Tuesday 30 Dec 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অমর প্রতীক: বেগম খালেদা জিয়ার চিরবিদায়

রাকিবুল ইসলাম
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:২৫ | আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:৩৮

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে গত ২৩ নভেম্বর রাজধানীর বসুন্ধরায় অবস্থিত এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৭ নভেম্বর তার ফুসফুসে সংক্রমণ দেখা দিলে তাকে কেবিন থেকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) স্থানান্তর করা হয়।

‎৮০ বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে একাধিক জটিল ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছিলেন। তার শারীরিক জটিলতার মধ্যে ছিল লিভার ও কিডনি সমস্যা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং সংক্রমণজনিত নানা জটিলতা। দীর্ঘদিনের অসুস্থতা ও বয়সজনিত দুর্বলতা তার চিকিৎসা প্রক্রিয়াকে আরও কঠিন করে তোলে।

‎মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সময় সকাল ৬টায়, রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নেমে আসে গভীর শোক। এক দীর্ঘ, সংগ্রামী ও ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে যে জীবন কেবল ক্ষমতার নয়, বরং প্রতিরোধ, ত্যাগ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অনন্য দলিল হয়ে ইতিহাসে থেকে যাবে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে বহু তারকা জ্বলে উঠেছে, বহু তারাই আবার নিভে গেছে ক্ষমতার কালো ধোঁয়ায়। কেউ ক্ষমতার উষ্ণতা সহ্য করতে পারেনি, কেউ বিকৃত রাজনৈতিক বাস্তবতায় চরিত্রহীন হয়ে গিয়েছিল, কেউ আবার নিজের আগুনেই ভস্মীভূত হয়েছে। কিন্তু এমনও কিছু নেতৃত্ব আছে যারা সময়ের দহনক্ষেত্র পেরিয়ে গিয়ে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছে এক ‘ধারাবাহিক প্রতিরোধের আদর্শ’ হিসেবে। এই ক্ষয়িষ্ণু রাজনৈতিক বাস্তবতায় যদি কারও নাম নেওয়া যায় যে নাম বারবার ফিরে আসে, ফিরে আসতেই বাধ্য হয় তা হলো বেগম খালেদা জিয়া। তিনি শুধু তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নন। শুধু দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রীর পরিচয়ও তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকার ব্যাখ্যা করতে পারে না। খালেদা জিয়া মূলত এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বাংলাদেশের গণতন্ত্রযুদ্ধের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে। যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড, বন্দিত্ব, দলন, চক্রান্ত, আন্দোলন, ক্ষমতা, পতন, প্রতিরোধ সব ধারাই তার জীবনকে স্পর্শ করেছে।আর সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, তিনি শুরু করেছিলেন একদম অন্য প্রান্ত থেকে একজন,সাধারণ নিরহংকারী গৃহবধূ থেকে। একজন গৃহিণী কীভাবে রাষ্ট্রনেতায় পরিণত হন? একজন নারীর কাঁধে কেন একটি রাজনৈতিক দলের ভবিষ্যৎ এসে জমা পড়ে? একজন নেত্রীর ওপর কীভাবে জাতির গণতন্ত্রের দায় আনুষ্ঠানিকভাবে এসে পড়ে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে নাটকীয় রূপান্তরগুলোর একটি ফুটে ওঠে।

১৯৪৫ সালে দিনাজপুরে জন্ম নেওয়া ‘পুতুল’ নামের সেই মেয়েটি জানতেও পারেননি ভবিষ্যৎ তাকে কোন অগ্নিপরীক্ষার দিকে টেনে নিয়ে যাবে। স্কুল-পরিবার, ভাইবোন, বন্ধুত্ব সবই ছিল সাধারণ। কোনো রাজনৈতিক পরিবার নয়, কোনো বংশানুক্রমিক প্রস্তুতি নয় শান্ত একটি জীবনের পথেই হাঁটছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। পরিবার, সন্তান, দায়িত্ব এই ছিল তার দুনিয়া। রাজনীতি তখনো ছিল বহু দূরের এক শব্দ।

কিন্তু ইতিহাসের গতি যে ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর চলে না, তা প্রমাণিত হয় ১৯৭১ সালের মার্চে। ১৯৭১ সালের মার্চ বাঙালির জীবনে বিভীষিকার কালরাত্রি।চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান। ২৫ মার্চের পর মুহূর্তেই পরিস্থিতি বদলে যায়।জিয়া কালুরঘাট বেতার থেকে তার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করলেন।যুদ্ধ শুরু হয় গোটা দেশে। এই যুদ্ধকালেই স্বামীকে সংগ্রামে রেখে ১৬ মে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন খালেদা জিয়া। দুই শিশু সন্তান তারেক রহমান-আরাফাত রহমানকে নিয়ে লঞ্চে করে নারায়ণগঞ্জে আসেন সন্ধ্যায়। সেখান থেকে তার বড় বোন প্রয়াত খুরশীদ জাহান হক ঢাকার খিলগাঁওয়ের বাসায় নিয়ে ওঠেন। এই খবরও গোয়েন্দা তৎপরতায় ছড়িয়ে পড়ে মাত্র ১০ দিনে।

২৬ মে ভগ্নিপতি মোজাম্মেল হক জানতে পারেন, পাক সেনারা খালেদা জিয়ার অবস্থান জেনে ফেলেছে। এরপর থেকে শুরু হলো লুকোচুরি। এই বাসা থেকে ওই বাসা, কেউ-কেউ আবার নিপীড়নের ভয়ে ‘বেগমকে’ জায়গা দিতে অপারগ। দুলাভাই মোজাম্মেল হক ২৮ মে শংকর, সেখান থেকে ৩ জুন অন্যত্র স্থানান্তর করেন খালেদা জিয়া ও তার দুই পুত্র তারেক ও কোকোকে। এরপর অজানা এক ঠিকানা থেকে ভূতত্ব জরিপ অধিদফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর এস কে আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় থাকতে শুরু করেন জিয়াপত্নী। ২ জুলাই ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটকের আগে পর্যন্ত ওই বাড়িতেই ছিলেন বেগম জিয়া।এরপর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের সকালে মুক্তি পাওয়ার আগে পুরাতন সংসদ ভবনের পর ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রাখা হয় বেগম জিয়াকে। এ দৃঢ়তা-ই পরবর্তীতে তাকে রূপান্তরিত করে যেখানে নিপীড়ন ছিল তার প্রথম শিক্ষক, এবং নীরব সহ্যশক্তি ছিল তার প্রথম রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ। ১৯৭৭ সালে তার স্বামী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর খালেদা জিয়া বাংলাদেশের ফার্স্ট লেডি হিসেবে জাতীয়ভাবে পরিচিত হন।

ক্ষমতার বাস্তবতা মানবজীবনে অনেক সময়ই নির্মম। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলেন সেনাবাহিনীর বিপথগামী সদস্যদের হাতে। সেই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি মানুষ, একটি পরিবার, একটি রাজনৈতিক দলকে নয় জাতিকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। তখনও রাজনীতির ময়দান খালেদা জিয়ার অপরিচিত। কিন্তু ইতিহাস সেই শান্ত গৃহবধূকে ঘরেই থাকতে দিল না। দল, নেতাকর্মী, সমর্থক সবাই তাকে ডাকল। একটি দলকে ভেঙে পড়া থেকে বাঁচাতে একটি জাতির নেতৃত্ব শূন্যতা রোধ করতে তাকে সামনে আসতেই হলো। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সদস্যপদ গ্রহণ করলেন।১৯৮৩ সালে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান। ১৯৮৪ সালে দলের সর্বোচ্চ নেতা চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।

একজন নারীর জীবনে এক বছরে এমন পরিবর্তন এটা শুধু নাটকীয় নয়; এটা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার নিরাবরণ সত্য। যে রাজনীতি পুরুষশাসিত, শক্তিশালী, কঠোর সেখানে একজন নারী নেতৃত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রতিরোধের মূর্ত প্রতীক হয়ে। অনেকেই তখন ভেবেছিলেন এটি কিছুদিনের জন্য। বস্তুত, তিনি প্রমাণ করলেন রাজনীতি কখনো বংশে পাওয়া যায় না, সংগ্রামে অর্জিত হয়। ইতিহাস প্রমাণ করেছে বাংলাদেশের গণতন্ত্রযুদ্ধের প্রথম সারিতে পুরুষেরা ছিলেন সংখ্যায় বেশি, কিন্তু নেতৃত্বের তীক্ষ্ণ প্রতিরোধে নারীরাও অগ্রগামী ভূমিকা রেখেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী নাম খালেদা জিয়া। তিনি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে রাজপথে নেমেছেন অবরোধ, ধর্মঘট, লাঠিছোড়া আন্দোলন, নির্বাহী নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সাহসিকতার সঙ্গে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুধু বিএনপি নয় গণতন্ত্র চাওয়া মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন এক দৃঢ় প্রতীক। একজন নারী যখন রাজপথে দাঁড়ান, তখন পথের কাঁটা শুধু রাজনৈতিক নয় সামাজিকও। কিন্তু তিনি দু’টিকেই অতিক্রম করলেন হয়ে উঠলেন আপোষহীন নেত্রী। এভাবেই তিনি রাজনৈতিক ইতিহাসে তৈরি করেন এক নতুন অধ্যায় নারীর রাজনৈতিক আধিপত্যের।

১৯৯০ সালের গণআন্দোলন এরশাদ সরকারকে সরিয়ে দিলে বাংলাদেশ গণতন্ত্রের নতুন দ্বারে দাঁড়ায়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি বিজয়ী হল। দেশ পেলো তার ইতিহাসের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী। এই অর্জন শুধু বাংলাদেশের নয় দক্ষিণ এশীয় নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের এক বিশাল অধ্যায়।তার প্রথম মেয়াদে তিনি যা করলেন তা সাম্প্রতিক ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্থাপন করে। প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক করা, মেয়েদের জন্য উপবৃত্তি ও ফ্রি টিউশন, বৃক্ষরোপণ আন্দোলন, সার্ক-এ নেতৃত্ব, যমুনা সেতুর ভিত্তি— এসবই দেশের পরবর্তী উন্নয়ন ধারার মূল স্থপতির পদে তাকে প্রতিষ্ঠিত করে।

বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের এক অনন্য ও বিরল কৃতিত্ব হলো তিনি অংশগ্রহণ করা প্রতিটি নির্বাচনে জয়ের স্বাদ পেয়েছেন। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তিনি পাঁচটি সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন এবং মোট ২৩টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবকটিতে জয়লাভ করেছেন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এতগুলো ভিন্ন ভিন্ন আসনে একসাথে জয়লাভের নজির আর কোনো নেতার নেই।
‎এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পাঁচ আসনে জয়লাভের হ্যাটট্রিক। আগে নির্বাচনী আইনে একজন প্রার্থী সর্বোচ্চ পাঁচটি আসনে দাঁড়াতে পারতেন। খালেদা জিয়া ১৯৯১, ১৯৯৬ (জুন) এবং ২০০১ সালের নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে প্রতিবারই সবকটিতে বিজয়ী হন। পরবর্তীতে আইন পরিবর্তিত হয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনি সর্বোচ্চ তিনটি আসনে দাঁড়িয়ে তিনটিতেই জয়লাভ করেন।

‎আরেকটি নজরকাড়া দিক হলো দেশের ছয়টি ভিন্ন জেলা থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হওয়া। সাধারণত দেশের শীর্ষ নেতারা তাদের নিজ জেলা বা রাজধানীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেন। কিন্তু খালেদা জিয়া বগুড়া, ফেনী, ঢাকা, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর এবং খুলনা এই ছয়টি ভিন্ন জেলা থেকে সরাসরি মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। উত্তরের নাগরিক থেকে দক্ষিণের, পূর্বের ভোটার থেকে পশ্চিমের মানুষের প্রত্যক্ষ সমর্থন পেয়ে নির্বাচিত হওয়া এই সফলতা তাকে একটি বিরল জনপ্রিয়তার নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

‎এই রেকর্ডগুলো প্রমাণ করে, খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা কেবল একটি এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তিনি দেশের সর্বত্র সমানভাবে সমর্থন পেয়েছেন। তার রাজনৈতিক জীবনের এই অর্জন শুধুমাত্র বিজয় নয়, বরং দেশের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নেতৃত্ব প্রদানের সক্ষমতার প্রতীক।

১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে অনন্য এক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়। যদিও বিএনপি তখন ক্ষমতায় ছিল, বিরোধী দলগুলো—বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জন করায় নির্বাচন কার্যত একতরফা হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সাধারণ জনগণ যেখানে একাধারে বিভ্রান্ত এবং ক্ষুব্ধ, সেখানে খালেদা জিয়া দেখান একটি নেতা কেবল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ওপর নয়, নীতিনিষ্ঠতার ওপর দাঁড়াতে পারে।তিনি সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, গণতন্ত্রের সংরক্ষণ শুধুমাত্র ক্ষমতার মালিকানা নয়—এটি নৈতিক দায়িত্বও বটে। এই সিদ্ধান্ত তাকে রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা এবং নৈতিক নেতৃত্বের এক অনন্য মর্যাদা দেয়।সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযুক্ত করা হয়, যা পরবর্তী দুই দশকে দেশের শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ভিত্তি স্থাপন করে। ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়। খালেদা জিয়া সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর মধ্যে তার নেতৃত্বের কৌশল ছিল দ্বিগুণ—একদিকে তিনি দলের সংগঠন পুনর্গঠন করেন, অন্যদিকে সরকারকে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সংসদীয় প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করেন।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে চার-দলীয় জোট দুই-তৃতীয়াংশ আসন জয়ী হয়। খালেদা জিয়ার তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তার প্রভাবকে সর্বোচ্চে নিয়ে যায়। এই মেয়াদে বাংলাদেশ অভিজ্ঞতা করে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও নিরাপত্তা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। রপ্তানি আয়ের রেকর্ড বৃদ্ধি, প্রবাসী রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি, শিল্পখাতে উন্নয়ন, বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ এই পদক্ষেপ দেশের অর্থনৈতিক শক্তিকে দৃঢ় করে। তদুপরি, ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ এবং র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) গঠন দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে, জেএমবি ও হুজি মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালানো হয়। এই উদ্যোগগুলো প্রমাণ করে, একটি শক্তিশালী নেতৃত্ব কেবল রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য নয়, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দেশের আইনশৃঙ্খলার জন্যও অপরিহার্য।

২০০৬ সালের খালেদা জিয়া ক্ষমতা নিরপেক্ষ সরকারের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন। এটি বাংলাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তরের ইতিহাসে একটি স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল নজির স্থাপন করে। কিন্তু এরপরেই আসে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার নতুন অধ্যায়। ২০০৭–২০০৮ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় খালেদা জিয়া এবং তার পরিবারের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত নিপীড়ন চালানো হয়। ১১ জানুয়ারি ২০০৭-এ খালেদা জিয়াকে বন্দি করে সাব-জেলে পাঠানো হয়। তারেক রহমানকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করা হয়। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো জেল থেকে গুরুতর অসুস্থ হন। এই সময়কাল রাজনৈতিক দমন এবং ব্যক্তিগত ট্রাজেডির এক ভয়াবহ সংমিশ্রণ হিসেবে ইতিহাসে লেখা হয়।

২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন শেখ হাসিনা।পরবর্তী দীর্ঘ সময়জুড়ে ক্ষমতায় থাকা এই সরকারকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে নানা প্রশ্ন ও বিতর্কও তৈরি হয়। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংকুচিত হওয়া, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পরিসর সীমিত হয়ে পড়া, ব্যাংকিং ও অর্থনৈতিক খাতে সুশাসনের ঘাটতি এসব বিষয় নিয়মিত সমালোচনার জন্ম দেয়। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্টি হওয়া অভিযোগ ও প্রশ্ন সরকারবিরোধী আলোচনাকে আরও তীব্র করে তোলে। একই সঙ্গে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তিকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করায়।

সেই সময় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের নতুন অধ্যায় রচনা করতে শুরু করে। একদিকে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও ধারাবাহিক মামলার চাপে দল হিসেবে বিএনপি টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছিল, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধারের দাবিতে খালেদা জিয়া বারবার আহ্বান জানাচ্ছিলেন জাতীয় ঐক্যের। তার রাজনৈতিক অবস্থান, বক্তব্য এবং গণআন্দোলনের ডাক ধীরে ধীরে সরকার–বিরোধী অসন্তোষকে সুসংগঠিত করতে থাকে। দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর ক্রমাগত দমন-পীড়ন, গ্রেপ্তার, নিখোঁজ হওয়া ও আন্দোলন দমনে প্রশাসনের কঠোর ভূমিকাকে তিনি প্রতিনিয়ত তুলে ধরেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং মানুষের মতপ্রকাশের অধিকার—এই চারটি বিষয়কে সামনে রেখে খালেদা জিয়া সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেন।তার ডাকের প্রতিক্রিয়ায় রাস্তায় আন্দোলন আরও ঘন হতে থাকে, রাজনৈতিক উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে রাজধানী থেকে জেলা শহর পর্যন্ত। সমাবেশ নিষেধাজ্ঞা, পুলিশি বাধা, গণগ্রেপ্তার—এসব সত্ত্বেও বিএনপি ও এর মিত্র রাজনৈতিক শক্তিগুলো নাগরিক অধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের প্রশ্নে সক্রিয় থাকে। খালেদা জিয়া নিজেকে সেই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড় করান; কখনো তার বাসভবন অবরুদ্ধ হয়, কখনো তাকে দীর্ঘ সময় গৃহবন্দী অবস্থার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, কিন্তু তার অবস্থানে কোনো নড়চড় দেখা যায়নি। বরং সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ও রাজনৈতিক সংকোচনকে তিনি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকেন।আন্দোলনের সেই সময়টিতে রাজপথের প্রতিটি উত্তেজনা, প্রতিটি সংঘর্ষ, প্রতিটি প্রেস ব্রিফিংয়ে খালেদা জিয়ার অবস্থান ছিল সরকারের বিরুদ্ধে চাপ তৈরি করা এবং জনগণকে রাজনৈতিক অধিকারহীনতার বাস্তবতা বোঝানো। তার নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক পরিসর আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা সরকারের দীর্ঘমেয়াদি একচ্ছত্র শাসনের সমান্তরালে একটি ধারাবাহিক প্রতিরোধের চিত্র গড়ে তোলে।

কিন্তু সবচেয়ে নির্মম, সবচেয়ে হৃদয়ভাঙা অধ্যায় শুরু হয় ২০১৮ সালে। ‘জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা’—যা আন্তর্জাতিক মহলের বহু দায়িত্বশীল পর্যবেক্ষক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলেই মনে করেন—তার রায়ে গ্রেপ্তার হয়ে তিনি যান পুরোনো নাজিমুদ্দিন রোডের পরিত্যক্ত কারাগারের একটি একক সেলে। বয়স, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা—সব মিলিয়ে এটি ছিল এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়ানো। রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, চোখের জটিলতা—ধীরে ধীরে তার শারীরিক অবস্থা ভয়াবহ হয়ে ওঠে। চিকিৎসকরা বারবার সতর্ক করেন—’চলতে না পারার মতো স্থায়ী জটিলতা তৈরি হতে পারে।’ কিন্তু তখন রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে মানবিকতা নয়, রাজনৈতিক চাপই যেন বেশি ছিল।

দল তখন সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছিল। নির্বাচনের আগমুহূর্তে হাজারো নেতাকর্মীর গ্রেপ্তার, মামলা, হামলা— সব মিলিয়ে বিএনপি যেন এক অচেনা অন্ধকারে ঢুকে পড়ে। আর সেই সময় দলের প্রধান নেত্রী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বন্দিত্বের যন্ত্রণা সহ্য করছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতিতে ভারসাম্য ভেঙে যায়; গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা স্থান নেয় দমনচক্রের ভেতর।

অবশেষে ২০২০ সালের মার্চে করোনা প্রেক্ষাপটে ‘দণ্ড স্থগিত’ করে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়—শর্তসাপেক্ষে। তিনি বাড়ির বাইরে যেতে পারবেন না; বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। ফলে মুক্তি পেলেও তৈরি হয় এক নতুন ধরনের রাজনৈতিক বন্দিত্ব।এই পুরো সময় শুধু একজন নেত্রীর ভোগান্তির বর্ণনা নয়— এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ওপর চাপিয়ে দেওয়া রাষ্ট্রীয় দায়িত্বহীনতার এক ভয়াবহ দলিলও।

এরপর ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে তীব্রভাবে বদলে দেয়। পরদিন রাষ্ট্রপতির আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। দীর্ঘ দমন-পীড়ন, কারাবাস, নিপীড়ন— সব পেরিয়ে তিনি আবার ফিরে আসেন রাজনৈতিক ময়দানে সেই দৃঢ়তার সঙ্গেই, যেভাবে তিনি জীবনের প্রতিটি সংকট মোকাবিলা করেছেন।

খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব কখনো ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য ছিল না। তার জন্য দেশের মানুষ, রাজনৈতিক দল এবং গণতন্ত্র এই তিনটি স্তম্ভ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি দেখিয়েছেন, প্রকৃত নেতৃত্বের মাপকাঠি হলো ক্ষমতার ব্যবহার নয়; এটি হলো দায়বদ্ধতা, ত্যাগ এবং অবিচল প্রতিরোধ। কঠিন পরিস্থিতিতে সাহসিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, আপোষহীন মনোভাব এবং জনগণের প্রতি দায়িত্ববোধ এই গুণগুলোই তাকে যুগের প্রতীকী নেত্রীতে পরিণত করেছে।তার রাজনৈতিক জীবন ছিল সংগ্রাম এবং সংকল্পের এক অব্যাহত যাত্রা। ক্ষমতার উষ্ণতা কখনো সহজভাবে তাকে টানেনি, আবার চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও মিথ্যা অভিযোগের মোকাবেলায়ও তিনি হার মানেননি। বন্দিত্বের অন্ধকারে কাটানো সময়ও তাকে ভেঙে ফেলতে পারেনি; বরং তা আরও দৃঢ় এবং নিঃসঙ্গ শক্তির প্রমাণ হয়ে উঠেছে। এই অধ্যায়গুলো প্রমাণ করে যে ব্যক্তিগত বিপদ ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ কখনো প্রকৃত নেতৃত্বকে সীমাবদ্ধ করতে পারে না।

ইতিহাস তাদেরই শ্রদ্ধা জানায় যারা বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা নত করেনি। সেই ইতিহাসে খালেদা জিয়ার নাম আলাদা করে লেখা থাকবে।খালেদা জিয়া শুধুমাত্র একজন রাজনৈতিক নেতা নন; তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জীবন্ত প্রতীক। একজন নারীর নেতৃত্ব, নেত্রীর দৃঢ়তা এবং সংগ্রামের প্রতিফলন এই তিনটি দিকই তার নামকে ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। তার প্রতিরোধের দীপ আজও আমাদেরকে আলোকিত করে, ভবিষ্যতের নেতাদের পথ দেখায় এবং মনে করিয়ে দেয় যে প্রকৃত নেতৃত্ব কখনো ক্ষমতার উপর নির্ভরশীল নয়; এটি হলো দায়বদ্ধতা, নৈতিক শক্তি এবং আত্মত্যাগের পরিচয়।

খালেদা জিয়ার জীবন ও নেতৃত্ব আমাদের শেখায়, রাজনৈতিক অন্ধকারকে হার মানানো যায়, যদি সংকল্প থাকে, নৈতিক দৃঢ়তা থাকে এবং জনগণের প্রতি সত্যিকারের দায়বদ্ধতা থাকে। তার প্রতিরোধ ও ত্যাগ শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, বরং প্রতিটি নতুন প্রজন্মের জন্য দিকনির্দেশক আলোকস্তম্ভ। বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশে তার নাম চিরকাল উজ্জ্বল থাকবে এক অনন্য সাহসের, অবিচল নেতৃত্বের এবং গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এএসজি
বিজ্ঞাপন

নয়াপল্টনে শোকের ছায়া
৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:১১

আরো

সম্পর্কিত খবর