Thursday 25 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজনীতির রক্তময় প্রান্তর: হাদি হত্যা ও গণতন্ত্রের সংকট

রাকিবুল ইসলাম
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৪:৫১

একটি দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বোঝা যায় কেবল অপরাধের পরিসংখ্যান দেখে নয়। বোঝা যায় তখন, যখন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটে এবং সেই ঘটনার পর রাষ্ট্র কীভাবে পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করে, কীভাবে তদন্ত করে, এবং কীভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে—সেই বিচার বিশ্লেষণ করে।

গত ১২ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক মানচিত্রে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, যা অনেকে বলছেন পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাসে এক কঠিন মোড় হয়ে থেকে যাবে। ঢাকা শহরের বিজয়নগর এলাকায় তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদি জনসমক্ষে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি সরাসরি রাজনৈতিক অঙ্গনে সক্রিয়, আন্দোলনে নেতৃত্বদানের মতো অবস্থানে ছিলেন এবং তাই তার ওপর এমন ধরণের হামলা যে রাষ্ট্রের জন্য এক সংকেত হতে পারে—এটি অস্বীকার করা যায় না। তাকে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয় এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। কিন্তু চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৮ ডিসেম্বর রাতে হাদির মৃত্যু হয়।এই মৃত্যু শুধু এক ব্যক্তির বিদায় নয়; এটি বাংলাদেশের মানবাধিকার, রাজনৈতিক নিরাপত্তা এবং রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব সম্পর্কে এক জোরালো প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

ওসমান হাদি ছিলেন এমন একজন ব্যক্তিত্ব, যিনি ২০২৪ সালের ছাত্র‑জনতা আন্দোলনের সময় সংগঠক, প্রচারক ও বক্তার ভূমিকা পালন করেছেন এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির মাধ্যমে তরুণ সমাজের মধ্যে মিশেছিলেন। তার উপস্থিতি অনেকের কাছে আশা, অনেকের কাছে উত্তেজনা— যেখানে একদিকে তরুণদের আশা ছিল, অন্যদিকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠিত শক্তির কাছে তিনি চ্যালেঞ্জের মতো ছিলেন। সেই অবস্থানেই তার মৃত্যু আমাদের সামনে যে প্রশ্নগুলো দাঁড় করিয়েছে, তা কোনোভাবেই লুকিয়ে রাখার নয়।

ঘটনা ঘটে মাত্রই রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য শহরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। হাদির মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে নানা মহলে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। সাধারণ মানুষ প্রাথমিকভাবে শোক প্রকাশ করলেও শোকের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় প্রতিবাদ, মিছিল, সড়ক বন্ধ করে বিক্ষোভ। ঢাকার বিভিন্ন সড়ক, কলেজ‑বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ, জেলা শহরের মানুষজন একে একে রাস্তায় নামেন। তারা সেই প্রার্থনার মূহুর্তেও বলতে থাকেন।

অগ্নিসংযোগ,ভাঙচুর ও ক্ষুব্ধ আচরণ এসবকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করে, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ ও স্থানে নিরাপত্তা জোরদার করে এবং পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা ফিরানোর চেষ্টা করে।

প্রশাসনিক ব্যবস্থায় এই প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক মনে হলেও সাধারণ মানুষের মনে একই ধরণের আত্মবিশ্বাস তৈরি হয় না। তারা প্রশ্ন করে—যদি একজন রাজনৈতিক কর্মী প্রকাশ্য রাজনীতিতে সক্রিয় অবস্থাতেই নিরাপদ না থাকে, তাহলে সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কি কোথাও আছে?

হাদির মৃত্যুর পরও বিচার ও তদন্তকেন্দ্রিক প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসে।হাদিকে রাজধানীর জনবহুল স্থানে গুলি করে হামলাকারীরা পালিয়ে গেল পুলিশ প্রশাসন কিছু করতে পারলনা। অতীতের বিচারহীনতার অভিজ্ঞতা নিয়েই মানুষের মনে সন্দেহ জমে আছে। দেশের ইতিহাসে বহু আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মামলা‑তদন্ত দীর্ঘসময় ধরে ঝুলে থাকে, কেউ কখনো রায় পায়নি, কেউ আবার সঠিকভাবে বিচারের মুখোমুখি হয়নি—এসবের গুঞ্জন আজও শ্রুতিমধুর হয়ে প্রচারিত হয়। কখনো‑কখনো এই দীর্ঘসূত্রতা ও অনিশ্চয়তার সংস্কৃতি বিচার ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই অনেকেই বলছেন হাদির হত্যাকরীরা যদি আইনের আওতায় না আসে যদি স্বচ্ছ ও দ্রুত বিচার না হয়, তাহলে রাষ্ট্রের ওপর মানুষের আস্থা আরও কমে যাবে।

এ ঘটনার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। হাদি যেমন একজন রাজনৈতিক কর্মী, তেমনই তিনি সামাজিকভাবে একটি তরুণ শক্তির প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছিলেন। রাজনীতিতে সহিংসতা নতুন নয়, কিন্তু সমসাময়িক সময়ে এর ধরন বদলেছে। আগের দিনে সাধারণত সংঘর্ষ ছিল রাজনৈতিক গ্রুপগুলোর মধ্যে, কিন্তু এখন ব্যক্তিকেন্দ্রিক হামলার ঘটনাও বেড়ে যাচ্ছে। রাজনীতিকে আরও অনিরাপদ করে তুলছে এই ধরনের ঘটনা। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি চিহ্নিত করা এবং আগেভাগে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিরাপদ না হলে সেটা শুধু রাজনৈতিক সম্প্রদায়ের সমস্যা নয় এটা গোটা সমাজের জন্য উদ্বেগের কারণ।

হাদির মৃত্যু শুধু মানবিক দিক থেকে নয়, মানবাধিকার দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীর উদ্বেগের বিষয়। নাগরিকের জীবন রক্ষা করা রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব। সংবিধান ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ অনুযায়ী, প্রত্যেক নাগরিকের জীবনের প্রতি রাষ্ট্রের অগ্রাধিকার থাকা উচিত। কিন্তু যখন একজন রাজনীতিবিদ প্রকাশ্য গুলিবিদ্ধ হন, তখন সে শুধু নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর আক্রমণই নয়—তাতে সমাজের বিশাল এক অংশ নিরাপত্তাহীনতার বোধ অনুভব করে। মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করে রাজনীতি করা কি নিরাপদ? নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কি রক্ষা পাচ্ছে? রাজনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ কি নিরাপদ ও সম্মানজনক হচ্ছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সমাজের নানা স্তরেই ভীতির আবহ তৈরি হয়।

হাদির মৃত্যুর পর প্রবল প্রতিবাদ শুধু রাস্তা বন্ধ সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সহিংসতা এবং সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলো লক্ষ্য করে আক্রমণের মতো ঘটনা পর্যন্ত এগিয়ে যায়।

ঢাকায় কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অফিস ভাঙচুর ও আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়—এমন ঘটনা আমরা খুব কম সময়ই দেখেছি। সাধারণভাবে গণমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দেয়া হয়, সেটাকেই লক্ষ্য করে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল।সেখানে কর্মরত সাংবাদিক ও কর্মীরা ধোঁয়া ও আগুনের মধ্যে আটকা পড়েন— এসব দৃশ্য পরিবেশে এক ধরণের রাজনৈতিক ও সামাজিক ভয় তৈরি করে।

সহিংসতার রূপ নেয় শুধু ভবনগুলোতে নয়। রাজধানীর ধানমণ্ডি ৩২ এলাকা এবং দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ওপরও হামলার ঘটনা নজরেও পড়ে—যেমন ছায়ানট ও উদীচি মতো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জায়গাগুলো কিছু অংশে বিপথগামী লোকজনের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। এটা শুধু ধ্বংস নয়, বরং গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার ওপর সরাসরি আক্রমণ—যা গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র মানুষের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্র, এবং এসব প্রতিষ্ঠান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলে সেটিও একটি বৃহৎ সংকটের ইঙ্গিত।

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু শুধু বাহিনী মোতায়েন করলেই হয় না; আইনের শাসন নিশ্চিত করা সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আইনের শাসন বলতে আমরা বুঝি—আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হবে, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্তভাবে তদন্ত হবে এবং অপরাধীকে বিচারের আওতায় আনা হবে। হাদি হত্যার মতো ঘটনা যদি রাজনৈতিক প্রভাবের মুখোমুখি হয়ে পড়ে, তবে আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে রাষ্ট্রকে প্রমাণ করতে হবে—এই হত্যাকাণ্ডের বিচার অন্যান্য ঘটনার মতো নয়, বরং এটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের করণীয় স্পষ্ট। ওসমান হাদির হত্যার সাথে জড়িতদের দ্রুত সময়ে গ্রুেফতার করে বিচার দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষভাবে করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষ দেখতে পায় যে ন্যায়বিচার বাস্তবিকভাবে কাজ করছে। সহিংসতা প্রতিরোধ করতে গিয়ে মানবাধিকার রক্ষা করাও অপরিহার্য, কারণ সহিংসতার নামে যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হয়, তাহলে সেটি সমাজের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ডেকে আনবে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথও খোলা রাখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব, যাতে মতভেদের জায়গা রক্ষা পায় এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে ক্ষুন্ন হয়।

ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড কেবল এক জনের জীবনচ্ছেদ নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরের উপর একটি শক্তিশালী আঘাত, যা প্রতিটি নাগরিককে ভাবিয়ে তুলেছে—আমাদের নিরাপত্তা, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বিচারব্যবস্থা কতটুকু প্রতিরক্ষিত। রাষ্ট্র যদি এই হত্যাকাণ্ডকে স্বাভাবিক ঘটনা বা অপ্রতিরোধ্য সহিংসতা হিসেবে মেনে নেয়, তাহলে শুধু হাদির নয়, পুরো সমাজের আস্থা ক্ষুণ্ণ হবে। কিন্তু যদি রাষ্ট্র এই ঘটনায় দ্রুত, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার নিশ্চিত করতে পারে, তাহলে তা হবে এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা—একটি প্রমাণ যে, আইন এবং ন্যায়বিচার রাজনীতির চাপে বিকৃত নয়, মানুষের পাশে দাঁড়াতে সক্ষম।

এই হত্যাকাণ্ড আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, গণতন্ত্র কেবল ভোটকেন্দ্রিক নয়; গণতন্ত্র হলো নিরাপদ মতপ্রকাশ, শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ, এবং জীবনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। হাদির মৃত্যুতে রাষ্ট্রের দায়িত্ব বেড়ে গেছে—নিরাপত্তাহীনতার কালো ছায়াকে দূর করতে হবে, বিচারব্যবস্থায় বিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে, এবং সহিংসতার মুখে জনগণের স্বাধীনতা রক্ষা করতে হবে।

সাম্প্রতিক এই ঘটনা আমাদের জানান দেয়— যেখানে ন্যায়বিচার দেরি করে বা অনিচ্ছুক হয়, সেখানে গণতন্ত্র ক্ষয়প্রাপ্ত হয়, ভয়-ভীতি সমাজকে ঘিরে ধরে, এবং স্বাধীনতার অগ্নিকুণ্ড নিভে যায়। হাদির হত্যাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায়, রাষ্ট্র যদি কার্যকর ও দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তাহলে শুধু একজন হত্যাকৃতির ন্যায়বিচার হবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য এটি একটি সতর্কবার্তা এবং এক নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে।

আজ আমরা ইতিহাসের চোখে দাঁড়িয়ে আছি একটি মুহূর্ত, যেখানে যদি ন্যায়বিচার ঠিকমতো প্রতিষ্ঠিত না হয়, তবে সমাজের আস্থা চিরকাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু যদি আইনশৃঙ্খলা, মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের মূলনীতিকে শক্তভাবে রক্ষা করা হয়, তবে হাদির মৃত্যু হবে শুধুই শোক নয়; এটি হয়ে উঠবে বাংলাদেশের জন্য নতুন সূচনা, নতুন প্রত্যয়ের প্রতীক।

লেখক: কলামিস্ট

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর