১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ছিল কেবল একটি ভূখণ্ড দখলের লড়াই নয়; এটি ছিল একটি নতুন রাষ্ট্রদর্শনের জন্মঘোষণা। পাকিস্তানি শাসনামলে দীর্ঘ ২৩ বছরের অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক বঞ্চনা, ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর দমন-পীড়ন এবং সামরিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঙালি যে সশস্ত্র ও গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তার কেন্দ্রে ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, মুজিবনগর সরকারের নীতিমালা, মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ— সবকিছুই সাক্ষ্য দেয়, একাত্তরের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের রাষ্ট্র গড়া, ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসন নয়।
কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই সেই রাষ্ট্রচিন্তা বাস্তবায়নের পথ সহজ ছিল না। যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি, অবকাঠামোগত ধ্বংস, প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার ঘাটতি এবং বৈশ্বিক শক্তির রাজনৈতিক চাপ— সব মিলিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা এক জটিল বাস্তবতায় পড়ে। এর মধ্যেই ধীরে ধীরে ক্ষমতাকেন্দ্রিক মানসিকতা রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান নিয়ামকে পরিণত হয়। রাষ্ট্র ও সরকার একাকার হয়ে যেতে থাকে। ভিন্নমতকে রাষ্ট্রবিরোধিতা হিসেবে চিহ্নিত করার প্রবণতা জন্ম নেয়, যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে দেয়।একদলীয় শাসনের অভিজ্ঞতা, পরবর্তী সামরিক শাসন ও সামরিক ছায়াতলে রাজনীতির চর্চা, এরপর নির্বাচনের নামে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সংস্কৃতি— এই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ক্রমেই স্বাধীনতার মৌলিক আদর্শ থেকে দূরে সরে যায়। সংবিধানের গণতান্ত্রিক চেতনা থাকলেও বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হয় কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রযন্ত্র।
সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নেয় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ শব্দটির রাজনৈতিক অপব্যবহার। যে চেতনা ছিল জনগণের মুক্তি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতীক, সেটিকে পরিণত করা হয় ভিন্নমত দমনের হাতিয়ারে। গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ডিজিটাল ও প্রথাগত গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, প্রশাসনের দলীয়করণ এবং নির্বাচন ব্যবস্থার ক্রমাগত ভাঙন—এই সবকিছু মিলিয়ে রাষ্ট্রের ভেতরে একটি সুসংহত কাঠামোগত ফ্যাসিবাদ গড়ে ওঠে। ক্ষমতার ধারাবাহিকতা রক্ষাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য, নাগরিক অধিকার সেখানে গৌণ হয়ে পড়ে। এই দীর্ঘ ও ভারী পটভূমিতেই ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানকে মূল্যায়ন করতে হবে। এটি কোনো আকস্মিক রাজনৈতিক বিস্ফোরণ নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা ক্ষোভ, বঞ্চনা ও অবদমিত কণ্ঠস্বরের অনিবার্য বহিঃপ্রকাশ। ছাত্রসমাজের নেতৃত্বে শুরু হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই এই আন্দোলন শ্রমজীবী মানুষ, পেশাজীবী, অভিভাবক ও সাধারণ নাগরিকদের আন্দোলনে রূপ নেয়। কারণ দুর্নীতি, বৈষম্য ও দমননীতি সমাজের কোনো একটি শ্রেণিকে নয়, পুরো রাষ্ট্রকেই আক্রান্ত করেছিল।
জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল এর ভাষা ও রাজনৈতিক চেতনা। এখানে কেবল ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগ নয়, বরং রাষ্ট্র সংস্কারের স্পষ্ট দাবি উঠে আসে। বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন, প্রশাসন ও নিরাপত্তা কাঠামোর মৌলিক সংস্কারের প্রশ্ন সামনে আসে। এই আন্দোলন প্রমাণ করে দেয়— একাত্তরের চেতনা কোনো দল বা গোষ্ঠীর একচেটিয়া সম্পত্তি নয়; এটি জনগণের সামষ্টিক উত্তরাধিকার। নতুন প্রজন্ম দেখিয়ে দেয়, ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে তাকে প্রশ্ন করতে হয়, বিশ্লেষণ করতে হয় এবং প্রয়োজনে রাজপথে দাঁড়িয়ে নিজের অধিকার আদায় করতে হয়।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দেয়, ফ্যাসিবাদ কখনো হঠাৎ জন্ম নেয় না। এটি জন্ম নেয় বিচারহীনতা থেকে, জবাবদিহিহীন প্রশাসন থেকে, দলীয়করণে জর্জরিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান থেকে এবং জনগণকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বাইরে রেখে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রবণতা থেকে। ফলে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও, যদি সেই কাঠামো অক্ষত থাকে, তবে নতুন নামে ও নতুন মুখে পুরোনো শাসনের ফিরে আসার আশঙ্কা থেকেই যায়।
এই বাস্তবতায় রাষ্ট্র সংস্কারের প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বিচার বিভাগকে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন ও কার্যকর করা, নির্বাচন কমিশনকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলনিরপেক্ষ ও জনমুখী করা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা— এসব ছাড়া একাত্তরের স্বপ্ন বাস্তবায়ন অসম্ভব। গণতন্ত্রকে কেবল পাঁচ বছর পরপর ভোট দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না; তা হতে হবে অংশগ্রহণমূলক, জবাবদিহিমূলক ও ন্যায়ভিত্তিক। একাত্তরের শহীদরা যে সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেখানে নাগরিকের অধিকার শাসকের দয়ার ওপর নির্ভরশীল থাকবে না। চব্বিশের শহীদরাও সেই একই রাষ্ট্রের দাবিতে জীবন দিয়েছেন। এই দুই সময়ের আত্মত্যাগের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করাই আজকের প্রজন্মের ঐতিহাসিক দায়িত্ব।
তবে এই পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো বিভাজনের রাজনীতি। ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, বিভক্ত সমাজে ফ্যাসিবাদ সহজে পুনরুত্থান ঘটায়। তাই আজ প্রয়োজন প্রতিশোধের রাজনীতি নয়, ইনসাফের রাজনীতি। অপরাধের বিচার হবে, কিন্তু মত ও চিন্তার কারণে নিপীড়ন নয়। রাষ্ট্র পরিচালিত হবে ন্যায়, মানবিকতা ও সমতার ভিত্তিতে— এই নীতিতে জাতীয় ঐকমত্য গড়াই হবে নতুন বাংলাদেশের শক্ত ভিত।
মহান বিজয় দিবস তাই কেবল অতীত স্মরণের আনুষ্ঠানিকতা নয়; এটি ভবিষ্যৎ নির্মাণের শপথের দিন। একাত্তরের অসমাপ্ত রাষ্ট্রস্বপ্ন ও চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে— ভয় নয়, অধিকার; দমন নয়, ন্যায়। বিভাজন নয়, ঐক্য। প্রতিশোধ নয়, ইনসাফ। এই চেতনাতেই হোক নতুন বাংলাদেশের পথচলা।
মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। আজাদী দীর্ঘজীবী হোক।
লেখক: কলামিস্ট, গণমাধ্যমকর্মী ও সংগঠক