Saturday 13 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংস্কৃতি জাতি ও রাস্ট্রের রক্ষাকবচ

কাজী মাসুদুর রহমান
১৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:১৯

‘আজি এ হেমন্ত প্রাতে /কে তুমি রাঙিছো?/ তৃষিত এ হিয়া/ভাসাতে পূর্ণিমা রাতে’ – এভাবেই আবহমান শ্যামল বাংলার সোনালী ধানে, হেমন্ত জাগে চিরায়ত বাঙালি মননে প্রাণে। ইতোমধ্যে, পাকা ধানের সম্ভারে পল্লী বাংলার উঠোন সোনালী হয়ে উঠেছে। সুমিষ্ট সৌরভে সুরভিত হয়ে উঠেছে আকাশ-বাতাস। গ্রামে-গ্রামে নবান্ন উৎসবের শিহরণ জেগেছে। নবান্নের রং লেগেছে পাহাড়ি পল্লীতে। নতুন ধানের সুগন্ধি আমেজ আসন্ন পৌষপার্বণের সরস পিঠার বার্তা দিচ্ছে। এভাবে প্রতিটি ঋতুর রূপায়নে বাঙালির সুখ-দু:খ আবর্তিত হয়।এভাবেই ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যময়তায় বাঙালির সংস্কৃতি জাগে পরম মমতায়।

প্রসঙ্গত, সংস্কৃতি হলো মানুষের সহজাত ‘প্রবৃত্তি’ ও ‘প্রকৃতি’ এর সুসভ্য ও শৈল্পিক রূপ। এটি একটি মানবীয় উপাদান। এই মানবীয় প্রবৃত্তি (tendency) ও প্রকৃতি (characteristic) সংশ্লিষ্ট ভূ-অঞ্চলের চিরায়ত প্রকৃতির স্পর্শে উৎকর্ষিত হয়ে শিল্পভাব ধারণ করে তা মানুষের আচরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। আবহমানকাল হতে প্রজন্ম পরম্পরায় চর্চিত এই আচরণ মননশীল আচারে রূপায়িত হয়ে সংস্কৃতির জন্ম দেয়। সংস্কৃতি জন্ম দেয় জাতিসত্তা। জাতিসত্তা জন্ম দিতে পারে রাষ্ট্র। সুতরাং, সংস্কৃতি হলো মানব জীবনের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ফলে, এটি সমাজ ও রাষ্ট্রের সংবেদনশীল অঙ্গ। বিশেষ করে জাতিভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এটি একটি অপরিহার্য উপাদান।

বিজ্ঞাপন

উল্লেখ্য , সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সূত্রে বাংলাদেশ একটি জাতিরাষ্ট্র। বাঙালি সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত বাঙালিজাতি এবং বাঙালি জাতীয়তাবোধ থেকে উদ্ভূত ‘বাংলাদেশ’ নামক এই রাষ্ট্র। অর্থাৎ, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ই হলো এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রসত্তা ও রাজনৈতিক সত্তা। ‘বাঙালি জাতিসত্তা’ হতে প্রসূত ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর পরম উপলব্ধি থেকে জাগরিত ঐতিহাসিক ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। এই বিশুদ্ধ বাস্তবতায় ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ শুধু বাঙালি জাতির সত্তাই নয় উপরন্তু বাংলাদেশ রাষ্ট্রেরও সত্তা বটে।

বলাবাহুল্য, সংস্কৃতি হল স্বদেশ প্রেমের ভিত্তি। আর, স্ব-জাতীয়ভাষা বা মাতৃভাষা হল সংস্কৃতির সবচেয়ে শক্তিশালী উপাদান; কেননা, মাতৃভাষার মাধ্যমে সংস্কৃতি সবচেয়ে বেশি গ্রথিত ও বিকশিত হয়। তাই বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের সম্ভাব্য জন্ম রোধ করার মধ্যদিয়ে তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক স্বার্থ চরিতার্থ করার সুদুর প্রসারী কুপরিকল্পনার অংশ হিসাবে ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদআলী জিন্নাহ তদানীন্তন নিখিল পাকিস্তানের ৫৪.৬ শতাংশ জনগোষ্ঠীর (বাঙালি) মাতৃভাষার ওপর মাত্র ৭.২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর (পাকিস্তানি) উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সর্বপ্রথম বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানার অপচেষ্টা চালায়। এ লক্ষ্যে ’৫২তে শুধু সশস্ত্র আঘাতই নয়, পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে ‘অনৈসলামিক’ তকমা লাগিয়ে তা সাম্প্রদায়িকীকরণের মধ্য দিয়ে পূর্ববাংলার মুসলমানদের মননে বাঙালিসংস্কৃতি বিরুদ্ধ মনস্তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার বুদ্ধিবৃত্তিক কূটকৌশল এঁটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা। ১৯৫৮ সালে সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান পূর্ব বাংলায় নতুন এক ফন্দি আঁটেন। তিনি উর্দু ও বাংলার সংমিশ্রণে রোমান হরফের নতুন এক ভাষা প্রচলনের জন্য ভাষা সংস্কার কমিটি গঠন করেন। এমনকি বাঙালির জাতিসত্তা ও স্বদেশসত্তার প্রেমাবেগ রোধকল্পে কবিগুরুর অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা…’ গানটিও তারা নিষিদ্ধ করেছিলেন।

এভাবে বাঙালি জাতিসত্তার চেতনা রোধ করার মধ্যদিয়ে পূর্ববাংলার স্বাধিকারের চেতনা নস্যাৎ করার নস্ট মানসে তারা ধারাবাহিকভাবে সাংস্কৃতিক অগ্রাসন চালায়।

বাঙালি হল পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন জাতি যার নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস অত্যন্ত বর্ণিল ও বৈচিত্র্যময়। যেহেতু সংস্কৃতি নৃবিজ্ঞানেরই একটি পরিমার্জিত শাখা তাই বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্য খুবই মনোগ্রাহী ও শৈল্পিক। বাঙালি সংস্কৃতির নেপথ্যে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক যুগের আর্য ও অনার্য নৃ-গোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় বিবর্তিত সংস্কৃতির স্রোতধারা। হাজার-হাজার বছর পূর্বে এই বঙ্গীয় অববাহিকায় আগত ও জন্মিত আর্য-অনার্য মানুষের চিন্তা, চেতনা ও জীবনধারা বঙ্গীয় শ্যামল ভূ-প্রকৃতির সংমিশ্রণে উৎকর্ষিত হয়ে এক মনোগ্রাহী সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। সেই সংস্কৃতির আবহে এ অঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, রুচি- অভিরুচি, স্বপ্ন-সাধ কখনো বাঁশির সম্মোহনী টানে, ধ্রুপদী নৃত্যে,চারু-কারু’র আল্পনায় প্রতিফলিত হয়। কখনোবা জারি, সারি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, মারেফতি, বাউল,পালা, কবিয়াল, পুঁথিগীতি’র হৃদয়গ্রাহী মূর্ছনায় প্রকাশিত হয়। আবার কখনো- একতারা, দোতারা, নাল, ঢোল, খোল, ডুগি’র ঐকতানে প্রতিধ্বনিত হয়। এটাই মনোহরি বঙ্গীয় বা বাঙালি সংস্কৃতি যা ধর্ম বর্ণ গোত্র নির্বিশেষে সকলকে একসুতোয় গেঁথে এক অসাম্প্রদায়িক সাম্যের মানবিকতা জন্ম দেয়। এমন সর্বজনীন মানবিক সংস্কৃতি পৃথিবীর ইতিহাসে সত্যিই বিরল!

বিখ্যাত প্রয়াত গুণীশিল্পী ফরিদা পারভীন তার এক স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, প্রবাসে আয়োজিত এক সঙ্গীতানুষ্ঠানে তার গাওয়া লালনগীতির পরিবেশনায় বিমোহিত হয়ে জনৈক বিদেশি দর্শক মন্তব্য করেছিলেন, ‘যে দেশের লোকগীতির আবেদন ও নিবেদন এত হৃদয়গ্রাহী ও মানবিক সে দেশের মানুষ মানুষকে ক্ষতি করতে পারেনা।’

বস্তুত: সংস্কৃতি মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটায়; ঘটায় মানবিকতার বিকাশ; জাগায় স্বদেশপ্রেম বোধ। বলাযায়, কোন জাতিকে পক্ষঘাতগ্রস্ত ও কোন রাষ্ট্রকে বিপথগ্রস্ত করতে হলে তার সংস্কৃতিতে আঘাত হানাই যথেষ্ট।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের এই মহান সংস্কৃতিতে আঘাত হানতে এক শ্রেণীর সাম্প্রদায়িকগোষ্ঠী স্বাধীনতার পূর্বাপর ধর্মকে সূক্ষ্মভাবে ও কূটকৌশলে অপব্যবহার করে আসছে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ধর্ম ও সংস্কৃতি পরস্পর সাংঘর্ষিক নয়; বরং সংস্কৃতি ধর্মের সৃষ্টিশীল ও সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধকে শিল্পরূপ দিয়ে মানুষের মাঝে হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে পারে। পবিত্র কোরআনে বর্ণিত, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। নিশ্চয় এতে রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য নিদর্শন। [সূরা রুম; আয়াত -২২]। বর্ণিত মহাবাণীতে মহান আল্লাহ’র বিস্ময়কর সৃষ্টিলীলা প্রতিভাত হয়েছে যার উল্লেখিত প্রতিটি উপাদানই প্রত্যেক সংস্কৃতির একেকটি অবিচ্ছেদ্য ও মৌলিক অলংকার। সুতরাং, সংস্কৃতি হলো একটি ঐশ্বরিক অনুভূতি যার মধ্যে দিয়ে স্রষ্টার সৃষ্টির মাহাত্ম্য শৈল্পিক ভাবে প্রকাশ পায়। তাই, ধর্মের বিকৃত অজুহাত দিয়ে স্বজাতীয় সংস্কৃতিতে আঘাত করা প্রকারন্তরে ধর্মের কৃতিত্বে ও শ্রেষ্ঠত্বে আঘাতের সামিল। আঘাতের সামিল জাতি ও রাষ্ট্রের অস্তিত্বেও।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও গবেষক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর