যদি দেখেন, আপনার সামনে কেউ অনায়াসে অন্যের নামে বদনাম করছে, নিশ্চিত থাকুন— সেই মানুষটি অন্যের কাছে আপনাকে নিয়েও একই কাজ করছে। কথাটি শুনতে নিষ্ঠুর মনে হলেও বাস্তবতা অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনই। বদনাম আসলে কোনো ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে নয়। এটি একধরনের চরিত্রগত অভ্যাস। যে মানুষটি অনুপস্থিত কারও সম্পর্কে কটু কথা বলতে দ্বিধাবোধ করে না, তার কাছে সম্পর্ক, বিশ্বাস কিংবা নৈতিকতা খুব স্পষ্ট থাকে না।
আমরা অনেক সময় এটিকে হালকাভাবে নিই। ভাবি, ‘আমার সঙ্গে তো ভালো ব্যবহার করছে’, ‘আমাকে তো বিশ্বাস করে বলছে’— এই ভ্রান্ত আত্মতুষ্টি থেকেই আমরা ভুল করি। কিন্তু বদনাম কখনোই ব্যক্তিগত নয়, এটি পেশাগত। আজ যে ব্যক্তি আপনার কাছে অন্যের দুর্বলতা, ভুল কিংবা গোপন কথা তুলে ধরছে, কাল সে অন্য কারও কাছে আপনার কথাই বলবে। পার্থক্য শুধু শ্রোতা বদলাবে, বিষয়বস্তু নয়।
বদনামের মূল চালিকাশক্তি হিংসা, নিরাপত্তাহীনতা আর আত্মমর্যাদার ঘাটতি। নিজেকে বড় প্রমাণ করার সবচেয়ে সহজ পথ হিসেবে কেউ কেউ অন্যকে ছোট করে দেখাতে চায়। অথচ এতে তার নিজের চরিত্রই উন্মোচিত হয়। একজন পরিণত মানুষ জানেন, অন্যের সম্মান ক্ষুণ্ন করে নিজের মর্যাদা বাড়ানো যায় না।
অফিস, পাড়া, আত্মীয়স্বজন কিংবা বন্ধুমহল সব জায়গাতেই এই প্রবণতা দেখা যায়। কর্মক্ষেত্রে এটি আরও ক্ষতিকর। একজন সহকর্মীর বদনাম করে সাময়িকভাবে কারও দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে তা বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে। কর্তৃপক্ষ কিংবা সহকর্মীরা খুব দ্রুত বুঝে ফেলে— কে কাজের কথা বলে, আর কে মানুষের কথা বলে?
আরেকটি দিকও আছে। বদনাম শুনে আমরা যারা নীরব থাকি, তারাও অনেক সময় সমস্যার অংশ হয়ে যাই। প্রতিবাদ না করে শোনা মানে মৌন সম্মতি দেওয়া। ফলে বদনামের চক্র আরও শক্তিশালী হয় এবং একটি অসৎ অভ্যাস তখন সামাজিক বৈধতা পেয়ে যায়। অথচ খুব সাধারণভাবে বলা যেত, ‘সে এখানে নেই, তার সম্পর্কে বলা ঠিক হবে না’—এই একটি বাক্যই বদনামের পথ রুদ্ধ করতে পারে।
বদনামের সংস্কৃতির কারণে বিশ্বাসের সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ বিশ্বাস গড়ে ওঠে গোপনীয়তা ও সম্মানের ওপর। যে মানুষটি তৃতীয় ব্যক্তির কথা আপনার কাছে ফাঁস করে, সে আসলে আপনাকেও পরিস্কার করে জানিয়ে দেয়, ‘আপনি তার কাছে নিরাপদ নন’। আজ সে অন্যের কথা বলছে, কাল আপনার কথাও বলবে। পার্থক্য শুধু সময়ের।
সমাজে সম্মানিত মানুষদের দিকে তাকালে একটি মিল চোখে পড়ে, তারা অনুপস্থিত মানুষের বিষয়ে সংযত। তারা জানেন, কথারও নৈতিকতা আছে। তারা নিজের অবস্থান বোঝেন, অন্যকে ছোট করে নয়, নিজের কাজ দিয়ে বড় হতে চান।
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত আমাদেরই। আমরা কি বদনামের শ্রোতা হবো, নাকি সম্পর্ক ও মূল্যবোধের পাহারাদার হবো? বদনাম শোনা সহজ, কিন্তু সম্মান রক্ষা করা সাহসের কাজ। যে সমাজে বদনাম কমে, সে সমাজেই বিশ্বাস বাড়ে।যারা বদনাম করে বেড়ান, সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তাদের এড়িয়ে চলুন। আর যে ব্যক্তি বদনাম এড়িয়ে চলে, শেষ পর্যন্ত তিনিই সবচেয়ে মর্যাদাবান থাকেন।
লেখক: অতিরিক্ত পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক