Saturday 13 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (ইউএইচসি): স্বপ্নপূরণে কোথায় আটকে আছে বাংলাদেশ?

সুমিত বণিক
১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৩:৫৯

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে—মানুষ কি প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে? আর যা পাচ্ছে তা সাশ্রয়ী খরচে পাচ্ছে? ঠিক এই জায়গাতেই আসে ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ বা সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা বা সুরক্ষা (ইউএইচসি)–এর ধারণা। সহজ ভাষায় ইউএইচসি মানে হলো, দেশের প্রতিটি মানুষ যেন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওষুধ, পরীক্ষা, প্রতিরোধমূলক সেবা, পুনর্বাসন, এমনকি প্যালিয়েটিভ কেয়ারসহ সবধরনের স্বাস্থ্যসেবা পায় আর সেই সেবার খরচ যেন তাকে আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত না করে।

বিভিন্ন গবেষণা দেখায়, বাংলাদেশে চিকিৎসা খরচের সবচেয়ে বড় অংশ বহন করে মানুষ নিজের পকেট থেকে। বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ –এর রিপোর্ট বলছে, দেশের স্বাস্থ্যব্যয়ের ৬৭ থেকে ৭০ শতাংশ আসে আউট-অফ-পকেট (ওওপি) খরচ থেকে— যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও অন্যতম বেশি। এর ফলে প্রতি বছর অসংখ্য পরিবার দারিদ্র্যের দিকে ধাবিত হয় শুধুমাত্র চিকিৎসা খরচ বহন করার কারণে।

বিজ্ঞাপন

ইনইকুইটি বা বৈষম্যও একটি বড় সমস্যা। গ্রামে, পাহাড়ে ও দুর্গম অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষ আজও মৌলিক চিকিৎসা পেতে সংগ্রাম করে। সরকারি হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো কিছু জায়গায় খুবই কার্যকর হলেও, অনেক এলাকায় চিকিৎসক সংকট, ওষুধের অভাব, ও সেবার মানের সমস্যা দেখা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যৌথ মূল্যায়নে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা মান ও সক্ষমতা—দুই দিকেই আরো উন্নতির দরকার রয়েছে।

দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত বর্তমানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। চিকিৎসা ব্যয়ের ঝুঁকি দিন দিন বাড়ছে; ২০১৭ সালের আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৫-১৮ শতাংশ পরিবারকে ক্যাটাষ্ট্রোফিক হেলথ এক্সপেন্ডিচার বা ভয়াবহ আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে হয়। এই প্রেক্ষাপটে, সিপিডি-এর ২০২৫ সালের পলিসি ব্রিফ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা ছাড়া সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (ইউএইচসি) অর্জন করা সম্ভব নয়। যদিও আইসিডিডিআর,বি’র বিশ্লেষণ বলছে, দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা আসে বেসরকারি খাত থেকে, কিন্তু এই খাতের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এখনো দুর্বল।

পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে নন-কমিউনিকেবল বা অসংক্রামক রোগগুলোর (এনসিডি) ক্রমবর্ধমান চাপ; ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ও কিডনি রোগের মতো দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা সমাজের ওপর বড় বোঝা তৈরি করছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে একটি অত্যাবশ্যকীয় সেবা হিসেবে চিহ্নিত করলেও, বাংলাদেশে এটি এখনো কেবল শহরকেন্দ্রিক এবং সীমিত পর্যায়ে রয়ে গেছে।

স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতি ঘটলে দেশের সাধারণ মানুষ বহুলাংশে উপকৃত হবে। প্রথমত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, তাদের চিকিৎসা খরচের চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে। একই সাথে, গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য হবে, যার ফলে শহরের ওপর চাপ কমবে এবং স্বাস্থ্য বৈষম্য হ্রাস পাবে। এই সেবা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে ভুল চিকিৎসা ও অব্যবস্থাপনা কমে আসবে, যা সেবার গুণগত মান নিশ্চিত করবে। এছাড়া, উন্নত প্রাথমিক ও জরুরি সেবার ফলস্বরূপ মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার আরও কমানো সম্ভব হবে, যা জনস্বাস্থ্যে একটি বিশাল ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অন্যদিকে, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস বা ক্যান্সারের মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে। সবশেষে, প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মতো অত্যাবশ্যকীয় সেবার সম্প্রসারণ ঘটলে গুরুতর অসুস্থ রোগীরাও উন্নত জীবনমান ও যত্ন পাবেন, যার ফলে তাদের প্যালিয়েটিভ কেয়ারে প্রবেশাধিকার বাড়বে। সামগ্রিকভাবে, এই সুবিধাগুলো দেশের নাগরিকদের জন্য একটি সুস্থ, নিরাপদ এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বস্তিদায়ক ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবে।

সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা (ইউএইচসি) অর্জনের জন্য একটি বহুমাত্রিক এবং সুসংগঠিত কৌশল অবলম্বন করা বাংলাদেশ সরকারের জন্য অপরিহার্য। এই লক্ষ্য পূরণে প্রথমত, সরকারি স্বাস্থ্য বাজেট উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে হবে এবং সেই বাজেটকে স্বাস্থ্যসেবার তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকরভাবে কাজে লাগাতে হবে। এর পাশাপাশি, ইউএইচসি-র ভিত্তি হিসাবে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা সবচেয়ে জরুরি, যাতে প্রতিটি নাগরিক ঘরের কাছেই মানসম্মত সেবা পেতে পারে। দ্বিতীয়ত, দেশের স্বাস্থ্যসেবার একটি বড় অংশ সেবা প্রদানকারী বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতকে কার্যকর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনতে হবে, যাতে সেবার মান নিশ্চিত হয় এবং রোগীদের আর্থিক শোষণ বন্ধ হয়।

তৃতীয়ত, চিকিৎসা ব্যয়ের বোঝা কমাতে যত দ্রুত সম্ভব একটি জাতীয় স্বাস্থ্যবীমা চালু করা প্রয়োজন। সফল বাস্তবায়নের জন্য প্রশিক্ষিত জনশক্তির বিকল্প নেই, তাই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি এবং তাদের যথাযথভাবে কাজে লাগানোকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সবশেষে, গুরুতর অসুস্থদের জন্য মানবিক সেবা নিশ্চিত করতে প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা প্রশমন সেবাকে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত এবং সকল স্তরের সেবার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা আবশ্যক। এই সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপগুলোই বাংলাদেশে ইউএইচসি-র পথ সুগম করতে পারে।

১২ ডিসেম্বর, ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) বা সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা দিবস উদযাপনের এই ক্ষণে আমরা এই সত্যটি আবারও উপলব্ধি করাতে চাই যে, ইউএইচসি কেবল একটি স্বাস্থ্যনীতি বা লক্ষ্য নয়; এটি হলো মানুষের মৌলিক মর্যাদা, আর্থিক সুরক্ষা এবং একটি সুস্থ, কর্মক্ষম সমাজ গড়ে তোলার মূল ভিত্তি। বাংলাদেশে, যেখানে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ভার এখনো বহু পরিবারকে আর্থিক বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়, সেখানে ইউএইচসি বাস্তবায়নের গুরুত্ব অপরিসীম। তৃণমূল থেকে শুরু করে উচ্চতর চিকিৎসা পর্যন্ত সকলের জন্য সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি।

রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সুপরিকল্পিত বিনিয়োগ (বিশেষ করে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায়), এবং বেসরকারি খাতকে সুনিয়ন্ত্রিত করার মাধ্যমে বাংলাদেশে ইউএইচসি বাস্তবায়ন অবশ্যই সম্ভব। ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ (ইউএইচসি) দিবস উপলক্ষে আমরা সেই দিনের স্বপ্ন দেখি, যেদিন দেশের প্রতিটি নাগরিক ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে, বিনা দ্বিধায় এবং আর্থিক দুশ্চিন্তা ছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা লাভ করবেন। ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’ – এই লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ তার প্রতিটি মানুষের জন্য এক বড় ধরনের কল্যাণ এবং একটি মর্যাদাপূর্ণ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে পারবে।

লেখক: জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর