ইরফান এবং একটা ভুল টিকেটের গল্প
১ মে ২০২০ ১৭:২২
“তুমি কি কখনো রেসের মাঠে ছুটেছ? রেসে দৌড়ানোর একটা নিয়ম থাকে। একবার যখন রেস শুরু হয় তখন তুমি সামনে থাকো কি পেছনে, তোমাকে দৌড়ে যেতেই হবে, একদম ফিনিশ লাইন পর্যন্ত। তাই হারি কি জিতি, আমার দৌড় আমি শেষ পর্যন্ত দিয়ে যাবো”। -পান সিং তোমার
গল্পটা আমাদের খুব পরিচিত। যে জীবন আমরা টেনে নিয়ে চলছি, যে জীবনের পথটা কখনোই মসৃণ ছিলো না, যে জীবনের বিপুল সম্ভাবনাকে আমরা দৈনন্দিন সব কাজের মধ্যে কবর দিয়েছি, সেই একঘেয়ে ভ্যাদভ্যাদে জীবন পার করতে করতে যখন আমরা দেখি আমাদের মধ্য থেকেই কেউ একজন গিয়ে আমাদের এতদিন ধরে মনের মধ্যে পুষে রাখা স্বপ্নকে ছুঁয়ে ফেলেছেন, তাকে আমাদের খুব কাছের কেউ মনে হয়। যখন দেখি অন্যতম একজন হয়েও তিনি আমাদের অনেকের গল্প বলে চলছেন, তখন আমরা তাকে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলি।
ইরফান আমাদের মতো লোকদের একজন, যাদেরকে ট্রেন ধরার জন্য যুদ্ধ করতে হয়। এক হাতে টিফিন বাটি আর আরেক হাতে ঝোলা নিয়ে টিকেট নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আমরা ঠিক শেষ হুইসেল বাজার কয়েক সেকেন্ড আগে ছুটতে ছুটতে ট্রেনে উঠি।
মধ্যবিত্ত ঘরে বেড়ে ওঠা লোকদের অনেক যন্ত্রণার মধ্যে একটা হলো- পরিবারের সম্মান ধরে রাখার যন্ত্রণা। তারা মনে মনে ভাবে- তারা অতি উচ্চ বংশজাত। সন্তানদের মাথায় পরিবারের নাম আর মান- সম্মান রক্ষার একটা পাহাড় জন্মের পর থেকেই তুলে দেয়া হয়। ছোট বয়স থেকেই সে পাহাড় বইতে বইতে সন্তানরা হয়ে পড়ে প্রচণ্ড লাজুক, নিজের ব্যাপারে সবসময় খুবই উদ্বিগ্ন; সারাক্ষণ ভাবতে থাকে, লোকে কী ভাববে। এইসব উপসর্গ আমাদের ইরফানের মধ্যেও ছিলো।
ঠিক যে সময় ইরফান মনে মনে বিদ্রোহী হয়ে উঠছে, ভাবছে এই পাহাড় আর বয়ে বেড়াবে না, সে নিজের শহর ছেড়ে রাজধানীতে গিয়ে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামা’তে ভর্তি হবে ঠিক সেই সময়ই তার বাবা মারা যান। পরিবারের মান-সম্মান রক্ষার পাশাপাশি কাঁধে এসে পরে পরিবারের সবার অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান রক্ষার ভার।
ইরফানের সামনে দুটো রাস্তা খোলা। হয় স্বার্থপরের মত নিজের স্বপ্নের পথে ছুটতে থাকো, নয়তো পরিবারের গেঁথে দেয়া পথে চলে বাবার দোকানে গিয়ে বসো।
সে দেখতে তথাকথিত নায়কদের মত সুদর্শন নয়। লম্বা ঢ্যাঙ্গা, লাজুক-অপ্রতিভ, অভিনয়ের কোন অভিজ্ঞতা নাই, আবার এমন কেউ নাই যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এমন একটা অবস্থায় দাঁড়িয়ে সবচেয়ে সহজ আর প্রচলিত যেই পথটা থাকে সেটি না ধরে নিজের স্বপ্নের পথে হাঁটার জন্য মনস্থির করতে ইরফানকে ঠিক কতো রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে, কত চোখের জল ফেলতে হয়েছে, কখনো কখনো নিজেকে স্বার্থপর ভেবে নিজেই নিজের কাছে সে কতটা কুঁকড়ে গেছে, সেই হিসেব কোথাও লেখা নাই। লেখা আছে মধ্যবিত্ত ঘরে বেড়ে উঠেও সমাজের প্রতিষ্ঠিত পথে না গিয়ে নিজের মনমতো জীবনকে গুছিয়ে নিতে চাওয়া প্রতিটি ছেলেমেয়ের চোখের জলে।
দুইশ সাঁইত্রিশ টাকা লাগবে দিল্লীতে গিয়ে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামাতে ভর্তি হতে। মাথার ওপর বাবার ছায়া নেই। উপার্জন নেই। বড় ভাই হয়ে ছোট ভাইয়ের কাছে হাত পাতা যায় না। কিন্তু দিল্লীতে তো যেতেই হবে। তার কাছে ততদিনে মনে হয়েছে জয়পুর শহরটা আর তার নয়। শহরটাকে দেবার মত অথবা শহরটা থেকে নেবার মত আর কিছুই তার অবিশিষ্ট নাই। তাই দ্বিধা, লজ্জা ভেঙে কাছের বন্ধুকে গিয়ে বলেছিল, আমাকে কিছু টাকা দিবি? দিল্লী গিয়ে আমি যেভাবেই পারি তোকে টাকাটা ফিরিয়ে দেব।
এক সাক্ষাৎকারে ইরফান বলেছিলেন, টাকা চাইবার পরে বন্ধু যা বলেছিল সেই কথা তাঁর সারাজীবন মনে থাকবে। কারণ, একেবারে নিরুপায় হয়েই শেষ আশ্রয় হিসেবে বন্ধুর কাছে চেয়েছিলেন টাকাটা। তাঁর বন্ধু বলেছিল, “আরে দোস্ত, আর দুইদিন আগে বলতি তাহলে দিতে পারতাম, এখন তো হাত একদম খালি।”
বন্ধু চাইলে টাকাটা তাকে দিতে পারতো, এটা বুঝতে পেরে ইরফান সংকুচিত হয়ে মাথা নিচু করে ঘরে ফিরে আসেন। ভাইয়ের শুকনো মুখ দেখে তার বোন নিজের টাকা জমানোর বাক্সটা বের করে, গুণে গুণে ভাইকে টাকা দেয়। দুইশ সাইত্রিশ টাকা। প্রতিদিন একটু কম খেয়ে, রিকশায় না চড়ে, লোকাল বাসে চেপে- ঘামের জলে ভিজে, টুক টুক করে জমানো দুইশ সাইত্রিশ টাকা।
সেই টাকা নিয়ে ইরফান রাজধানীতে। সবসময় নিজেকে নিয়ে সংকুচিত ছেলেটা বড় শহরে গিয়ে আরও জড়োসড়ো হয়ে যায়। নিজের জড়তা ঢাকে গাম্ভীর্য দিয়ে। আর সারাদিন ডুবে থাকে বইয়ের পাতায়। বন্ধু সুতপার বাসায় দাওয়াতে গেলে সবাই যখন হই-হুল্লোড়ে মাতে সেখানে নিজেকে বেমানান মনে হয় তার, গিয়ে আশ্রয় নেয় সুতপাদের ঘরের লাইব্রেরিতে। বন্ধুরা যখন হই-হুল্লোড় করছে, তখন সে বই পড়ছে। কেউ কেউ তাকে অহংকারী ভাবে, কেউ ভাবে কী অমিশুক ছেলেটা। কিন্তু ইরফান ভাবে অন্যকিছু, সে জানে বই-ই তার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভার সঙ্গী।
একদিন তাদের ড্রামা স্কুলে এক বিশাল ফিল্মের গ্রুপ আসে। বিখ্যাত এক ফিল্ম ডিরেক্টর তার দলবল নিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্য থেকে চলচ্চিত্রের একটা অন্যতম চরিত্রের জন্য ইরফানকে বাছাই করেন। এতদিন পর জয়পুর থেকে আসা সেই অনুল্লেখযোগ্য ছেলেটার দিকে সবাই চমকে তাকায়। সে নিজেও আয়নায় দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবে, এইবার সে সত্যি সত্যি ফিল্ম করবে! এটাও তাহলে সম্ভব?
দুইমাস শুটিং পার্টির সাথে ওয়ার্কশপে অংশ নেয়, নিজের পার্টের রিহার্সাল দেয়। দিনরাত কত রকমে, কত ভঙ্গীতে নিজের ডায়ালগ বলে ছেলেটা। এই আনন্দের কোন সীমা নাই। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার মাত্র দুইদিন আগে তাকে বলা হয়, যে চরিত্রের জন্য তাকে ভাবা হয়েছিল সেই চরিত্রের চেয়ে তার উচ্চতা বেশি। তাই তাকে নেয়া হবে না। আর সব কাস্টিং হয়ে গেছে। তাকে দেয়ার মত শুধু একটা ছোট চরিত্র আছে। চিঠি লেখকের চরিত্র।
ইরফান হতভম্ব হয়ে পড়ে। কালকে কী করে সে এই হতভাগ্য চেহারা নিয়ে ক্লাসের সহপাঠীদের সামনে যাবে, তারা নিশ্চয়ই তাকে নিয়ে খুব হাসবে; এইসব ভেবে সে সারারাত কাঁদে। যেই ছেলেটিকে ক্লাসে কেউ পাত্তা দিতো না, যে নিজের মতো করে ক্লাসে একটি কোণ বেছে নিয়ে স্বচ্ছন্দে ছিল, তাকে হঠাৎ করে সবার সামনে এনে মঞ্চের আলোর নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়ে, আবার হুট করেই তাকে সোজা মঞ্চ থেকে বলা নেই কওয়া নেই নামিয়ে দিয়ে গেল বোম্বে থেকে আসা শুটিংয়ের লোকেরা। ছেলেটার এতদিনের স্বাচ্ছন্দ্য একাকীত্বও ছিনিয়ে নিয়ে তাকে একদম খোলা একটা মাঠে সহপাঠীদের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল!
বরং ভালোই হয়েছে। একদিন বিখ্যাত হবার পর ছেলেটা বলেছিল, সেই যে সেদিন আমাকে হুট করে না করে দেয়া হলো, যদিও তখন অনেক কেঁদেছি। পরে ভেবেছি, এটাই ভালো হয়েছে। আমি শুরুতেই শিখে গিয়েছি খুব বেশি আশা না করতে। আমি জেনে গিয়েছি সব কিছু প্ল্যান মতো হয় না।
হ্যাঁ, কোন কিছুই আমাদের প্ল্যান মতো হয় না। সেই ঘটনার পর আরও প্রায় বিশ বছর তিনি অনবরত যুদ্ধ করে গিয়েছেন পায়ের নিচে শক্ত মাটির জন্যে। সিরিয়ালের নানান চরিত্রে অভিনয় করতেন, কারণ জীবনে চলতে গেলে টাকার দরকার। কিন্তু মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে নাটকের পরিচালককে বলতেন, আমার চরিত্রটাকে মেরে ফেলো। আমার আর এই একঘেয়ে নাটক করতে ভালো লাগছে না।
এরপর তিনি পেরেছিলেন। অনেক সাধারণ মানুষদের মধ্য থেকেও অসাধারণ হয়ে উঠতে। আবার অসাধারণ হয়েও সাধারণের গল্পই খুব দৈনন্দিন ভঙ্গীতে বলে গেছেন তিনি।
যেই ছেলেটি একসময় মানুষের মাঝে গিয়ে সংকুচিত হয়ে থাকতো সেই ছেলেটিকে নিয়ে হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা টম হ্যাংকস একদিন মজা করে বলেছিলেন, আমি ইরফানকে পছন্দ করি না, কারণ আমি জানি যখন ইরফান আর আমি একই স্থানে থাকি তখন সেখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় মানুষের চেয়ারটা আর আমার দখলে থাকে না।
অনেক বছর সাধনার পর মনে হচ্ছিলো এবার যেন সবকিছুই প্ল্যানমতো চলছে। কিন্তু সেই যে একা ট্রেনে উঠেছেন, টিকিট কাটার সময় তাড়াহুড়ায় হয়তো খেয়াল করেননি। তাকে আসলে হেঁয়ালি করে আরও অনেক আগের স্টেশনের টিকেট ধরিয়ে দিয়েছেন টিকেটকর্তা। ট্রেনে উঠে সবেমাত্র জুতো খুলে, মুখ হাত ধুয়ে, বিছানা বিছিয়ে টিফিন বাটিটা হাতে নিয়ে বসেছেন কিছু মুখে দেবেন বলে, তখনই টিকেট চেকার এসে বললো; নেমে যাও, তোমার স্টেশন এসে গেছে।
ক্যান্সারে আক্রান্ত হবার পরে নিজের অবস্থাটা প্রায় এভাবেই বর্ণনা করেছেন ইরফান। লিখেছেন- সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। হঠাৎ টিকেট চেকার এসে জোর করে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে। আমি বারবার বলছি এটা আমার স্টেশন না। কিন্তু লোকটা কিছুতেই মানছে না।
যে তাকে হুট করে ট্রেন থেকে নামিয়ে দিতে চাইছে তার সাথে বাকবিতণ্ডায় খুব একটা সুবিধা করে উঠতে পারছেন না ইরফান, তাই শেষে হতাশ হয়ে লিখেছেন, আমাদের জীবনটা আসলে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা শুধু শুধুই একে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করি।
আসলে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে ঈশ্বরও হেঁয়ালি করে থাকেন। কতদিনের কত যুদ্ধের পরে যখনই মনে হয় সবকিছু ঠিকঠাক চলতে শুরু করেছে তখনই চেপে ধরে বলেন, চলে যেতে হবে! আমরা সবাই এসবকিছু জেনেও দৌড়াতে থাকি, পান সিং এর মতো। যাকে সারেন্ডার করতে বলা হলে সে বলেছিলো, ‘তুমি কি কখনো রেসের মাঠে দৌড়েছো? রেসে দৌড়ানোর একটা নিয়ম থাকে। একবার যখন রেস শুরু হয় তখন তুমি সামনে থাকো কি পেছনে, দৌড়টা তোমাকে দিয়ে যেতেই হবে একদম ফিনিশ লাইন পর্যন্ত। তাই হারি কি জিতি, আমার দৌড় আমি শেষ পর্যন্ত দিয়ে যাবো।’
পান সিং এর চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরষ্কার জেতা ইরফানও শেষ পর্যন্ত, একদম ফিনিশ লাইন পর্যন্ত দৌড়ানোর জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
তবুও মাঝে মাঝে শরীর ভেঙে আসে ক্লান্তিতে। হেঁয়ালি ভরা জীবনের ওপর বড় অভিমান জন্মে। তাই শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে দৌড়াতে প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে গিয়ে ইরফান বলেছেন, ‘আমি সারেন্ডার করছি।’
ইরফানের জীবনের গল্পটা আসলে আমাদের অনেকের। সাধারণ একজন মানুষের অসাধারণ এক জীবনের গল্প, যার জীবনের নিয়ন্ত্রণ কখনোই তার নিজের হাতে ছিল না, তবুও সেখান থেকেই তিনি তার স্বপ্নকে কিছুসময়ের জন্য ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিলেন।
লেখক: গবেষক, রিলিজিয়াস স্টাডিজ