Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিচারহীনতার সংস্কৃতি ধর্ষকের জন্ম দিচ্ছে


৬ মে ২০২০ ১৩:৩৪

করোনাভাইরাস আতঙ্কে গোটাবিশ্ব থমকে গেলেও ধর্ষকদের ঘৃণিত মানসিকতা থেমে নেই। আসলে ওদের মৃত্যু ভয় নেই। সবাই এখন সৃষ্টিকর্তাকে বেশি করে জপছে, আর তারা নারীর প্রতি সহিংস হচ্ছে। অমানুষ বলেই তারা এমন দুঃসময়েও পৈশাচিক কাজে নিজেদের লিপ্ত করতে পেরেছে। ব্যবসা- বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, বর্হিঃবাণিজ্য সবকিছু এখন বন্ধ। ওদের অপকর্মের দুয়ার কেবল খোলা।

খুলনা, লক্ষীপুর, পঞ্চগড়, নারায়ণগঞ্জ, বরিশাল সবখানেই ধর্ষিত হচ্ছেন নারী। মানবতা ও আইনের শাসন ভূলুন্ঠিত হচ্ছে সর্বত্র। এদেশে করোনা সংকটে ধর্ষণ এবং গণধর্ষণের চিত্র বড়ই ভয়ংকর। এখানে যে ক’টির বর্ণনা দিচ্ছি সব ঘটনাই গত এক মাসে দেশের কোন না কোন জেলায় ঘটেছে।

বিজ্ঞাপন

খুলনা মহানগরীর খানজাহান আলী থানার যোগীপোলে ৪র্থ শ্রেণির এক মাদরাসা ছাত্রী (১৪) গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় ওই ছাত্রীর মা বাদী হয়ে ০২ মে নগরীর খান জাহান আলী থানায় মামলটি দায়ের করেন। তিন বন্ধু মিলে ওই মাদরাসা ছাত্রীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এর আগে রাজধানী ঢাকার পাশে রূপগঞ্জে তিন বন্ধু কাঞ্চন পৌরসভার অষ্টম শ্রেনীর ছাত্রীকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ উঠেছে। পঞ্চগড়ে ধর্ষণের অভিযোগে সালিসে নির্যাতন, অপমানে এক কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। পঞ্চগড় সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের সোনারবান-বাঁশবাড়ি এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নওগাঁর ধামইরহাটে এক কিশোরীকে (১৬) গণধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে সাত বছর বয়সী এক শিশুকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ পাওয়া গেছে। চাঁদপুরে সদর উপজেলায় নবম শ্রেণির এক ছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সরকার ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণার পরও, এমনকি করোনাভাইরাস আতঙ্কের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষকদের দুঃসাহসেরই প্রমাণ মিলে। মানুষরূপী নরপশুরা সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে কি হায়েনার নখ মেলেছে? শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। ঘৃণিত এই কাজ অপরাধ বিজ্ঞানের কোন সংজ্ঞায় ফেলা যাবে?

এখন প্রশ্ন হলো, করোনা আতঙ্কের এই সময়ে দেশে এতো ধর্ষণ হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? যৌন নির্যাতন বন্ধের আগে মানসিকতা বদলাতে হবে। ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। লোভ-লালসা, নেশা, পর্নোগ্রাফি বন্ধ করতে হবে। পর্নো ওয়েবসাইট গুলো বন্ধ করতে হবে। মানুষকে সঠিক যৌনশিক্ষা দিতে হবে। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণ বাড়ছে। তাই ধর্ষণের ব্যাপারে আইনের কঠোর প্রয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

শুধু ধর্ষণই নয়, দেশে ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ। অপরাধীর সাজা না হলে এরকম অপরাধ বাড়বে। ধর্ষণ শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে, দেখা যাচ্ছে ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া তার অন্যতম প্রধান কারণ। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে।

ধর্ষণের বেশি শিকার হচ্ছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরা। যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাদের ছুঁতে পারে কম। যারা নিম্নবর্গের বাসিন্দা, তারা ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও ভয়ে মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন আদালত করলে তাদের উল্টো বিপত্তি বাড়বে। অন্যায় করে অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গেছে।
যৌন-ব্যভিচার সর্বযুগে, সর্বধর্মমতে নিন্দনীয় নিকৃষ্ট পাপাচার। ধর্ষণের চূড়ান্ত শাস্তির বিধান মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু এ যাবৎ যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হয়েছে এরূপ নজির কমই আছে। হয় চুড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো স্বাক্ষ্যপ্রমাণে প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা নির্বিচারে
পাল্টা হত্যার হুমকি কখনো কখনো হত্যার শিকার ও হয়রানির শিকার হন।

এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়।ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ড ও দিতে হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ড ও দন্ডনীয় হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দণ্ডণীয় হবে।

এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তারা নিজেরাই ঐ আইনের পথে হাঁটেন না। কখনো অর্থের লোভ কখনো বা হুমকি ধামকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার অভিযোগপত্র গঠনের সময় ফাঁক-ফোকর থেকে যায়। তাই রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার লোকজন সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হন।

এসব মামলার ক্ষেত্রে অভিযোগপত্র গঠনের সময় কোন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারিতে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চুড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের স্বাক্ষাৎ নেওয়া যেতে পারে। তাতে করে গোপনে অভিযোগপত্র দাখিলের ফলে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে। সর্বপরি নারীদের জন্য ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধ প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজটিই বেশি জরুরী হয়ে পড়েছে। সে লক্ষ্যে সততা, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে- এমনটাই সকলের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও গবেষক

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর