Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ: সোয়াব বনাম রক্ত পরীক্ষা


২৮ এপ্রিল ২০২০ ২১:৩০

করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকেই একজন মানুষের শরীরে ভাইরাসের প্রবেশ ঘটেছে কি না তা শনাক্ত করতে সোয়াবের মাধ্যমে অর্থাৎ নাক-মুখের ভেতরের অংশের পিচ্ছিল তরল নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে। করোনাভাইরাসটি শরীরে ঢোকার সাথে সাথেই সোয়াব টেস্টের মাধ্যমে জানা সম্ভব যে মানুষটি আক্রান্ত হয়েছে কি না! এমনকি রোগলক্ষণ জ্বর, কাশি, হাঁচি, ক্লান্তি, ডায়রিয়া, মাংসপেশী ব্যথা ইত্যাদি শুরু হবার আগেই সেটা জানা সম্ভব। এখন পর্যন্ত সিংহভাগ দেশই এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সম্প্রতি কানাডা অতিদ্রুত, ঘন্টা দুয়েকের ভেতরই, সোয়াব পরীক্ষার পোর্টেবল ডিভাইস চালু করেছে।

বিজ্ঞাপন

ভাইরাসের বিস্তারের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশ এবং বানিজ্যিক কোম্পানিগুলো ‘র‌্যাপিড টেস্টে’র পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে যা কন্ঠের লালাজাতীয় পদার্থে নয়, রক্তে ভাইরাসের উপস্থিতি প্রমাণ করে। এই পদ্ধতিতে দ্রুত করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরীক্ষা করা যায় বলে দাবি করেছেন তারা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৭০টিরও বেশি কোম্পানি তড়িঘড়ি করে র‌্যাপিড টেস্টের কিট প্রস্তুত শুরু করলে মার্কিন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সে ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। তারা অননুমোদিত টেস্টিং কিটের ব্যবহারের ব্যাপারে সতর্কতা জারি করে।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাস শনাক্তকরনে রক্ত পরীক্ষা পদ্ধতি (এন্টিবডি/এন্টিজেন) কতটুকু কার্যকারিতা নিয়ে চিকিৎসকদের মধ্যে আলোচনা চলছে। সবার বোঝার সুবিধার জন্যে সোয়াবের মাধ্যমে এবং রক্ত থেকে করোনা টেস্টের পরীক্ষা কিভাবে করা হয় তা নিয়ে থাকছে কিছু তথ্য-

করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা করতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দ্রুত শনাক্ত করার দরকার হয় যাতে রোগীকে দ্রুত অন্যদের থেকে আলাদা করে চিকিৎসা সুবিধা দেয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তার মাধ্যমে আর কেউ যাতে সংক্রমিত না হন সেই ব্যবস্থা নেয়া যায়।

করোনাভাইরাস এতই ক্ষুদ্র যে, একটি কোষও তার চাইতে বহুগুণে বড়। ভাইরাসটি একটি মাত্র প্রোটিন (আরএনএ) দিয়ে তৈরি। ফলে এটি পরীক্ষার জন্যও অত্যন্ত দক্ষ ও তুলনামূলক শুদ্ধ পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার।

ভাইরাসটি একজন মানুষের নাক-মুখ-গলায় প্রবেশের অনেক পরে রক্তে যায়। ভাইরাসের সংক্রমণের পর শরীরে অ্যান্টিবডি বা যোদ্ধা প্র্রোটিন তৈরি হতে গড়ে দু-এক সপ্তাহ সময় নেয়। বলা বাহুল্য, অ্যান্টিবডি রক্তের একটি উপাদান মাত্র। অ্যান্টিবডি তৈরি হতে কার কতদিন সময় লাগবে এবং কি পরিমানে তৈরি হবে, তা নির্ভর করে রোগীর বয়স এবং শরীরের সামর্থ্যর উপর। কারো কারো কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। ফলে করোনাভাইরাস শরীরে প্রবেশ করার পরপরই রক্তে এন্টিজেন ও অ্যান্টিবডি কোনটাই পাওয়া যায় না।

শরীরে ভাইরাস ঢোকার সাথে সাথেই, গলায় ও নাকের ভেতরে থাকা অবস্থায়ই যদি সেটিকে শনাক্ত করা যায়, তবে রোগীর চিকিৎসা সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শুরু করা সম্ভব হয়। শুরুতেই তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলার মাধ্যমে মারাত্মক ছোঁয়াচে এ দুশমনকে আশপাশের অন্যদের মধ্যে তা ছড়িয়ে দেয়া থেকে রোধ করা যায়।

ভাইরাসটি রক্তে পৌঁছানো পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর যদি কারো পরীক্ষা করা হয়, তবে দেখা যাবে ততদিনে রোগী নানারকম উপসর্গ ভোগ করছে। চিকিৎসাসেবা দিতে দেরি হওয়ায় রোগীর মৃত্যু হতে পারে। ততদিনে তিনি বহু মানুষকে সংক্রমিত করে ফেলতে পারেন।

এ কারনেই সোয়াব টেস্টকে বলা হয় সরাসরি পদ্ধতি আর রক্ত পরীক্ষাকে বলা হয় পরোক্ষ পদ্ধতি। অর্থাৎ ততদিনে অ্যান্টিবডি তৈরির মাধ্যমে ব্যক্তির ‘ইমিউনিটি’ তৈরি হয়ে যায়। আর ইমিউনিটি তৈরি হওয়া ব্যক্তিটি প্রকৃতপক্ষে সীমিত আকারে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য প্রস্তুত থাকে। ইমিউনড মানুষের রক্ত নিয়ে অবশ্য প্লাজমাথেরাপি বা অন্যান্য ভ্যাকসিন সম্পর্কিত গবেষণায় কাজে লাগানোর সম্ভাবনা থাকে।

আরও কথা আছে। যেহেতু অ্যান্টিবডি (IgG, IgM) তৈরি হতে সময় লাগে এবং রোগী ভালো হয়ে যাবার পরও অ্যান্টিবডি রক্তে থেকেই যায়, তাই শুধুমাত্র অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করে কাউকে ‘করোনা রোগী’ সাব্যস্ত করাকে শতভাগ ঠিক বলা যায় না।

আবার করোনাভাইরাস ছাড়াও অন্য কোনো কারণে যেমন সাধারণ জ্বরে শরীরে আগে থেকেই বেশি পরিমানে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রেও রক্তে অ্যান্টিবডির পরিমানের উপর নির্ভর করে করোনা আক্রান্ত নয় এমন কাউকেও ভুলক্রমে করোনা আক্রান্ত বলে নির্বাচন করা হতে পারে।

সোয়াব টেস্ট করা হয় নাক ও গলার ভেতরের দিকে তুলার কাঠি ঢুকিয়ে লালামতো জিনিস এনে পরীক্ষা করে। ওই লালাতে ভাইরাসের প্রেটিনটি থাকে। সোয়াব বা পিসিআর পদ্ধতিতে ভাইরাসের জেনেটিক উপাদানের অংশবিশেষ আলাদা করে সেগুলো অসংখ্যবার কপি করা হয়। তারপর নিশ্চিত করে বলা হয় যে এটি করোনাভাইরাস। স্যাম্পল নেওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। আগে কয়েকদিন সময় লাগলেও এখন দ্রুত করার পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে।

ভাইরাসটি নাক এবং মুখ দিয়ে ঢোকার পর প্রথমে নাকের ভিতরে এবং গলায় বাসা বাঁধে। তারপর ফুসফুসে যায়। এরপর ফুসফুস আক্রান্ত করে। ফুসফুসের ছোট ছোট অক্সিজেন বহনকারী বলগুলো যাদের নাম অ্যালভিওলাই তারা কোষে ঢুকে বিলিয়ন বিলিয়ন নতুন ভাইরাস তৈরি করে ও কোষগুলো নষ্ট করতে থাকে। আমাদের ইমিউন সিস্টেম তখন ভাইরাসটিকে একটি অপরিচিত প্রোটিন বা শত্রু-এন্টিজেন হিসেবে শনাক্ত করে এবং দ্রুত শরীরকে জানান দিতে থাকে যে ‘বাইরের শত্রু’ এসেছে! এই অবস্থায় রোগী কাশবে, তার জ্বর আসবে, হাঁচি দেবে, ডায়রিয়া ইত্যাদি হবে অর্থাৎ শরীর জানবে যে সে আক্রান্ত। একে বলা হয় তাৎক্ষণিক ইমিউন রেসপন্স।  এই সময়কালে কোভিড-১৯ রোগীর চারিদিকে ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

ভাইরাসটি যতক্ষণ পর্যন্ত ফুসফুসে আটকে থাকে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই আক্রমণকে ‘লোকাল ইনফেকশন’ নামে অভিহিত করা হয়। তারপর ধীরে ধীরে ভাইরাসটি অন্যান্য প্রত্যঙ্গে ছড়িয়ে পরে এবং ফুসফুস ছেদ করে রক্তে প্রবেশ করে। তখন তাকে ‘জেনারেল ইনফেকশন’ বা সেপসিস বলে। রোগটি এতদূর গড়িয়ে গেলে রোগীর বাঁচার সম্ভাবনাও কমে আসে।

লোকাল ইনফেকশন থাকা অবস্থায়ই শরীর ইমিউন সিস্টেম অ্যন্টিবডি তৈরিতে মনোযোগ দেয়। কখনো কখনো তা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। রক্তের মাধ্যমে যে পরীক্ষা পদ্ধতি তাতে কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত কি না তা নিশ্চিত হ্ওয়ার জন্য ভাইরাসটি ফুসফুসকে ক্ষতিগ্রস্থ করে রক্ত পর্যন্ত যেতে হবে। ভাইরাসটি রক্তে যাবার পরই এই ধরনের পরীক্ষায় ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসাকেন্দ্রে বা চিকিৎসার জন্য করোনার পরীক্ষায় এই ধরনের অ্যান্টিবডি বা রক্তের মাধ্যমে পরীক্ষাকে সমর্থন দিচ্ছে না। গত ৮ এপ্রিল তারা এক বিবৃতিতে বলে দিয়েছেন যে, তারা এন্টিজেন চিহ্নিত করনের মাধ্যমে র‌্যাপিড টেস্টকে সুপারিশ করে না। তবে গবেষণা বা এই টেস্টের কার্যকারিতা বৃদ্ধি বা মানোন্নয়নের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

লেখক: রেজিস্টার্ড স্বাস্থ্যকর্মী ও টরেন্টো থেকে প্রকাশিত অনলাইন ম্যাগাজিন নতুন দেশের সম্পাদক

অ্যান্টিবডি করোনাভাইরাস করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ কোভিড-১৯

বিজ্ঞাপন

কাজী শুভর ‘মিষ্টি প্রেমের দই'
২১ নভেম্বর ২০২৪ ১৭:৩৮

আরো

সম্পর্কিত খবর