ইংরেজি বছরের শেষ দিনকে ঘিরে উৎসব ও আনন্দের সাথে বিদায় দেওয়ার চল তৈরি হয়েছে এ উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে! একটা সময় ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের চল ছিল না। বিদেশেীদের দেখাদেখি বাংলাদেশসহ এশিয়ার বহু দেশে থার্টি ফাস্ট নাইট রীতিমতো উৎসবে রূপ নিয়েছে! তরুণ জনগোষ্ঠীর হাল ফ্যাশনে বাংলাদেশেও থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপন বর্তমানে একটা রীতিতে দাঁড়িয়ে গেছে! কিন্তু অন্যের বিষাদ বা কষ্টের মাত্রা বাড়িয়ে উৎসব পালন কী কোনো সচেতন মানুষের কাজ হতে পারে? আনন্দ উদযাপন যখন অপরের জীবন ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন সেটা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ রয়েছে। বিগত কয়েক বছরে থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনের চিত্র শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণের কারণ হয়েছে। বিগত বছরের শেষ দিনের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় আতশবাজি, পটকা ও ফানুস পোড়ানোর ফলে দূষণের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। এমনিতেই ঢাকা শহর দূষণের শহর হিসেবে বিশ্বের বিশেষ পরিচিত লাভ করেছে। উপরি পাওনা হিসেবে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনের দূষণ-যোগ নগরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমিকি হয়ে দেখা দিয়েছে। থার্টি ফাস্ট নাইটে শুধু যে ঢাকা শহরে শব্দ ও বায়ুদূষণ হয় তা নয়। বিভাগীয় শহর, জেলা শহর, উপজেলা শহরে এখন থার্টি ফাস্ট নাইট পালিত হয়। গ্রাম পর্যায়েও এর রেশ ছড়িয়ে পড়েছে। বাসাবাড়ির ছাদে ছাদে চলে বারবিকিউ পার্টি। সাউন্ড বক্স বাজিয়ে চলে নাচ-গান।
থার্টি ফাস্ট নাইটে পটকা, বাজি ও ফানুসের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে দূষণের প্রভাব পড়ে প্রকৃতিতে। গাছের ওপর ফানুস পড়ে আগুন লেগে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। বাজি, পটকার আতঙ্কে থাকে পাখিগুলো। পাখিদের গায়ে আগুন লাগার মতো ঝুঁকি তৈরি হয়। শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থ মানুষের জন্য থার্টি ফাস্ট নাইটের শব্দদূষণ রীতিমতো আতঙ্কের নাম। এর আগে ঢাকা শহরে আতশবাজির শব্দে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। অতিরিক্ত শব্দে শ্রবণশক্তি ও স্মরণশক্তি কমে যাওয়া, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে ভোগাসহ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়।
অতি সম্প্রতি ‘বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র’ (ক্যাপস)-এর গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে, থার্টি ফাস্ট নাইটে শব্দের মাত্রা শিল্প এলাকার জন্য নির্ধারিত মাত্রাকেও ছাড়িয়ে যায়। তথ্যে আরও বলা হয়েছে, আতশবাজি ও ফানুস পোড়ানোর সময় বায়ুদূষণ ২০২৩ সালে ৩৬ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ৩৫ শতাংশ বেড়েছিল। অপরদিকে শব্দদূষণ ২০২৩ সালে ১০২ শতাংশ ও ২০২৪ সালে ৪২ শতাংশ বেড়েছিল। ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারি বায়ুমান সূচক সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়। ক্যাপসের সুপারিশে আতশবাজি, পটকা ও ফানুস এড়িয়ে বিকল্প পন্থায় বায়ু ও শব্দদূষণমুক্ত থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপনের সুপারিশ করা হয়েছে। এদিকে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকেও বিজ্ঞপ্তি জারি করে ক্ষতিকর পটকা, ফানুস ওড়ানো ও বাজি ফোটানোর মতো বিষয়কে বিধিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড অ্যাখ্যা দিয়ে এ ধরনের কাজ থেকে সবাইকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬- এর স্পষ্ট লঙ্ঘন। শব্দদূষণ নীতিমালা লঙ্ঘনের পাশাপাশি অন্যান্য পরিবেশ সুরক্ষা আইনেও শব্দদূষণ ও বায়ুদূষণমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে বলে কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
থার্টি ফাস্ট নাইটে বিভিন্ন দেশে শব্দ ও বায়ুদূষণ রোধে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা জারি করা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বিভিন্ন সময় দেখা যায় দীপাবলির রাতে আতশবাজি ও পটকা ফোটানোর কারণে ভয়াবহ দূষণ ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দিয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে থার্টি ফাস্ট নাইটের দূষণের ক্ষয়ক্ষতি পত্রিকার শিরোনাম হয়। দূষণ ছড়ানোর অভিযোগে শাস্তির ঘটনাও ঘটে। প্রাণ-প্রকৃতির স্বার্থে ইংরেজি নববর্ষ উদযাপনে আমাদের সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। থার্টি ফাস্ট নাইটের আনন্দ যেন অপরের জন্য বিরক্তি ও ক্ষতির কারণ না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাজি, পটকা ফোটানো ও ফানুস ওড়ানোর বিকল্প হিসেবে আলোকসজ্জা ও দেশিয় সংস্কৃতির আদলে আনন্দ ভাগাভাগি করাই হবে সবার জন্য মঙ্গলের। কিন্তু আনন্দ যেন অপরের জন্য বিষাদের রূপ না নেয়। বন্যপ্রাণী, পশুপাখির নিরাপত্তার কথা সচেতনতার সাথে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে অসুস্থ রোগী, শিশু ও বৃদ্ধদের কথা। সবার স্বার্থে দূষণমুক্ত থার্টি ফাস্ট নাইট কাম্য। প্রকৃতি-পরিবেশ সর্বোপরি নিজেদের কথা ভেবে আমরা কী দূষণমুক্ত থার্টি ফাস্ট নাইট উদযাপন করতে পারি না?
লেখক: শিক্ষক, জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী, সদস্য, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)