বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক বর্তমানে এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। ৫ আগস্টের পরবর্তী প্রেক্ষাপটে যে রাজনৈতিক রদবদল ঘটেছে, তা কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হয়ে থাকেনি, বরং এটি দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক বড় ধরনের ভূকম্পন তৈরি করেছে। বিগত ১৫ বছর ধরে যে সম্পর্ককে ‘সোনালী অধ্যায়’ হিসেবে প্রচার করা হতো, আজ তার জৌলুস হারিয়ে এক নগ্ন ও তিক্ত কূটনৈতিক লড়াই সামনে চলে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক বক্তব্যে যখন বলা হয় যে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজে তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না, ঠিক তার পরক্ষণেই দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনারকে তলব করা হয়। এই বৈপরীত্যই প্রমাণ করে যে, পর্দার আড়ালে পরিস্থিতি কতটা উত্তেজনাকর এবং ভারত বর্তমান বাংলাদেশের পরিবর্তনকে কতটা অস্বস্তির সাথে গ্রহণ করছে।
ঢাকার অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এবার যে প্রতিক্রিয়া দেখানো হচ্ছে, তা বিগত দেড় দশকের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি দৃঢ় এবং স্পষ্ট। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে জানিয়েছেন যে, ভারতের দেওয়া কোনো ‘নসিহত’ বা ‘প্রেসক্রিপশনের’ প্রয়োজন এখন বাংলাদেশের নেই। বিশেষ করে নির্বাচন নিয়ে ভারতের অযাচিত উপদেশকে তিনি ‘সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। উপদেষ্টার এই বক্তব্যের পেছনে রয়েছে এক গভীর ঐতিহাসিক সত্য—বিগত ১৫ বছর বাংলাদেশে যখন একের পর এক প্রহসনমূলক নির্বাচন হয়েছে, তখন ভারত কেবল নীরবই থাকেনি, বরং সেই বিতর্কিত ক্ষমতাকে বৈধতা দিতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জোরালো ভূমিকা রেখেছে। আজ যখন বাংলাদেশ একটি স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দিকে যাত্রা শুরু করেছে, তখন ভারতের এই হঠাৎ জাগ্রত ‘গণতান্ত্রিক উদ্বেগ’ বাংলাদেশের জনগণের কাছে হাস্যকর ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হচ্ছে।
উত্তেজনার এই আগুনে ঘি ঢালছে ভারতে পলাতক সাবেক স্বৈরাচার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ঢাকার অব্যাহত অনুরোধ সত্ত্বেও ভারত তাকে রাজনৈতিক বক্তব্য প্রদান থেকে বিরত রাখছে না। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার কণ্ঠেও এই অসহায়ত্ব ঝরে পড়েছে যখন তিনি বলেন, ‘ভারত যদি তাকে থামাতে না চায়, আমরা থামাতে পারব না; এটা আমাদের মেনে নিতে হবে।’ তবে এই ‘মেনে নেওয়া’ যে দীর্ঘমেয়াদে দিল্লির জন্য শুভ হবে না, তার ইঙ্গিতও তিনি দিয়ে রেখেছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই বিপ্লবের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছে। একজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে প্রতিবেশী দেশ যখন রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, তখন দুই দেশের মধ্যকার আইনি ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ভারত বারবার দাবি করছে তারা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতিতে অটল, অথচ আওয়ামী লীগের পলাতক নেতাদের ভারতে বসে বাংলাদেশের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করার খবর বারবার সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে।
এই উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীদের উসকানিমূলক বক্তব্য সম্পর্কের ক্ষতকে আরও গভীর করছে। বিশেষ করে আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার হুমকি এবং এর বিপরীতে বাংলাদেশের নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপি-র নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহর বক্তব্যকে ঘিরে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তা দুই দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও উত্তাপ ছড়িয়েছে। তবে সবচেয়ে ভীতিকর এবং অসংবেদনশীল আচরণ দেখা গেছে ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা কর্নেল (অব.) অজয় কে রায়নার পক্ষ থেকে। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে একজন বাংলাদেশি ছাত্রনেতাকে ‘টার্গেট’ করার কথা বলেছেন এবং কোথায় গুলি করতে হবে তার বিবরণ দিয়েছেন, তা কেবল কূটনৈতিক শিষ্টাচারের লঙ্ঘন নয়, বরং সরাসরি উগ্রবাদ ও খুনের উসকানি। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদির ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনার সাথে এই ধরনের হুমকির সম্ভাব্য যোগসূত্র বাংলাদেশের মানুষকে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন করেছে।
বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে ভারতের চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গিও এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে। ভারত ঐতিহাসিকভাবে ১৬ ডিসেম্বরকে কেবল একটি দ্বিপাক্ষিক যুদ্ধের (ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ) বিজয় হিসেবে উপস্থাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বিজয় দিবসের বার্তায় বাংলাদেশের নাম অনুপস্থিত থাকাটা এক ধরনের পদ্ধতিগত অবজ্ঞারই বহিঃপ্রকাশ। এর প্রতিবাদী জবাব হিসেবে হয়তো বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ঢাকার একটি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ সড়কের নাম রেখেছে ‘ফেলানী এভিনিউ’। সীমান্ত হত্যার প্রতীক হয়ে থাকা কিশোরী ফেলানীর স্মৃতিকে এভাবে পুনরুজ্জীবিত করা ভারতের বিএসএফের নৃশংসতার বিরুদ্ধে এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রতিবাদ।
ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী যখন বলেন যে, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলেই সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে, তখন প্রশ্ন জাগে—ভারত কি বর্তমান সরকারকে অস্থিতিশীল করার মাধ্যমে কোনো বিশেষ রাজনৈতিক সুবিধাবাদ খুঁজছে? দিল্লির নীতিনির্ধারকরা কি এখনো বিশ্বাস করেন যে, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের চেয়ে একটি নির্দিষ্ট দলের (আওয়ামী লীগ) সাথে সম্পর্ক গড়াই তাদের জন্য কৌশলগতভাবে লাভজনক? শেখ হাসিনা নিজেই এক সময় বলেছিলেন যে, ভারতকে তিনি যা দিয়েছেন তা তারা আজীবন মনে রাখবে। ট্রানজিট, কানেক্টিভিটি এবং নিরাপত্তা সহযোগিতার নামে ভারত গত দেড় দশকে বাংলাদেশের কাছ থেকে একপাক্ষিক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। এখন সময় এসেছে সেই ভারসাম্যহীন সম্পর্কের আমূল পরিবর্তনের।
পরিশেষে, ঢাকা ও দিল্লির বর্তমান এই পাল্টাপাল্টি তলব, দোষারোপ এবং বিবৃতির যুদ্ধ নির্দেশ করে যে, ফয়সালার রাস্তা খুবই ক্ষীণ যদি না ভারত তার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনে। বাংলাদেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন এবং আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন। দিল্লির শাসকরা যদি মনে করেন যে তারা প্রেসক্রিপশন দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবেন, তবে তারা ভুল করবেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং থেকে শুরু করে সেনাপ্রধান পর্যন্ত সবার মন্তব্যই আজ বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে দেখা হচ্ছে। দুই দেশের সম্পর্ক যদি সত্যিই স্বাভাবিক করতে হয়, তবে ভারতকে ‘দলীয় মিত্রতার’ উর্ধ্বে উঠে ‘রাষ্ট্রীয় বন্ধুত্বের’ দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অন্যথায়, এই উত্তেজনার পারদ কেবল বাড়তেই থাকবে, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার ওপর।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়