জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে সচল রাখতে হবে অর্থনীতি
৬ মে ২০২০ ১৭:৫২
করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ মহামারী প্রতিরোধে কার্যত অবরুদ্ধ সারাবিশ্ব। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। মূলত গত দুই মাসের মতো এই অবরূদ্ধ অবস্থা শুষে নিচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতির প্রাণ। পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকটি অতিমন্দার দিকে।
করোনাভাইরাস সংকট চলতি বছর বিশ্বের অর্থনীতিকে ৩ শতাংশ সঙ্কুচিত করে দেবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ড (আইএমএফ)। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে বিশ্বের প্রতিটি দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ। সেই হিসাবে করোনার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে আড়াই লাখ কোটি টাকারও বেশি। আর যদি অর্ধেক ক্ষতিও হয় অর্থাৎ জিডিপির ৫ শতাংশ ক্ষতি হয় তাহলে বাংলাদেশের মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে সোয়া এক লাখ কোটি টাকা।
করোনার ব্যাপ্তিকাল যত বাড়বে ক্ষতির পরিমাণও তত বাড়বে। গত দুই মাস ধরেই শিল্প-বাণিজ্য-বিশ্বায়ন, পরিবেশ দূষণের উদ্যম গতি সবকিছু থমকে দাঁড়িয়েছে করোনার আঘাতে। অথচ করোনা-উত্তর পৃথিবীতে মানুষ কবে আবার ঘর থেকে বেরিয়ে কাজে ফিরবে, তার উত্তর এখনও কেউ জানে না।
ছোট্ট অর্থনীতির আমাদের দেশটি আজ পরিচিত এশিয়ার ‘টাইগার ইকোনমি’ হিসেবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক উন্নয়নের যেকোন সূচকের বিচারে গত দুই দশকে বাংলাদেশের অগ্রগতি হয়েছে অভূতপূর্বভাবে। কিন্তু বাংলাদেশও করোনার আক্রমণের বাইরে নয়। কৃষি উৎপাদন ছাড়া কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের সব খাতের উৎপাদন কার্যক্রম। এই প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করবে আমাদের জনবহুল দেশে।
কোভিড-১৯ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, সারা বিশ্বের অর্থনীতিকেও ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমবে। চাকুরি হারাতে পারে বহু মানুষ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস এন্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম।
আর ২০৩২ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে। তখন বাংলাদেশ হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। ২০৩৩ সালে আমাদের পেছনে থাকবে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ। আগামী ১৫ বছর দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে।
কিন্তু বর্তমানে করোনার মতো মহামারী পাল্টে দিচ্ছে আমাদের অর্থনীতির সব হিসাব-নিকাশ। এই দুর্যোগ কতটা ভোগাবে বাংলাদেশকে সেটাই এখন মূল প্রশ্ন। হিসাব বলছে, ৩শ’ বিলিয়ন ডলার আয়তনের জিডিপিতে আমদানি-রফতানি, রেমিটেন্স মিলিয়ে ১ শত বিলিয়ন সরাসরি জড়িত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে। করোনা ইস্যুতে এরই মধ্যে দেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বড় আকারের ধাক্কা খেয়েছে।
২০১৯ সালের প্রাক্কলিত হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০১৮ সালে এ হার ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। একই সময়ে অতি দারিদ্র্র্য হার ১১ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে নেমেছে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয়-ব্যয়ের জরিপ অনুযায়ী, ২০০০ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা ছিল ৪০ শতাংশ ও ২০১০ সালে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ।
সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী ২০১৬ সালে ২৪ দশমিক ৩ শতাংশের দাঁড়ায় দারিদ্র্যের এই হার। বিগত এক যুগের বেশি সময় ধরে বিশেষ করে দেশরত্ন শেখ হাসিনা সরকারের নানামুখি পদক্ষেপে বদলে গেছে আমাদের এই চিত্র। যেটি আমাদের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের একটি মাইলফলক।
কার্যত বিগত দুই মাস করোনার মহামারী প্রতিরোধে অবরুদ্ধ। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে আমাদের মুলত চ্যালেঞ্জের জায়গাটি এখানে। এই অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যের যোগান দেয়াটা সরকারের জন্য অনেক বড় একটি মুশকিলের কাজ হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেটি আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বড় প্রভাব ফেলছে। তাই এই মুহূর্তে বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে কিভাবে আমাদের অর্থনীতিকে কিছুটা সচল রাখা যায়।
আমাদের পরিকল্পনা কমিশনের তথ্য মতে, দেশের পাঁচ কোটি মানুষ এখন দরিদ্র। করোনার কারণে নতুন করে দেশের আরো অন্তত ২০ থেকে ২৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এদেরকে টিকিয়ে রাখার চ্যালেঞ্জ অত্যন্ত হাসিমুখে নিয়েছেন শেখ হাসিনা। এজন্য নিয়েছেন বেশকিছু উদ্যোগ। যেমন নিয়েছেন দেশের খেটে খাওয়া অসহায় মানুষের জন্য উদ্যোগ, তেমনি নিয়েছেন অর্থনীতির চাকা সচল রাখার উদ্যোগ।
দেশের অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব উত্তরণে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন দেশরত্ন শেখ হাসিনা। এছাড়াও রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক ও কর্মচারীদের বেতন ভাতা পরিশোধ করার জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। মোট আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের পরিমাণ হচ্ছে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ। দেশবাসীর যাতে কষ্ট লাঘব হয় এবং তারা ব্যবসা-বাণিজ্য যথাযথভাবে চালিয়ে যেতে পারেন সে জন্যই সরকারের এসব প্যাকেজ।
কিন্তু এসবের বাস্তবায়নেও বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই মহামারী। কেননা এটি করতে গেলে যে দুশ্চিন্তা সামনে এসে দাঁড়ায় সেটি হচ্ছে জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা। সেজন্য সরকার জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আংশিকভাবে কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে, যা একটি ভালো উদ্যোগ বলা যায়। আমাদের এখন তাকানো উচিত সারাদেশের দিকে। দেশ কী চাচ্ছে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।
এটা বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক শক্তিশালী। আর করোনাকালীন দেশকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা প্রশংসিত হয়েছেন। ফোর্বসের একটি সমীক্ষায় তা উঠে এসেছে। আমাদের অর্থনীতির হিসেব অনুযায়ী হয়তো আরো অনেকদিন মানুষকে বসিয়ে খাওয়ানো যাবে। সেটি কোন সমাধানও নয়। কিন্তু তাতে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতির প্রাণ লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।
সেবা খাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। লক্ষ লক্ষ মানুষ চাকরি হারাবে। তখন সেই পবিবারগুলোর করুণ পরিণতি করোনার পরিণতির চেয়ে কোন অংশে কম হবে না বরং এভাবে চলতে থাকলে করোনার চেয়ে এটাই বড় ট্রাজেডি হয়ে দেখা দেবে।
আমাদের এখন যাদের মাস গেলে বেতনের নিশ্চয়তা আছে কিংবা যারা দুই-চার-ছয় মাস বসে খেতে পারবে, তাদের পাশাপাশি যারা দিন এনে দিন খায় তাদের চাওয়ার সাথে একটা সমন্বয় করতে হবে। বর্তমান করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনে যেতে বাধ্য হওয়া বাংলাদেশে যদি আরো দীর্ঘদিন এই অচলাবস্থা চলতে থাকে তাহলে আবারো বিশাল একটি জনগোষ্ঠী দারিদ্র সীমার নীচে নেমে যাবে। শুধু তাই নয়, অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়বে। এছাড়া চারদিকে বেকারত্ব আর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করছে অর্থনীতিকে।
শুধু ইউরোপ বা আমেরিকার অর্থনীতিই নয়, মন্দার আঘাত লেগেছে সারাবিশ্বেই। বাংলাদেশেও প্রবৃদ্ধি হার ২ শতাংশে নেমে আসার কথা বলেছে বিভিন্ন অর্থনৈতিক সংস্থা। তবে প্রবৃদ্ধির এই অংক গোনার চেয়ে এখন বড় কথা মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা। তাই এই মূহুর্ত থেকে ভাবতে হবে কিভাবে মানুষের জীবন বাঁচিয়ে, মানুষকে নিরাপদ রেখে কিভাবে আমাদের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা করা যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজনৈতিক কর্মী