রমজানে হাফেজদের ভূমিকা এবং আমাদের কর্তব্য
১০ মে ২০২০ ১৭:৪৩
গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাস নামক এক অদৃশ্য শত্রুর মোকাবিলা করছে। বৈশ্বিক সংস্থাগুলো এটাকে অর্থনৈতিক মহামারি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও থমকে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনীতি এবং সর্বস্তরের মানুষের মনকে চাঙ্গা রাখার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক পরিকল্পনা এবং প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন।
সারাদেশের অসহায় এক কোটিরও বেশি মানুষের জন্য চালু করেছেন রেশন কার্ড। খেটে খাওয়া মানুষ, দিন মজুর ও অসহায় মানুষের জন্য ৭২ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির জন্য হাতে নিয়েছেন বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা। অর্থনৈতিক মন্দা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য আগামী তিন বছরের জন্য হাতে নিয়েছেন মহাপরিকল্পনা।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের যারা সেবা দিচ্ছেন তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। অর্থাৎ ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিচ্ছেন বিভিন্নভাবে তাদের এই প্রণোদনা দেওয়া হবে। (সূত্র : সারাবাংলা ডটনেট, ০৪ মে, ২০২০)।
সারা দেশের কওমি মাদ্রাসাগুলোতে ৮ কোটি ৩১ লাখ টাকা অনুদান দিয়েছেন। এসব মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী পরিকল্পনা, অসীম সাহসিকতা, আন্তরিকতা, সদিচ্ছা, মানুষের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। এছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে যাদের আয় উপার্জনের পথ নেই তাদের জন্য কিছু আর্থিক সহায়তা নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেমন কিন্ডারগার্ডেন, প্রাইমারি স্কুলসহ অন্যান্য ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আর্থিক প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানিয়েছে। অন্যান্য কর্মহীন শ্রেণী-পেশার মানুষও হয়তোবা প্রধানমন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
তাকিয়ে আছেন রমজান মাসের বিশেষ আকর্ষণ আল্লাহর মেহমান কোরআনের হাফেজগনও। কারণ মহামারী করোনা ঠেকাতে চলতি বছর মসজিদে খতম তারাবী বন্ধ। যদিও ৭ মে দুপুর থেকে মসজিদ উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধের সকল নিয়ম কানুন মেনে চলতে হবে। করোনার ভয়ে তারাবি নামাজে মুসল্লির সমাগম খুব একটা হবে না। ফলে হাফেজদের বেকারই থাকতে হচ্ছে। ফলে কাজ নেই-বেতন নেই।
উপরে বর্ণিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায়ও তারা পড়ছে না। আবার কোরআনের হাফেজ হওয়ায় কারো কাছে লজ্জায় হাত পাততেও পারছে না তারা। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে খেয়ে, না খেয়ে বেঁচে আছেন তারা। এমতাবস্তায় হাফেজদের জন্য একটি বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়ন হলে আলেম সমাজ খুবই উপকৃত হবে।
সবাই জানি, রমজান মাসে হাফেজগণ মসজিদে খতম তারাবি পড়ান এবং খুব সামান্যই বেতন পেয়ে থাকেন। যা আনুমানিক ১০, ২০, ৩০ হাজার টাকা। কোন কোন ক্ষেত্রে আরো কম। সেই টাকা আয় হয় মুসল্লিদের কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে। তারাবি নামাজ শেষে ইমাম সাহেব হাফেজদেরকে সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানান। মুসল্লীরা ১০ টাকা, ২০ টাকা, ৩০ টাকা করে ছোট কাঠের বক্স রাখেন। মাস শেষে ২৭শে রমজান অর্থাৎ লাইলাতুল কদরের রাতে আখেরি মোনাজাতের পর মসজিদ কমিটির সভাপতির মাধ্যমে হাফেজদেরকে বেতন হিসাবে সেই টাকা দিয়ে থাকেন। যদিও ইসলামের বৃষ্টিতে কোরআন খতমের বিনিময়ে টাকা নেওয়ার বিধান নেই। কিন্তু তাদেরও সংসার আছে, পরিবার-পরিজন আছে।
নামাজ শেষে মুসল্লিরা হাফেজদেরকে ধরে কোলাকুলি করেন এবং ভবিষ্যতের জন্য দোয়া কামনা করেন। হাফেজগন মাথায় হাত দিয়ে ভবিষ্যতের জন্য দোয়া করেন এবং ওই সামান্য টাকা নিয়ে খুশিতে বিদায় নেন। কিন্তু এবার সেই সুযোগ নেই। তাহলে ঈদের সময় কি তুলে দিবে তার সন্তান এবং পরিবারের হাতে?
দেখা গেছে, অধিকাংশ হাফেজই অত্যন্ত গরীব পরিবার থেকে উঠে এসেছে। দরিদ্র পিতা-মাতা যখন সন্তানদেরকে সামান্য ভর্তি ও বেতনের টাকা দিয়ে নিজ এলাকার স্কুলে পড়ানোর সামর্থ্য রাখে না, তখনই দূরের কোথাও বিনামূল্যের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেন। ছোট ছোট নিষ্পাপ ফেরেশতা তুল্য শিশুরা মা-বাবার আদর বঞ্চিত হয়ে দূরের মাদ্রাসায় পড়ে থাকে। পবিত্র কুরআন মাজীদে ১১৪টি সুরা ও ৬২৩৬টি আয়াত রয়েছে। হাফেজ হওয়ার এ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ হতে সাধারণত ৩ থেকে ৬ বছর লাগে। কুরআন মুখস্থের সাথে সাথে সঠিক উচ্চারণরীতিও শিখতে হয়। এই কয়েক বছর তারা খুবই মানবেতর জীবন-যাপন করে কাটায়। যেমন, নিম্নমানের খাবার, গাদাগাদি করে থাকা ইত্যাদি।
এভাবে মা-বাবার অজান্তেই কেউ কেউ হয়ে ওঠেন কোরআনের হাফেজ, কেউ হয়ে ওঠেন যুক্তিবাদী মাওলানা। তারপর তারা গ্রামে, শহরে ছড়িয়ে পড়েন কাজের সন্ধানে। তাদের কাজ মানেই মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত হওয়া। অর্থাৎ সামান্য বেতনে ইমাম অথবা মোয়াজ্জিন হওয়া। অনেকে আবার সেই কাজ জোগাড় করতে না পারলে পাড়ায়-মহল্লায় ছোট ছোট ছেলে মেয়েদেরকে বাসায় গিয়ে আরবি এবং ইসলামী শিক্ষা তথা নামাজ-কালাম, দোয়া- দরুদ, আদব-কায়দা ইত্যাদি শেখানোর কাজটি করে থাকেন। সেসব কাজের পারিশ্রমিক আরো করুণ। সাধারণ শিক্ষা কিংবা নাচ ও গানের শিক্ষকের পারিশ্রমিকের চার ভাগের এক ভাগেরও কম।
হাফেজগণ এখন দেশের উন্নয়নে অনেক ভূমিকা রাখছে। গণতান্ত্রিক ধারায় এখন অনেক কোরআনের হাফেজ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার, চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য হয়ে গ্রাম উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। গ্রামের লোকেরা সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য অনেক সময় এসব হাফেজ এবং ইমামদের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। মৃত্যুবার্ষিকী কিংবা অন্য কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কোরআন খতমের আয়োজন করা হয়। সেখানে ডাকা হয় হাফেজদের।
মসজিদভিত্তিক প্রাথমিক শিক্ষায় তাদের ভূমিকা অনেক। সাধারণত তারা খুব মেধাবী হয়। অত্যন্ত অল্প বয়সে পুরো কোরআন শরীফ মুখস্ত করে। আমাদের দেশের হাফেজদের বিদেশেও অনেক সুনাম আছে। আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় বিগত কয়েক বছর যাবৎ বাংলাদেশের ক্ষুদে হাফেজগণ প্রথম স্থান অধিকার করে আসছে। অনেকেই স্কলারশিপ নিয়ে মক্কা, মদিনা, মিসরসহ আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করছে।
প্রতিবছর রমজান মাসে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে ক্ষুদে হাফেজদের কুরআন প্রতিযোগিতা দেখে সবাই মুগ্ধ হন। দৈব চয়নের মাধ্যম কোরআন শরীফের মধ্য থেকে ছোট্ট একটি আয়াত পড়ে থাকেন মডারেটর। নিষ্পাপ ওই ক্ষুদে হাফেজ সেটা শুনেই সুরেলা কন্ঠে তেলাওয়াত শুরু করেন। টিভির সামনে বসে সারা বিশ্বের অগণিত রোজাদার তা শোনেন, দেখেন এবং চোখের পানি ফেলতে ফেলতে দুই হাত তুলে ক্ষুদে হাফেজদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন।
হাফিজ (আরবি) এর বাংলা প্রতিশব্দ রক্ষক। তবে হাফিজ বলতে বুঝানো হয় যার সমস্ত কোরআন ৩০ পাড়া মুখস্থ আছে। ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে, কুরআনে হাফেজদেরকে রাব্বুল আলামিন বিশেষ সম্মানের সহিত দেখছেন এবং দেখবেন। যেমন- তিনি নামাজের নেতৃত্বে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যের চেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পাবেন, তিনি ফেরেশতাদের সাথে আছেন এবং থাকবেন, তাকে কেয়ামতের দিন সম্মানের মুকুট এবং সম্মানের পোশাক প্রদান করা হবে, ইত্যাদি আরো অনেক।
মুসলমান সমাজে হাফেজরা খুবই সম্মানিত। কিন্তু স্থায়ীভাবে কাজ বা চাকরির তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই আল্লাহর মেহমান হিসেবে গণ্য হাফেজদেরকে রমজান উপলক্ষে কিছুটা সম্মান করা উচিত। এমতাবস্থায় পবিত্র ঈদের আগে হাফেজগণ আর্থিক সুবিধা পেলে খুবই উপকৃত এবং কৃতার্থ হবে। খুশিমনে হাফেজগণ যদি দুই হাত তুলে আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে। দূর হবে করোনার তাণ্ডব, দূর হবে সকল বিপদ-আপদ। কল্যাণ হবে দেশের, দেশের মানুষের, জননেত্রী, বিশ্বনেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথা বাংলাদেশের।
লেখক: পরিচালক (আইআইটি) এবং তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়