Sunday 28 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পোস্ট, মিছিল, আহাজারি তবু নেই বিচার: রাষ্ট্র কি সত্যিই খুঁজছে অপরাধী?

সাদিয়া সুলতানা রিমি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৩২

দুটি সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। সময়ের হিসাবে খুব বেশি নয়, কিন্তু ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কাছে এটি যেন দুই যুগের সমান দীর্ঘ। হাদি ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেমেছে প্রতিবাদের ঢল পোস্ট, ভিডিও, কলাম, মিছিল, সভা। লাখ লাখ কণ্ঠ একসাথে প্রশ্ন তুলেছে: খুনি কোথায়? বিচার কবে? অথচ দৃশ্যমান ফল শূন্য। তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে নেই কোনো স্পষ্টতা, নেই অপরাধী ধরার খবর, নেই বিচার প্রক্রিয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার। এই নীরবতা কেবল হতাশার জন্ম দেয় না; রাষ্ট্রের সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন তোলে।

ধরে নেওয়া যাক রাষ্ট্রীয় ভাষ্যে যা প্রায়ই শোনা যায় খুনি দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ধরা যাক, সে ভারতে। তাহলে কি বিচার থেমে যায়? আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সীমান্তে নজরদারি, তথ্য আদান-প্রদান এসব কি কেবল কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ? নাকি এসব ব্যবস্থা কেবল তখনই সক্রিয় হয়, যখন নিহত ব্যক্তি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ তালিকায় পড়েন? যদি অপরাধী পালিয়েই যায়, তবে তদন্ত কি থেমে থাকে? প্রমাণ সংগ্রহ, নেটওয়ার্ক শনাক্ত, সহায়তাকারীদের খোঁজ এসব কি সমান্তরালভাবে চলতে পারে না? বাস্তবে আমরা দেখি, একের পর এক প্রশ্ন জমে ওঠে, উত্তর আসে না।

বিজ্ঞাপন

এই প্রেক্ষাপটে মগবাজারের ঘটনা যেন আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। দিনমজুর, খেটে খাওয়া এক ভাই ককটেল বিস্ফোরণে প্রাণ হারালেন। কোনো বড় নাম নেই, কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই, কোনো প্রভাবশালী পরিচিতিও নেই। তিনি কি কম নাগরিক ছিলেন? তার জীবনের মূল্য কি কম? তার পরিবারের কান্না কি কম শোনা যায়? রাষ্ট্র কি তার হত্যাকারীদের খুঁজছে? নাকি এখানেও একই পুরোনো গল্প ‘তদন্ত চলছে’ এই বাক্যটি দিয়েই দায় শেষ?

আমরা যেন এক অদ্ভুত বাস্তবতায় বাস করছি, যেখানে অপরাধ ঘটে প্রকাশ্যে, মৃত্যু হয় জনসমক্ষে, অথচ বিচার অদৃশ্য। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বাহিনী আছে, প্রযুক্তি আছে, গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক আছে তবু অপরাধীর নাগাল মেলে না। প্রশ্ন জাগে: সমস্যা কি সক্ষমতার, নাকি সদিচ্ছার? যদি সক্ষমতার ঘাটতি হয়, তবে এত বছরের বিনিয়োগ কোথায় গেল? আর যদি সদিচ্ছার অভাব হয়, তবে রাষ্ট্রের নৈতিক ভিত্তিই বা কোথায় দাঁড়িয়ে?

বিচারহীনতার সংস্কৃতি কোনো একদিনে তৈরি হয়নি। বছরের পর বছর ধরে আমরা দেখেছি কিছু অপরাধ দ্রুত সমাধান হয়, কিছু অপরাধ বছরের পর বছর ঝুলে থাকে। কেন? কারণটা খুব কঠিন নয়: ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা অপরাধীরা প্রায়ই আইনের নাগালের বাইরে থাকে। আর ক্ষমতার বাইরে থাকা ভুক্তভোগীদের জন্য বিচার যেন দীর্ঘ, কণ্টকাকীর্ণ এক পথ। এই বৈষম্যই নাগরিকদের আস্থা ভেঙে দেয়। আইন যখন সবার জন্য সমান থাকে না, তখন রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তৃত্ব ক্ষয়ে যায়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ এটি সময়ের বাস্তবতা। মানুষ এখন রাস্তায় নামার পাশাপাশি অনলাইনে আওয়াজ তোলে। কিন্তু এই আওয়াজ কি কেবল ট্রেন্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে? রাষ্ট্র কি এই কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেয়? নাকি কিছুদিন পর সবকিছু ভুলে যাওয়ার ওপরই ভরসা করে? অভিজ্ঞতা বলে, সময়ের সাথে সাথে আলো কমে, শিরোনাম বদলায়, নতুন ইস্যু আসে আর পুরোনো মামলাগুলো ফাইলের ভেতর ধুলো জমায়।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠে আসে বিচার চেয়ে পাওয়া লাগে কেন আমাদের? একটি সভ্য রাষ্ট্রে বিচার কোনো অনুগ্রহ নয়; এটি নাগরিকের অধিকার। তবু আমাদের বাস্তবতায় বিচার যেন দাবি করে নিতে হয় মিছিল করতে হয়, পোস্ট দিতে হয়, কণ্ঠ ফাটাতে হয়। এই অবস্থাই বলে দেয়, কোথাও একটি মৌলিক বিচ্যুতি ঘটেছে। রাষ্ট্র যদি নিজ দায়িত্বে অপরাধীর খোঁজ করত, যদি স্বচ্ছ তদন্তের তথ্য নিয়মিত জনগণের সামনে আসত, তবে এত প্রশ্ন, এত ক্ষোভ জমত না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে কেবল আশ্বাস নয়, প্রয়োজন দৃশ্যমান অগ্রগতি। অপরাধী ধরা পড়লে তা প্রকাশ করা, তদন্তের ধাপগুলো জানানো, সময়সীমা নির্ধারণ এসবই আস্থার ভিত্তি তৈরি করে। কিন্তু আমরা যা দেখি, তা হলো অস্পষ্টতা। এই অস্পষ্টতা গুজবের জন্ম দেয়, সন্দেহ বাড়ায়, আর শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র ও নাগরিকের দূরত্ব বাড়ে।

হাদি ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড ও মগবাজারের বিস্ফোরণ দুটি ঘটনা আলাদা হলেও প্রশ্ন একটাই: রাষ্ট্র কি সত্যিই অপরাধী খুঁজছে? নাকি কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে অনুসন্ধান কেবল আনুষ্ঠানিকতা? যদি রাষ্ট্র সত্যিই খুঁজত, তবে দুই সপ্তাহ পরও আমরা অন্ধকারে থাকতাম না। অন্তত জানতাম কোথায় অগ্রগতি, কোথায় বাধা, কী হচ্ছে পরবর্তী পদক্ষেপ।

একটি রাষ্ট্রের শক্তি কেবল অস্ত্র বা বাহিনীতে নয়; তার ন্যায়বিচার ব্যবস্থায়। বিচারহীনতা কেবল অপরাধীকেই সাহসী করে না, সাধারণ মানুষকেও ভীত করে তোলে। মানুষ যখন দেখে খুনের বিচার নেই, বিস্ফোরণের দায় কেউ নেয় না তখন সে নিজেকে অসহায় মনে করে। এই অসহায়ত্ব থেকেই জন্ম নেয় অনাস্থা, হতাশা, কখনো চরম প্রতিক্রিয়া।

এই লেখা কোনো ব্যক্তিবিশেষের বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়; এটি একটি সামষ্টিক প্রশ্ন। আমরা জানতে চাই আমাদের রাষ্ট্র কোন পথে হাঁটছে? যেখানে অপরাধের পর নীরবতা স্বাভাবিক হয়ে গেছে? যেখানে বিচার সময়ের কাছে পরাজিত? যদি এই পথ চলতে থাকে, তবে আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে? যেখানে অপরাধীরা জানবে সময়ই তাদের পক্ষে কাজ করবে?

এখনো সময় আছে। রাষ্ট্র চাইলে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। চাইলে দেখাতে পারে হাদি ভাইয়ের হত্যাকাণ্ড হোক বা মগবাজারের বিস্ফোরণ কোনোটিই অবহেলিত হবে না। অপরাধীর পরিচয় বড় বা ছোট নয়; অপরাধই বড়। এই নীতিতে দাঁড়ালেই বিচার চেয়ে পাওয়ার প্রয়োজন পড়বে না। বিচার তখন নাগরিকের অধিকার হিসেবে, স্বাভাবিক প্রক্রিয়াতেই এসে দাঁড়াবে।

প্রশ্নটি তাই শেষ পর্যন্ত থেকেই যায় পোস্ট, মিছিল, আহাজারির পরও যদি বিচার না আসে, তবে রাষ্ট্র কি সত্যিই অপরাধী খুঁজছে? নাকি আমরা কেবল সময়ের অপেক্ষায়, যখন এই ক্ষতগুলোও অন্য সব ভুলে যাওয়া ঘটনার তালিকায় যুক্ত হবে? এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকেই দিতে হবে কথায় নয়, কাজে।

লেখক: শিক্ষার্থী, গণিত বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

আট দলে যোগ দিল এলডিপি ও এনসিপি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:২২

আরো

সম্পর্কিত খবর