জামিলুর রেজা চৌধুরীর বিদায়: নক্ষত্রের মহাপ্রয়াণ
২৮ এপ্রিল ২০২০ ২১:৪৩ | আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২০ ২৩:০৪
জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের সাফল্য, তাঁর গড়া প্রকল্পের ফর্দ আর প্রকাশিত গ্রন্থের তালিকা প্রকাশ নিয়ে লেখার অভাব হবে না। একজন ছাত্রের মননে যিনি সাড়া দিয়েছেন, যে মহান শিক্ষক মনের বাতি জ্বেলে গেছেন নীরবে, আজ তাঁর প্রয়ানে আমি সেই ব্যক্তি-জামিল স্যারকে তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এটি তাঁকে নিয়ে আমার একটি ব্যক্তিগত আখ্যান।
সেদিন ছিল ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের কোন এক রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুর। প্রখ্যাত জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার, যাঁকে আমরা ভালোবেসে ‘জেআরসি’ স্যার বলে জানি তিনি প্রথম ক্লাস নেবেন আমাদের। আমি তখন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরঃকৌশল অনুষদের চতূর্থ বর্ষের ছাত্র। বিদ্যা আর মনীষার প্রতি আমার একটা প্রবল অনুরক্তি ছিল তখন। জেআরসি স্যার ছিলেন বিদ্যা আর মনীষার কেতন।
‘জেআরসি’র ক্লাস করব’- এ ভাবনায় চমকিত আমি। তিনি ধীর পায়ে ক্লাসে প্রবেশ করলেন। হাতে বই, চক আর মুখে নির্মল আকর্ষণবিস্তৃত হাসি। মিনিট খানেকের ভেতরই স্যারের বুদ্ধির আঁচ এসে লাগলো। তিনি স্ট্রাকচারাল এনালাইসিস এন্ড ডিজাইন-৩ পড়াবেন। বেশ জটিল খটমট একটি বিষয়। মুগ্ধ হবার প্রতীক্ষা ছিল, হলাম বিমোহিত। এমন সহজ, অথচ নিরেট খাঁটি একজন মানুষকে সামনাসামনি দেখিনি আগে। যাঁর বিদ্যায় কোনো ফাটল নেই, বাচনে নেই জড়তা, যাঁর স্মরণশক্তি প্রবাদতূল্য- সেই মহান মানুষটির জ্ঞানের প্রবাহে নিমজ্জিত হতে আকুল হলো চিত্ত। বাকি সেমিস্টারে স্যার ম্যাট্রিক্স ফর্মুলেশন পড়ালেন, মোমেন্ট ডিষ্ট্রিবিউশন মেথড শেখালেন। গোটাগোটা হাতের লেখায় বিশাল ম্যাট্রিক্স গড়তেন। বিষয়টির উপলব্ধি না হওয়া পর্যন্ত স্যার অক্লান্ত চেষ্টায় ব্যখ্যা করে যেতেন। জেআরসি স্যারের সংস্পর্শে এসে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবন যেন সার্থক হলো আমার।
সেই শুরু। জামিল স্যারের সাথে যোগাযোগের জল একদিন সম্পর্কে গড়ায়। যতবার দেশে গিয়েছি, জামিল স্যার সময় দিয়েছেন আমাকে। জানতে চেয়েছেন আমার গবেষণার কথা। পরামর্শ দিয়েছেন; পেশাগত এবং ব্যক্তিগত বিষয়ে। স্যারের সাথে বিভিন্ন সময়ে কথোপকথনে উঠে এসেছে প্রকৌশল বিদ্যার বিশ্বখ্যাত মনীষীদের গল্প। নানা সম্মেলনে তাঁদের সাথে স্যারের আলোচনার আখ্যান।
জামিল স্যারের স্মরণশক্তি ছিল অনির্বচনীয়। কারো পুরো নাম কেবল নয়, তার নামের বানান অব্দি নির্ভুল বলে দিতেন অনায়াসে। হোক সে ব্যক্তি জার্মান কিংবা রুশ। এমনি একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। জামিল স্যার বললেন, “তোমাদের ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস-এর বর্তমান প্রধান কি স্টেভেন ফেনভেস এর কিছু হন?” আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই স্যার ফেনভেসের স্টিল স্ট্রাকচারস-এ অবদানের নিঁখুত আর পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিতে লাগলেন। এখনো কানে বাজে- স্যারের হাস্যোচ্ছল মুখে অবলীলায় বলে যাওয়া স্টিল স্ট্রাকচারসের তত্ত্বের কথা।
স্যারের অসাধারণ গুণাবলীর ভিতর একটির উল্লেখ না করলেই নয়। একটি কথার সূত্র ধরে আরেকটি আপাত অপ্রাসঙ্গিক উপাখ্যানকে একসাথে গেঁথে দেবার অসীম ক্ষমতা ছিল তাঁর। স্টিল স্ট্রাকচারস থেকে জল বিশোধন, অথবা ফেসভেস থেকে স্টুয়াম এবং মরগান।
চিন্তার প্রবাহকে রুখে দেয় কে? বুদ্ধির দ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে, শুরুর প্রসঙ্গটি কিন্তু ভুলে যাননি তিনি। আমাকে বললেন, “কই, দিলে না তো উত্তরটা?” ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের বর্তমান প্রধান, জর্জ ফেনভেস কে জানবার আগ্রহে মেতে ওঠেন স্যার। জানবার, আর তা মনে রাখবার এক অদম্য ক্ষুধা নিয়ে স্রষ্টা পাঠিয়েছিলেন তাঁকে।
এই গুণী মানুষটি গুণের কদর করতে জানতেন। বিশ্বের কে কোথায় কি অর্জন করেছে, কার প্রযুক্তি প্রভাব ফেলেছে মানবকল্যানে, এসব তথ্য উপাত্তের কোন কমতি ছিল না স্যারের কাছে। আমার সাথে দেখা হলেই গল্পের ঝাঁপি খুলে বসতেন।
বাঙালি পরশ্রীকাতর, জামিল স্যারকে জানলে কেউ একথা বলবে না। অন্যের সাফল্যের জন্যে অনেক জায়গা ছিল এই বিশাল মানুষটির হৃদয়ে। তবে একথা বলতেই হয়, স্যারের কাছে বুয়েটের অ্যালামনাইদের সাফল্য একটু বেশিই গুরুত্ব পেত। শিশুসুলভ উচ্ছলতায় হেসে উঠতেন তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠানের নূতন কিংবা পুরাতন অ্যালামনাইদের কথা বলতে গিয়ে। গর্ব নিয়ে বলতেন, “বিজ্ঞানে বাংলাদেশের কেউ না কেউ নোবেলজয়ী হবেই, আগামী দুই দশকের ভেতর।”
আমাদের প্রিয় জেআরসি স্যার তাঁর একটি নিবিড় আক্ষেপের কথা বলতেন আমাকে। বাংলাদেশে বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে সামনে এগোনোর গতিকে শ্লথ মনে হয়েছে তাঁর কাছে। আমরা কেন এশিয়ার বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিছিয়ে? কি করে এগোবে তাঁর প্রাণের বুয়েট আর বাংলাদেশের অন্যান্য বিদ্যাপীঠগুলো? এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যালামনাইদের কি করণীয়? এসব বিষয় নিয়ে সবসময় ভাবতেন তিনি।
আজ জেআরসি স্যারের দেহত্যাগের বিষন্ন প্রহরে দাঁড়িয়ে কেবল তাঁর হাসিমাখা সরল মুখটির ছবি ভেসে উঠছে। তাঁর দ্যুতিময় চাহনি, নির্ভুল ইংরেজি আর সিলেটি টোনে বাংলা বলা, প্রখর স্মরণশক্তি, অনড় অভিমত অথচ অকপট সারল্যেভরা অন্তর- আর কখনো খুঁজে পাবো কি? আর কখনো আমার মুখ দর্শনে কেউ এভাবে উচ্ছসিত হয়ে উঠবে কি? নির্মল চিত্তে কেবল আমার মঙ্গল প্রার্থনায় আর কে এভাবে সুপরামর্শ দেবে? আমি আজ আমার শিক্ষাগত আর পেশাগত জীবনের এক পিতাকে হারিয়েছি। আর দেশ হারিয়েছে একটি বিরল নক্ষত্রকে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক- সিভিল, আর্কিটেকচারাল, এন্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাস এট অস্টিন, যুক্তরাষ্ট্র