্থাৎ এক দেশের অপরাধী অন্য দেশে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয় পায়। তাই নিরাপত্তা বাহিনী যতই শক্তিশালী হোক, কূটনৈতিক সহযোগিতা ছাড়া এসব অপরাধ বন্ধ করা সম্ভব নয়।
সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো প্রযুক্তির ব্যবহার। আজকের দিনে ড্রোন নজরদারি, স্যাটেলাইট ইমেজিং, থার্মাল ক্যামেরা, নো-ম্যানস-ল্যান্ডে উন্নত সার্ভেইল্যান্স ব্যবস্থা এগুলো কোনো বিলাসিতা নয়, বরং অপরিহার্য। তবে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হলে প্রয়োজন বাজেট, প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক নিরাপত্তা কৌশল। কিন্তু প্রযুক্তি দিয়ে সবকিছু সম্ভব নয়। কারণ অপরাধী বা পাচারকারীরা সবসময় নতুন পথ, নতুন কৌশল বের করে। ফলে নিরাপত্তা বাহিনীকে শুধু শক্তিশালী নয়, বুদ্ধিমান, অভিজ্ঞ এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী নমনীয় হতে হয়। সীমান্ত প্রহরীদের মানুষ হিসেবে স্থানীয়দের উপর নির্ভর করতে হয় তথ্য সংগ্রহের জন্য। কিন্তু সীমান্ত এলাকার মানুষের জীবনমান নিচু হলে তারা অনেক সময় চোরাচালানকারীদের অর্থের প্রলোভনে আকৃষ্ট হয়। তাই সীমান্ত নিরাপত্তায় স্থানীয় মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সচেতনতা অপরিহার্য।
সীমান্ত নিরাপত্তায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো জলসীমা ও সমুদ্রভিত্তিক নিরাপত্তা। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নৌসীমা বিশাল, এবং সেখানে রয়েছে মৎস্যসম্পদ, শক্তিসম্পদ, বাণিজ্যরুট এবং কৌশলগত গুরুত্ব। জলদস্যুতা, মৎস্যসম্পদ লুণ্ঠন, অবৈধ জলযান চলাচল এবং বিদেশি জাহাজের অননুমোদিত ঢুকে পড়া এসবই সমুদ্রসীমার নিরাপত্তাকে নাজুক করে তোলে। নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড এসব ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও সমুদ্র নিরাপত্তা অনেক সময় আঞ্চলিক কূটনীতির উপর নির্ভর করে। ভারত, মিয়ানমার, চীন এবং অন্যান্য সামুদ্রিক শক্তির রাজনৈতিক অবস্থান অনেক সময় সমুদ্রসীমায় উত্তেজনা তৈরি করতে পারে।
এখন আসে কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের কথা। সীমান্ত নিরাপত্তা শুধু অস্ত্র বা সৈন্য দিয়ে নিশ্চিত করা যায় না; বরং প্রতিবেশী দেশের সাথে স্থিতিশীল, বিশ্বাসভিত্তিক এবং সক্রিয় কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকলে যেকোনো সময় উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। বাংলাদেশের জন্য ভারতের সাথে সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পানি বণ্টন, সীমান্ত হত্যা, বাণিজ্য, যোগাযোগ এসব বিষয় কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে এগোয়। তবে শত বছরের সীমান্ত সমস্যার সমাধানে যদিও যৌথ টহল, ডিপ্লোম্যাটিক আলোচনা ও বিভিন্ন চুক্তি কাজ করছে, তবুও সীমান্তে মানুষের মৃত্যু বা উত্তেজনা কমানো এখনো চ্যালেঞ্জ। একইভাবে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক কূটনৈতিকভাবে আরও জটিল। রোহিঙ্গা সংকটের ন্যায় একটি মানবিক ট্রাজেডি যখন সীমান্তে প্রতিদিন নতুন সমস্যার জন্ম দেয়, তখন কূটনীতিকে যেমন শক্তিশালী হতে হয়, তেমনি কোমলও হতে হয়। কারণ শক্ত অবস্থান নিলেই উত্তেজনা তৈরি হতে পারে, আর দুর্বল অবস্থান নিলে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ে। তাই দু’পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ।
এছাড়া আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতি সীমান্ত নিরাপত্তায় প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলে। দক্ষিণ এশিয়া এমন একটি অঞ্চল যেখানে ভারত-চীন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল, রোহিঙ্গা মানবাধিকার ইস্যু, এমনকি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিও প্রভাব ফেলে। ফলে সীমান্ত নিরাপত্তা অনেক সময় কেবল স্থানীয় সমস্যা থাকে না; বরং এটি বড় ভূ-রাজনৈতিক খেলায় পরিণত হয়। বাংলাদেশকে তাই অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বহুমুখী কূটনৈতিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার সমন্বয় করতে হয়।
সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে সম্ভাবনাও। সীমান্তকে শুধু ঝুঁকি হিসেবে দেখলে হবে না; বরং এটি অর্থনীতি, বাণিজ্য, পর্যটন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রেও শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে। যদি সীমান্ত ব্যবস্থাপনা আরও স্মার্ট, মানবিক ও প্রযুক্তিনির্ভর হয়, এবং যদি প্রতিবেশী দেশের সাথে সহযোগিতা বাড়ে, তবে সীমান্ত এলাকায় শিল্প, বাজার, সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের বিকাশ ঘটতে পারে। এর ফলে সীমান্তের নিরাপত্তাও বাড়বে, কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়ন মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ একে অপরের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া কূটনীতি সফল হয় না, আর সফল কূটনীতি ছাড়া সীমান্ত কখনোই পুরোপুরি নিরাপদ হয় না। বাংলাদেশকে তাই একইসাথে নিরাপত্তা জোরদার, কূটনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি ব্যবহার, স্থানীয় মানুষের জীবনমান উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা আরও গভীর করতে হবে। ভূ-রাজনীতি যেমন পরিবর্তনশীল, তেমনি সীমান্ত-নিরাপত্তাও একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়ের সাথে সাথে নতুন হুমকি আসবে, নতুন কৌশল প্রয়োজন হবে, আর কূটনৈতিক ভাষাও আরও সূক্ষ্ম হতে হবে। বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী রাখতে সীমান্ত নিরাপত্তা তাই সর্বদাই অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়