করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যসেবকরাই তারকা, তারাই হিরো
১০ মে ২০২০ ১৩:০২
একজন ডা. মশিউর রহমানের কথা বলছি। দোবিলা ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, তাড়াশ, সিরাজগঞ্জে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ডা. মশিউর রহমানের নানা বীরউত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। নানার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনে শুনে বড় হয়েছেন। সেজন্যই দেশের প্রতি ভালোবাসার টানে এই করোনাভাইরাস নামক যুদ্ধে সামনে থেকে কাজ করার জন্য নিজের মধ্যেই একটি তাগিদ অনুভব করেন। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না, কিভাবে নিজেকে সম্পৃক্ত করবেন।
অবশেষে সাহস করে মহাপরিচালক বরাবর বদলির জন্য আবেদন করেন। আবেদনপত্রে বলেন, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর জেলায় করোনা রোগীদের সেবাদানের জন্য যে ডাক্তারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছে সেজন্য উক্ত যেকোন একটি জেলায় কাজ করতে আমি ইচ্ছুক। আবেদনে সাড়া দিয়ে দ্রুতই ডা. মশিউরকে নারায়নগঞ্জ বদলি করা হয়। তিনি এখন নারায়নগঞ্জ ৩০০ শয্যা হাসপাতালে করোনা রোগীদের নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
এরকম আরো অনেক ডাক্তারকেই আমরা খুঁজে পাব, যারা নিষ্ঠার সাথে নিরবে নিভৃতে দায়িত্ব পালন করেযাচ্ছেন। ডাক্তার নার্স শুধুমাত্র একটা চাকরি নয়, এটি একটি মহান সেবা। পৃথিবীর সর্বত্রই চিকিৎসকদের মাঠে কাজ করার আগে ওয়ার্ল্ড মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী একটি শপথ করতে হয়, ‘আমি মানবতার সেবায় আমার জীবন উৎসর্গ করলাম। আমার রোগীর স্বাস্থ্য হবে আমার প্রথম বিবেচনা। রোগীর প্রতি দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে কোন অবস্থাতেই বয়স, রোগ বা অক্ষমতা, ধর্মবিশ্বাস, নৃতাত্বিক পরিচয়, লিঙ্গ, জাতীয়তা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, বর্ণ, যৌন দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক অবস্থান বা অন্য কোনো কিছু বিবেচনায় আনবো না।’
বিশ্ব কোভিড-১৯ ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত। এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই এটির। তবুও ডাক্তারসহ স্বাস্থ্য সেবকরা দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। অবশ্যই করোনার বিরুদ্ধে এটা এক রকম যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডাক্তার নার্স ও স্বাস্থ্য বিভাগের সেবকরা।
উন্নত দেশগুলোতেও দেখছি অনেক ডাক্তার, নার্স সেবা দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমাদের দেশেও এক হাজারের উপরে ডাক্তার, নার্সসহ সেবাদানকারী কর্মীরা আক্রান্ত হয়েছেন ইতোমধ্যে এবং দুজন প্রতিভাবান ডাক্তার সিলেট এসএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মঈন উদ্দিন ও আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেল কলেজের হেমোটোলজিষ্ট বিভাগের প্রধান অধ্যাপক কর্নেল (অব) মো. মনিরুজ্জামান করোনা যুদ্ধে জীবন দিয়েছেন।
অনেকেই অভিযোগ করছেন ডাক্তার, নার্সরা সঠিকভাবে রোগীর সেবা দিচ্ছেন না। অভিযোগ থাকবে, সমস্যাও থাকবে। তারপরও কিন্তু ডাক্তাররাই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন। একজন নার্সকে মায়ের ভুমিকা, বোনের ভুমিকা নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে হয়। রোগীর সকল পরিচর্যা তাদের উপর ন্যস্ত থাকে।
চিকিৎসা ব্যবস্থার দিক দিয়ে আমাদের দেশ বেশ কিছু ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলো থেকে হয়তো পিছিয়ে আছে। জনসংখ্যার অনুপাতে পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স নেই। নেই পর্যাপ্ত চিকিৎসা কেন্দ্র। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বধীন সরকার চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্নত মানের হাসপাতাল স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলছে। আমাদের সীমিত সম্পদ নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যসেবায় এনেছেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
চিকিৎসকরা দেবতা নয়, আমাদের মতই মানুষ। আমাদের কারো ভাই, কারো বোন। তাদেরও ভুল ত্রুটি থাকতে পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে তাদেরকে দোষী করা যাবে না। আপনার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান যাই থাকুক না কেন অসুস্থ হলে কিন্তু ডাক্তারের কাছেই যেতে হয়। তাদের কোনো ছুটি নেই। ঈদ, পুজো নেই। হাসপাতালে বসে থাকতে হয় অসুস্থ লোকের সেবা করার জন্য।
পৃথিবীর সর্বত্র বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য ডাক্তাররা ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগী দেখা সীমিত করেছেন। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যত ডাক্তার আক্রান্ত হয়েছেন তার অধিকাংশ হাসপাতাল কিংবা চেম্বারে রোগী দেখে আক্রান্ত হয়েছেন। যারা সরাসরি করোনা রোগীর চিকিৎসা করছেন তাদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। জনগনের অসচেনতায় দিন দিন ডাক্তারগণ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। সেজন্য জনগনের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চালু হয়েছে টেলিমেডিসিন সেবা। সম্প্রীতি বাংলাদেশও ৮৭ জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদেরকে নিয়ে চালু করেছে টেলিমেডিসিন সেবা কার্যক্রম।
করোনাভাইরাসের যেহেতু এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক বা প্রতিরোধক তৈরি হয়নি, সেজন্য সচেতনতাই একমাত্র মুক্তির পথ। বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে দিনরাত জনগণের মধ্যে সচেতনতা, করণীয় এবং প্রতিরোধের উপায় বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিয়ে মানুষের মধ্যে সাহস, শক্তি যোগাচ্ছেন।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান, বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ড. কনক কান্তি বড়ুয়া, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম বড়ুয়া এবং প্রখ্যাত লিভার বিশেষজ্ঞ, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, লেখক, গবেষক অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)সহ আরো অনেক বরেন্য ডাক্তারগণ সচেতনতা তৈরিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
একজন কোভিড-১৯ আক্রান্ত নারী চিকিৎসক ডা. হামিদা মুস্তফা সেঁওতি করোনা পজিটিভ হওয়ার পর তার অনুভূতি প্রকাশ করে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে বলেছেন, এখন যদি মরেও যাই, আমার কোন আফসোস থাকবে না।সবাই বলছে কাউকে বলো না। কেন বলব না? আমি তো কোন দোষ করিনি। আমি আপনাদের সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছি। লকডাউনে যখন আপনারা বাড়িতে বসে সময় কিভাবে কাটাবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন তখন আমি হয়তো কোন কোভিড-১৯ রোগীর পাশে দাঁড়িয়েছি। হ্যাঁ, আমি কোভিড-১৯ পজেটিভ। এতে আমার কোন লজ্জা, ভয় বা আফসোস নেই। বরং আমি গর্বিত কারণ আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে এসেছি। আমি ডাক্তার হিসেবে যে শপথ নিয়েছিলাম তা আমি পালন করে এসেছি।
এমন আরো অনেক উদাহরণ পাব, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যারা দায়িত্বপালন করে যাচ্ছেন। নববর্ষের দিন জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা স্বাস্থ্য সেবকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীগন সম্পদের সীমাবদ্ধতা এবং মৃত্যু ঝুঁকি উপেক্ষা করে একেবারে সামনের কাঁতারে থেকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। আপনাদের পেশাটাই এরকম চ্যালেঞ্জের। এ ক্রান্তিকালে মনোবল হারাবেন না। গোটা দেশবাসী আপনাদের পাশে রয়েছে।
শুরুতে কিছুটা সমন্বয়হীনতার অভাব থাকলেও এখন কিন্তু ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সেবকরাই সামনে লড়াই করে যাচ্ছেন। হ্যাঁ, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পুলিশ, সিভিল প্রশাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিকসহ সকল শ্রেনী পেশার মানুষ অনেক গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করে যাচ্ছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, করোনার বিপক্ষে জিততে হলে সবচেয়ে বড় ভুমিকা পালন করতে হবে ডাক্তার, নার্সসহ স্বাস্থ্য সেবকদের। তারাই তারকা, তারাই সুপার হিরো। আসুন তাদেরকে উৎসাহ দেই, সাহস দেই, সম্মান জানাই।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা