লালসালু যুগে যুগে
৩০ এপ্রিল ২০২০ ১৮:৫০
১.
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র ‘লালসালু’ উপন্যাসের কথা মনে আছে? যারা পড়েছেন তাদের মনে থাকার কথা। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী সাহিত্যকর্ম। ১৯৪৮ সালে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের কাহিনী কি ছিল?
সরলভাবে বললে, উপন্যাসে তিনি ১৯৪০ অথবা ৫০ এর দশকের গ্রামীণ সমাজকে তুলে ধরেন। সেই সময়ের গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থা ছিল ধর্মান্ধতায় ভরা। ধর্ম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে কিছু স্বার্থলিপ্সু মানুষ সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। সেই স্বার্থলিপ্সু ধর্মান্ধ চরিত্রগুলো প্রচণ্ড বলশালী। তারা সংখ্যায় কম হলেও তাদের ক্ষমতা বিস্তৃত। ‘লালসালু’ উপন্যাসের জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’কে বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হয়।
একটি বিষয় আমার মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো- বর্তমান সময়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কি ‘লালসালু’র মতো উপন্যাস লিখতে পারতেন? বা এই সময়ে ‘লালসালু’ উপন্যাসের জন্য কি বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হত? এর উত্তরটা আপনাদের জানা। যেটা অজানা সেটা আমি বলছি।
কেন আমি এই সময়ের কথা বলছি? ১৯৪০ বা ৫০ এর দশক থেকে এখন কি ধর্মান্ধতা বেড়েছে?
২০১৯ সালের একটি ঘটনা স্মরণ করি- বিগত বছরের ২০ অক্টোবর ভোলার বোরহানউদ্দিনে বেশ বড় একটা সহিংসতা হয়েছিল। তা নিশ্চয় মনে আছে? ভোলার বোরহানউদ্দিনে বিপ্লব চন্দ্র বৈদ্য শুভ নামের এক ছেলের ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছিল কয়েকজন মুসলিম ছেলে। হ্যাক করে তারা শুভ’র কাছে টাকা দাবি করেছিল। শুভ টাকা দিতে অস্বিকৃতি জানানোয় নানারকম হুমকি দিতে থাকে তারা। হুমকির ভয়ে শুভ থানায় একটা জিডি করে। পরবর্তীতে টাকা না পাওয়ায় তারা শুভ’র ফেসবুক আইডি থেকে ইসলাম ধর্মের নামে বিভিন্ন বাজে কথা ছড়িয়ে দেয়। ঘটনার শুরু সেখান থেকেই।
মুসলিম তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে তারা ভয়ানক তাণ্ডবে মেতে ওঠে এঘটনার পর। থানায় আক্রমণ, পুলিশের উপর অতর্কিত হামলা থেকে শুরু করে হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালানোসহ বেশ বড়সড় ঘটনা ঘটায় সেইসব মুসলিম তাওহিদী জনতা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। তারা নিজেদের লোকের মাথা থেতলিয়ে পুলিশের উপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেই তথ্যও পরে প্রকাশ পায়। চাপে পড়ে পুলিশ শুভ’কে গ্রেফতার করে! এবং জনতার ৬ দফা দাবি মেনে নেয়। ঘটনাটি দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পৌঁছায়। তিনি কুৎসা রটনাকারীদের নিন্দা জানান। এরপর আর সেই ঘটনার কোনো অগ্রগতি হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় কিন্তু কাউকে গ্রেফতার দেখানো হয়নি তা।
সহিংসতার পর স্থানীয় এমপি তোফায়েল আহমেদ নিহতদের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা করে অর্থ সহায়তা দেয়। সেই নিহতরা কারা? তারা হলো মুসলিম তাওহিদী জনতা’র লোকজন। যারা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে নিহত হয়েছিল। যেসব হিন্দুর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয় তাদের কোনো সহযোগিতা করেনি তোফায়েল আহমেদ। এই হলো সংক্ষেপে ভোলার বোরহানউদ্দিনের মূল ঘটনা।
এই ঘটনাটি কেন বললাম? কারণ ২০২০ সালের ১৮ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে জামিয়া রহমানিয়া বেড়তলা মাদ্রাসায় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা জোবায়ের আহমদ আনসারীর জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়। দেশে এখন যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে, তাই সামাজিক দূরত্ব, অন্তরীন থাকার বিষয়টা জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেই অবস্থায় শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খবর পেয়ে লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ, নিঃসন্দেহে ভয়ের জন্ম দেয়।
ঘটনার পর চারিদিকে আতংক ছড়িয়ে যায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসকারীদের ইতিহাস নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে গণমাধ্যমে নিন্দার ঝড় উঠে যায়। সবার একই বক্তব্য, যখন সামাজিক দূরত্বের কথা বলা হচ্ছে, যখন প্রশাসন মানুষকে বাসায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে তখন লক্ষাধিক লোকের জমায়েত নিঃসন্দেহে ভীতির কারণ।
মজার বিষয় হলো, যারা জানাজায় গিয়েছিল তাদের চোখেমুখে কোনো ভয় নেই, কারণ তাদের বিশ্বাস করোনা তাদের আক্রান্ত করবে না। কারণ, তারা মুসলমান, আল্লাহ্ তাদের রক্ষা করবে। এই ধর্মান্ধ জাতিকে শোধরানোর রাস্তা নিশ্চয় আছে। কিন্তু কেন এই ধর্মান্ধ জাতি তৈরি হয়েছে তা নিশ্চয় জানা জরুরি।
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা পণ্ডিত আহমদ শরীফ। তিনি এই জাতির চরিত্র বিশ্লেষণে দারুণ একটি উক্তি দেন। তিনি বলেন, বিশ্বাসের দুর্গে যুক্তি প্রবেশপথ পায় না। তেমনি যুক্তির জগতে বিশ্বাস কখনও গ্রাহ্য হয় না।
এতো অসাধারণ কথা একমাত্র তার পক্ষেই বলা সম্ভব। কারণ, তিনি বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের অন্যতম সেরা প্রতিভাবান ব্যক্তি। যে জাতি বিশ্বাস করছে তাদের করোনা হবেনা কারণ, তাদের আল্লাহ্ রক্ষা করবে। তাদের কাছে প্রশ্ন, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কেন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে? কেন এতো মানুষ মারা গেল? তারাও তো মুসলমান। এর উত্তরে তারা নিশ্চয় অন্ধ বিশ্বাসের খুঁটি আরো শক্ত করে ধরবে।
গত ত্রিশ বছরে মানুষকে মানবিক হওয়ার চেয়ে মুসলমান বানানোর একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে। গত বিশ বছরে গ্রন্থাগার, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ব্যায়ামাগারের চেয়েও ঢের বেশি মসজিদ তৈরি করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, মসজিদ তৈরি কি খারাপ? অবশ্যই নয়। কিন্তু মসজিদ তৈরি করার পাশাপাশি জাতিকে স্বশিক্ষিত এবং শিক্ষিত করা হয় নাই। এটাই বড় এবং ভয়ানক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মসজিদগুলো তৈরি করা হয়েছে সৌদি অর্থায়নে। তারা চেয়েছে লোকজন ধার্মিক হোক। এক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ জড়িত। কিন্তু লোকজন যথাযথ ধার্মিক হওয়ার চেয়ে ধর্মান্ধ জাতিতে পরিণত হয়ে গেছে। যে জাতি সঠিক যুক্তি বোঝে না, শুধু বিশ্বাস করে। এই ধর্মান্ধ জাতি শোনে শুধু ওয়াজীদের কথা। আজকালের ওয়াজীরা না বলে ধর্মের কথা, না বলে সঠিক পথে চলার কথা। তারা শুধু পরনিন্দা ও সমালোচনা, হিন্দি সিনেমায় নায়িকাদের বিভিন্ন ডায়ালগ ও অঙ্গভঙ্গি করা, মিথ্যা তথ্য দেয়া, নারীদের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো এবং মৃত মানুষদের গীবত গাওয়া নিয়ে ব্যস্ত।
খেয়াল করে দেখবেন, গত বিশ বছরে প্রচুর ওয়াজী তৈরি হয়েছে। কারণ এই ওয়াজীরা খুব অল্প পরিশ্রমে লক্ষ লক্ষ টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে যার কোনো হিসাব কাউকে দিতে হচ্ছে না। তারা এই টাকা আয় করছে কীভাবে? মানুষকে বোকা বানিয়ে।
২.
হেফাজতে ইসলামের কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে। এই হেফাজতের সুপারিশে ২০১৭ সালে সরকার হিন্দু এবং প্রগতিশীল লেখক-কবিদের রচনাগুলো বাদ দিয়েছে, এই হেফাজতেরর আমির আহমদ শফী নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেছিল এবং পঞ্চম শ্রেণির বেশি নারীদের পড়াতে নিষেধ করেছিল। এরাই ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় তাণ্ডব ঘটিয়েছিল। সেই তাণ্ডবের ঘটনায় সারা দেশে ৮৩ টি মামলা হয়েছিল, যার মধ্যে ৬২টির তদন্ত থেমে আছে। এখন তারা সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট দল। এইরকম একটা ধর্মান্ধ দল যখন সরকারের আশীর্বাদ পায় যখন ধর্মান্ধতা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়াতে বাধ্য।
মুসলিম তাওহিদী জনতা এবং বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের কথা আমি শুরুতেই বলেছি। এখন বলবো, আল মারকাজুল ইসলামী’র কথা। করোনাভাইরাসে মৃতদেহ সৎকার করছে আল মারকাজুল ইসলামী নামের একটি সংগঠন। নিঃসন্দেহে এটি ভালো কাজ কিন্তু এই সংগঠনের ইতিহাস কি? ১৯৮৮ সালে প্রথম আল মারকাজুল ইসলামী বাংলাদেশ নামে এনজিও প্রতিষ্ঠা করে মুফতি শহিদুল ইসলাম।
এই মুফতি শহিদুল ইসলাম আসলে কে? ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের তথ্যানুযায়ী, নড়াইল-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মুফতি শহিদুল ইসলাম দুবাইতে বসে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদকে সংগঠিত করছে। হরকাতুল জিহাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা ও নতুনভাবে এ সংগঠনকে সংগঠিত করার অভিযোগে মুফতি শহিদুল ইসলাম দেশে আসতে পারছে না।
আর হরকাতুল জিহাদের ভূমিকা কি? হরকাতুল জিহাদ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা, আওয়ামী লীগের সমাবেশে বোমা হামলা, রমনার বটমূলে বোমা হামলাসহ অসংখ্য জায়গায় আক্রমণ করেছিল।
মজার তথ্য হলো, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মারকাজুল ইসলামীকে নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তা জানে না। তারা মারকাজুল ইসলামীকে লিখিত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির সৎকারের কাজে অনুমোদন দেয়।
এই হচ্ছে অবস্থা। এরপরও কি ধর্মান্ধতা থেমে থাকবে?
৩.
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর ৮০৬ টি সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে সারাদেশে ৩১ হাজার ৫০৫ জন ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
মাইগ্রেশন পলিসি বিষয়ক ইনস্টিটিউট ‘ক্যাটো ইনস্টিটিউট’র তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে ২০১৬ সালে। অর্থাৎ ২০১৪ ও ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে ধর্মীয় স্বাধীনতা লোপ পেয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি হয়তো আরো ভয়াবহ।
গত বিশ বছরে বাংলাদেশে যতগুলো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে তার একটি’রও কি বিচার হয়েছে? গত বিশ বছরে বাংলাদেশে যেভাবে ধর্মান্ধ দলগুলোর উত্থান হয়েছে তা কি আগে হয়েছে? হয়নি।
এই সকল তথ্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়, এই দেশে ধর্মান্ধতা আরো বাড়বে। কারণ ধর্মান্ধতা বন্ধ করার কারো সদিচ্ছা নেই। কারণ, ধর্মভিত্তিক কোনো ধরনের আক্রমণের বিচার হয়নি এখন পর্যন্ত। কারণ, ধর্মান্ধ দলগুলো নিজেদের স্বার্থে ভয়ানক ভূমিকা রাখছে যার মদদ দিচ্ছে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ, ধর্মান্ধ দলগুলোর নির্দেশে পাঠ্যবই পরিবর্তিত হয়েছে। কারণ, ওয়াজীদের মিথ্যাচারসহ অসংখ্য ঘটনা।
এইসব দৃশ্যপট জানলে যে কেউই বলবে, লালসালু তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে টিকে থাকার জন্য। মাজার ভিত্তিক ধর্মান্ধতা অনেক বড় পরিসর ধারণ করেছে। লালসালু টিকিয়ে রাখবে ধর্মান্ধ দলগুলো, টিকিয়ে রাখবে ধর্মান্ধ জাতি।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক