বাংলাদেশ কবে দেখবে করোনা সংক্রমণের চূড়া?
২৭ মে ২০২০ ০০:৩৫
ভারতের মতো বাংলাদেশে মে মাসের শেষে লকডাউন তুলে নেওয়া হলে জুলাই মাসের মাঝামাঝি কোভিড-১৯ এর রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে। এটি ব্যক্তিগত অভিমত। আলোচনার সুবিধার্থে লেখাটি কয়েক অংশে ভাগ করা হয়েছে।
পূর্বাভাসের মডেল
বিজ্ঞানী, পরিসংখ্যানবিদ, অঙ্কশাস্ত্রবিদ, রোগতত্ত্ববিদরা বিভিন্ন সময়ে পাওয়া মহামারি সংক্রান্ত জ্ঞান (ইপিডেমিওলজিকাল) ও গাণিতিক তথ্যসূত্রের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন আনুমানিক মডেল দাঁড় করিয়েছেন। রোগতত্ত্ববিদ্যায় ভাইরাস সংক্রমণজনিত মহামারির আগাম পরিণতি জানতে ‘কম্পারর্টমেন্টাল মডেলিং’ একটি বহুল ব্যবহৃত এবং কার্যকর পদ্ধতি। এ মডেলে রোগ সংক্রমণের বিভিন্ন স্তরে থাকা জনগোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য বিবেচনায় এনে বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে এটি প্রকাশ করা হয়। এ রকম একটি সহজ মডেলের উদাহরণ হলো, ‘কারম্যাক ম্যাকেনড্রিক মডেল’ বা ‘SIR’ মডেল । কিন্তু যে সকল সংক্রমণে কিছুটা সময় ধরে উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে যেমন চিকেন পক্স, টিবি বা ম্যালেরিয়া সেসব ক্ষেত্রে ‘SEIR’ মডেল বেশি ব্যবহৃত হয়।
রোগতত্ত্ববিদ্যায় ‘সাসসেপ্টিবল’ হলো যারা সংক্রমিত হননি কিন্তু সংক্রমণের ঝুঁকিতে আছেন। যারা ইতিমধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন কিন্তু সুপ্ত অবস্থায় বা ইনকিউবেশন পিরিয়ডে আছেন তাদের বলা হচ্ছে এক্সপোজড। এরা উপসর্গহীন অবস্থায় ২ থেকে ১৪ দিন কখনও ২ থেকে ২৭ দিন পর্যন্ত থাকতে পারেন। যাদের সংক্রমণ ও উপসর্গ রয়েছে তাদের বলা হচ্ছে সংক্রমিত বা ইনফেক্টেড। এই সংক্রমিত উপসর্গযুক্ত রোগীদের মধ্যে যাদের নমুনা পরীক্ষায় ভাইরাস পাওয়া গেছে তাদের আলাদা করে রাখা হয় যাতে তাদের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ায়। এই প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থা হলো আইসোলেশন। সবশেষে এই ইনফেকটেড এবং আইসোলেটেড রোগীদের মধ্যে যারা আরোগ্য লাভ করেছেন মানে পরপর দুই টেস্টে নেগেটিভ হচ্ছেন, তাদের বলা হচ্ছে সুস্থ বা রিকভারড। কখনও কোন মডেলে ‘ডেথ ক্লাস’ বা সংক্রমণে মৃতের সংখ্যাকে একটি দলে অন্তর্ভুক্ত করে মডেলের আকৃতি ও প্রকৃতি দুটোই সমৃদ্ধ করা হয়।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন কোভিড বৈশ্বিক মহামারির একটি পূর্বাভাস মডেল (‘প্রেডিকশন) তৈরি করে। যার ভিত্তি ছিলো ‘SIR মডেল’। এই মডেল অনুসারে বাংলাদেশে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে করোনা বিদায় নেওয়ার কথা বলা হয়েছিলো। যদিও বাংলাদেশের তথ্য-উপাত্ত মোটেই এই মডেলটির প্রত্যাবৃত্তি বিশ্লেষণ (Regression Analysis)- এর শর্তগুলোর কোনটিই পূরণ করেনি। মানুষ আশাব্যঞ্জক গুজব শুনতেও পছন্দ করে, তাই এটা খুব একটা তথ্যনির্ভর না হওয়ার পরও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খুব ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল।
‘সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি অ্যান্ড ডিজাইন’ অবশ্য তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ‘প্রেডিকশন মডেল’ এর মতামতে বলেছিলো-
“এই মডেল এবং ডেটা বিভিন্ন দেশের জটিল, বিকশিত এবং ভিন্ন বাস্তবের সঙ্গে সঠিক নয়। পূর্বাভাস প্রকৃতিগতভাবেই অনিশ্চিত। এসব পূর্বাভাস আমলে নিতে পাঠকদের অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।”
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শেষ কথাটি, যা এ দেশের সংবাদমাধ্যম ভালো করে লক্ষ্য করেছেন বলে মনে হয় না।
“পূর্বাভাসের কিছু তারিখের ওপর ভিত্তি করে অতি আশাবাদী হওয়া ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনতে পারে- কেননা এতে হয়ত আমাদের শৃঙ্খলা ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে যাবে যা ভাইরাস ও সংক্রমণের চিত্র আবার ঘুরিয়ে দিতে পারে।”
কিছুদিন আগে কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকেল বায়োলজি এন্ড ইকোলজির’ নন্দদুলাল বৈরাগীর গবেষণাপত্রে ‘SEIR’ মডেলের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে করোনা মহামারির পূর্বাভাস প্রকাশ করা হয়। তাদের মডেল অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে যে হারে সংক্রমণ হচ্ছে সংক্রমণের ধারা বা গতি অব্যাহত থাকলে, এই মহামারি চূড়ান্তরূপ নেবে আগামী ২৩০তম দিনের কাছাকাছি সময়ে। ওই গবেষণাপত্রটিতে গবেষকরা আরও বলেন, এতে বাংলাদেশের আট শতাংশ মানুষ সংক্রমণের শিকার হবেন।
নন্দদুলাল বৈরাগী তার গবেষণায় যে প্যারামিটারগুলো ব্যবহার করেছেন তা হলো-
- মোট জনসংখ্যা
- রোগ বিস্তারের সক্ষমতা (ট্র্যান্সমিশন ইফিসিয়েন্সি)
- ফিজিওলজিকাল ইফেক্ট
- সংস্পর্শে আসা মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা
- সংক্রমিতদের কতজন সুস্থ হয়েছেন
- সংক্রমিতদের কতজন মারা গেছেন
এই গবেষণা প্রসঙ্গে তারা উল্লেখ করেন, এখানে রোগ বিস্তারের সক্ষমতা শুধুমাত্র কতজন আক্রান্ত, কতজন সংস্পর্শে এসেছেন, সংস্পর্শে আসাদের মধ্যে কতজন সংক্রমণের শিকার হয়েছেন এসবের উপর নির্ভর করে না। বরং সামাজিক দূরত্ব, লকডাউনসহ করোনা প্রতিরোধে গৃহীত অন্যান্য সামাজিক ব্যবস্থাপনার সফল প্রয়োগের উপর অনেকাংশে নির্ভর করে। গবেষকরা আরও বলেন, তাদের করা বাংলাদেশের প্রেডিকশন একেবারে উলটাপালটাও হতে পারে (may drastically change) কারণ এখন পর্যন্ত এখানকার প্রাপ্ত তথ্য খুবই অপর্যাপ্ত।
রোগতত্ত্ববিদ্যার নিরিখে এরকম আরও মডেল হলো ‘SVEIJR’, ‘SEIQR’। এই মডেলগুলোতে ‘ভ্যাক্সিনেটেড’, ‘আইসোলেটেড’, ‘কোয়ারেনটাইনড’ জনগোষ্ঠীর তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। মোটকথা যত বেশি কোভিড-১৯ সংক্রমণের বিভিন্ন স্তরভিত্তিক তথ্য (কম্পার্টমেন্টাল ইনফরমেশন) পাওয়া সম্ভব হবে, এ বিষয়ে তত ভালো প্রেডিকশন সম্ভব হবে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে, করোনা প্রতিরোধে পাবলিক হেলথ ইন্টারভেনশন যেমন টেস্ট, হাত ধোয়া, হাঁচিকাশির শিষ্টাচার, সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাস্ক ব্যবহারের পাশাপাশি সোশ্যাল ইন্টারভেনশন যেমন, জনসমাগমের স্থান জীবাণুমুক্তকরণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্কুল বন্ধ, লকডাউন, গণপরিবহনে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা এই রোগের বিস্তার রোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
কাজেই রোগের বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক এই সকল প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা কোন দেশ কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে তার উপর ‘প্রেডিকশন মডেলের’ ফলাফল নির্ভর করে। ইতিমধ্যে করোনার ‘হাইলি সেনসিটিভ এন্ড স্পেসিফিক র্যাপিড এন্টিবডি টেস্ট কিট’, ওষুধ, ভ্যাক্সিন নিয়ে প্রচুর গবেষণা চলছে। এগুলোর আবিষ্কার এবং ব্যবহার এই ‘প্রেডিকশন মডেলের’ গতিপ্রকৃতি অনেকটাই বদলে দিতে পারে।
কোভিড মহামারির ‘প্রেডিকশন মডেল’ হলো একটা গাণিতিক প্রক্ষেপণ পদ্ধতি। সামাজিক নিয়ম ও সংস্কৃতি মেনে চলা মানুষ অঙ্কের নিয়মে চলতে অভ্যস্ত নন, তারা সেটা পছন্দও করবেন না। কাজেই জনগণ যত বেশি বিধিনিষেধ মানবে প্রেডিকশন তত নির্ভুল হবে। আর একটি কথা না বললেই নয় যে, তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে প্রক্ষেপণ পদ্ধতিটি নির্ধারিত হবে তথ্য-উপাত্ত যেন নির্ভুল ও সার্বজনীন হয় সেটা বিশেষভাবে খেয়াল রাখা। নয়তো ভুল সংখ্যার ওপর করা যে কোনো অনুমান ভুল হতে বাধ্য। রোগতত্ত্ববিদরা প্রায়শই বলে থাকেন ভুল তথ্য পাওয়ার চেয়ে তথ্য না থাকা ভালো।
বাংলাদেশে লকডাউন পরিস্থিতি
গত বছরের ডিসেম্বর থেকে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলেও দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় চলতি বছরের ৮ মার্চ। পরবর্তীতে ১৬ মার্চ ঘোষণা দিয়ে ১৮ই মার্চ হতে একযোগে সারাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ৩১শে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯ মার্চ হতে সকল মেডিকেল কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষাও স্থগিত ঘোষণা করা হয়। ২১ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা থেকে যুক্তরাজ্য, চীন, হংকং, থাইল্যান্ড ছাড়া সবদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৪ মার্চ রাত ১২টা থেকে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। সেই সঙ্গে ২৪ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন, নৌ চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। ২৫ মার্চ হতে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত বিপণিবিতান, মার্কেট, রেস্টুরেন্টসমূহ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে সুপারশপ, মুদিদোকান, কাঁচাবাজারসহ নিত্যপণ্যের দোকানপাট খোলা রাখতে নির্দেশ দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, ২৬ মার্চ হতে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সকল ধরণের অফিস, আদালতের কার্যক্রম ও গণপরিবহন চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ১লা এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত আরেক দফা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হয় এবং ৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেওয়া অফিস আদালতের সাধারণ ছুটি ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এদিকে ১২ ও ১৩ এপ্রিলকেও সাধারণ ছুটির আওতায় এনে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত আরেক দফা সাধারণ ছুটি বাড়ানো হয়। ৬ এপ্রিল থেকে দেশের মসজিদসমূহে ৫ জনের বেশি জামায়াতে না অংশগ্রহণের নির্দেশনা জারি করা হয় এবং জুমার নামাজে অনধিক ১০ জনের অংশগ্রহণের নির্দেশনা দেয় ধর্ম মন্ত্রণালয়। এছাড়া ৬ এপ্রিল আরও ঘোষণা দেওয়া হয়, সুপারশপ ও স্বীকৃত কাঁচাবাজারগুলো ভোর ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চালু রাখা যাবে।
পাড়ামহল্লার মুদি দোকানগুলো খোলা থাকবে ভোর ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। চালু থাকবে শুধুমাত্র ওষুধের দোকান। অন্যদিকে, ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত দেওয়া সাধারণ ছুটি আরও এক দফা বাড়িয়ে ২৫ এপ্রিল বলবৎ করা হয়। এছাড়াও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় হতে সন্ধ্যা ৬টার পর বাসা থেকে বের হওয়া ও এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় চলাচলে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এরপর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি যথাক্রমে ৭ মে পর্যন্ত এবং ৭ মে থেকে ১৬ মে পর্যন্ত আরেক দফা ছুটি বাড়ানো হয়। অন্যদিকে ৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ঘোষণায় বলা হয়, রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সীমিত পরিসরে ব্যবসা-বাণিজ্য চালু রাখার স্বার্থে দোকানপাট খোলা রাখা যাবে, তবে ক্রয়বিক্রয়কালে পারস্পরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন করতে হবে। দোকানপাট ও শপিংমলসমূহ আবশ্যিকভাবে বিকাল ৫টার মধ্যে বন্ধ করতে হবে। ১৬ মে পর্যন্ত সাধারণ ছুটি চলাকালীন জরুরি পরিষেবা যেমন- বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহের কার্যক্রম, টেলিফোন, ইন্টারনেট, ডাকসেবা ও সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত যানবাহন ও কর্মীরা এই ছুটির আওতামুক্ত থাকবেন।
সবশেষে ১৭ তারিখ থেকে ২৮ মে তারিখ পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছ এবং এসময় নিম্নলিখিত শর্তসমূহ মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে-
১. সাধারণ ছুটি বা নিষেধাজ্ঞা চলাকালে জনগণ ও সকল কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে ।
২. জরুরি পরিষেবা, যেমন- বিদ্যুৎ,পানি, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দরসমূহের কার্যক্রম, টেলিফোন, ইন্টারনেট সেবা ও সংশ্লিষ্ট কাজে নিয়োজিত যানবাহনর্মীরা এই ছুটির বাইরে থাকবেন।
৩. নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সময়ে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা যাবে না।
৪. কৃষিপণ্য, সার, কীটনাশক, রাষ্ট্রীয় প্রকল্পের মালামাল, কাঁচাবাজার, খাবার, ওষুধের দোকান হাসপাতাল, জরুরি সেবা এবং এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের ক্ষেত্রে এই ছুটি প্রযোজ্য হবে না।
৫. চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক, কর্মী, ওষুধসহ চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত বহনকারী যানবাহন ও কর্মী এবং গণমাধ্যম ও ক্যাবল টিভি নেটওয়ার্কে নিয়োজিত কর্মীগন নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবেন।
৬. সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অফিসসমুহ প্রয়োজন অনুসারে খোলা রাখবে।
বাংলাদেশ কবে দেখবে করোনা সংক্রমণের চূড়া?
এবার আসি আজকের মূল আলোচনায়- সাধারণ ছুটির পর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে বা লকডাউন কতদিন চলতে পারে? বাংলাদেশ কবে দেখবে করোনা সংক্রমণের চূড়া? ভারতের মতো মে মাসের শেষে লকডাউন তুলে নেওয়া হলে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে?
এখন পর্যন্ত আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো চলতি মাসের (মে মাস) শেষে যদি ভারতের মত বাংলাদেশে লকডাউন তুলে দেওয়া হয় তবে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। গত দুই মাস যাবৎ বিভিন্ন মেয়াদে লকডাউন পালিত হওয়ার কারণে রোগীর সংখ্যার এই ঊর্ধ্বগতি খুব বেশি ভয়াবহ হবে না এমনটাই আশা করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রোগতত্ত্ববীদগন। বিশ্বের অন্যান্য যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর মৃতের সংখ্যা তুলনামূলক কম যা থেকে ধারণা করা যায় দেশটি কোভিড-১৯ রোগের সংক্রমণের ব্যাপকতা এখন পর্যন্ত মোটামুটি সন্তোষজনকভাবে প্রতিরোধ করতে পেরেছে।
কোনোরকম ব্যবস্থাপনা ছাড়া কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ কেমন হতে পারে সে বিষয়ে ধারণা পেতে প্রয়োজন তিনটি ইনকিউবেসন পিরিয়ড অর্থাৎ করোনাভাইরাসের আক্রমণ ঘটার পর থেকে রোগ প্রকাশ পেতে যেই সময় প্রয়োজন যার সময়কাল দেড় মাস। আর তাই মে মাসের ৩০ তারিখ থেকে যদি লকডাউন তুলে নেওয়া হয় তাহলে আগামী জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়েই এই রোগের সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে। ধারণা করা হচ্ছে, যেহেতু মানুষের মধ্যে আক্রান্ত হওয়ার একটি ভীতি কাজ করবে তাই লকডাউন তুলে নেওয়া হলেও সাধারণ জনগণ করোনা প্রতিরোধের সামাজিক বিধিনিষেধগুলো মেনে চলা অব্যাহত রাখবে। ধারণা করাই যায় যে, বেশ কিছুদিন ধরে এই আচরণগুলো মেনে চলার কারণে তারা এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। যেমন মানুষ নিজের নিরাপত্তার কারণেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখবে, মাস্ক ব্যবহার করবে যার ফলে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছালেও চুড়াটি খুব বেশি উঁচু হবে না।
সীমিত আর কঠোর যেভাবেই বলি না কেন, লকডাউনের একটা প্রভাব আমরা পরিষ্কার দেখতে পেরেছি। আমরা যে অবস্থা থেকে শুরু করেছিলাম অর্থাৎ মহামারির শুরুতে আমাদের অবস্থাটা যেমন ছিলো লকডাউনের কারণে আক্রান্তের সংখ্যা, গতি, বিস্তৃতি এবং মৃত্যু সেই তুলনায় অন্যান্য অনেক দেশের চেয়ে তুলনামূলক কম এ কথা বলাই যায়। বেশিরভাগ আক্রান্ত রোগী বাস করেন এমন লোকালয় যেমন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি অঞ্চলে নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে সঙ্গে রোগের লক্ষণ, উপসর্গ দেখে কঠোর নজরদারি প্রক্রিয়াটি (সিন্ড্রমেটিক সারভিলেন্স) জোরালো করতে হবে। এছাড়াও শহরাঞ্চল থেকে গ্রামাঞ্চলে রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে ইতিমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপগুলো যদি আমরা বজায় রাখতে পারি তাহলে আশা করা যায়, রোগটির সংক্রমণের তীব্রতা গ্রাফ নিচের দিকে নেমে আসতে শুরু করবে। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই রোগটির প্রাদুর্ভাব হালকা বসতিপূর্ণ এলাকা থেকে অনেক বেশি, তাই রোগ নিয়ন্ত্রণে আমাদের প্রধানত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাতেই কঠোর ব্যবস্থাপনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। একই কারণে বস্তি বা এধরণের এলাকায় কঠোর সামাজিক ব্যবস্থাপনার প্রক্রিয়া চালু করা এবং অব্যাহত রাখা জরুরি।
আমাদের করনীয় কী?
সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ঘরে থাকার মত প্রক্রিয়াগুলো মেনে চলা দিনদিন আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। পুরোপুরি না পারলেও ন্যূনতম ৬০ থেকে ৭০ ভাগ সময় নিয়মগুলো যদি আমরা মেনে চলতে পারি তাহলে এই রোগের সংক্রমণ কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষত নিয়ম মেনে শতভাগ মাস্ক ব্যবহার খুব সাশ্রয়ী এবং কার্যকর একটি সংক্রমণ প্রতিরোধী পদ্ধতি। এই মহামারি আসলে কতদিনে শেষ হবে সেটা গণনা করা বেশ কঠিন। তবে আমরা এটা বলতে পারি যে, আক্রান্তের সংখ্যা যদি সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে যায়, তবে তা নীচের দিকে নামতে বাধ্য হবেই। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি জুলাই মাসেই এই সংখ্যাটা সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করবে। ইতিমধ্যেই টেস্টের সংখ্যা বাড়ার কারণে আক্রান্ত এলাকা এবং আক্রান্তের সংখ্যার যে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝা যায় নির্দিষ্ট কিছু এলাকা কিংবা জায়গার মধ্যে কোভিড-১৯ এর বিস্তৃতি ও ভয়াবহতা তুলনামূলক অনেক বেশি । আমরা যদি এখনই এই ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোকে ফোকাস করে সামগ্রিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করতে পারি তাহলে আমরা খুব শীঘ্রই আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে ফেলতে পারবো।
আরেকদল জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের মতে সামাজিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ কার্যকর হলেও এর দীর্ঘমেয়াদী বাস্তবায়নের ফলে দেখা দিয়েছে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা। ব্যাহত হচ্ছে দৈনন্দিন সামাজিক কার্যক্রম এবং সৃষ্টি হচ্ছে নৈরাজ্যের। আর্থসামাজিক মন্দা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থার সক্ষমতার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে এই ওষুধবিহীন সামাজিক ব্যবস্থাপনা কতখানি টেকসই পদ্ধতি তা নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। তবে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য ‘স্বাস্থ্য নাকি অর্থনীতি’ এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেওয়া বেশ কঠিন। বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রই এখন ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে, যা কোভিড-১৯ রোগটির পুনরায় ব্যাপকভাবে সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এই অবস্থায় পুরাপুরি লকডাউন তুলে না দিয়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় সামাজিক ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপগুলোতে কিছুটা শিথিলতা এনে পদ্ধতিটি অব্যাহত রাখলে পারস্পরিক সংস্পর্শ কমিয়ে এনে ‘সার্স-কোভ-২’ বা নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সীমিত করা সম্ভব।
যাদের সহযোগিতায় এই লেখাটি সমৃদ্ধ হয়েছে- রাইয়ান আমজাদ, ডা. ইশরাত মৌরি, ডা. নাওমি নুর
লেখক: রোগতত্ত্ববিদ